X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

রিজার্ভ!

প্রভাষ আমিন
২৮ জুলাই ২০২২, ২০:২৬আপডেট : ২৮ জুলাই ২০২২, ২০:২৬

একেক সময় অর্থনীতির একেক সূচক নিয়ে ঝড় ওঠে। আমরা আমজনতা, যারা অর্থনীতির জটিল হিসাব-নিকাশ কম বুঝি, তারা তখন অথৈ পাথারে পড়ে যাই। ধরতে পারি না ভালো মন্দ। যেমন, মাঝে মাঝেই মাথাপিছু আয় নিয়ে হইচই শুরু হয়। ধেই ধেই করে বাড়তে বাড়তে আমাদের মাথাপিছু আয় এখন আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়েছে। আমরা খুব উৎফুল্ল হই, নিজেরাই নিজেদের বাহবা দেই। কিন্তু মাথাপিছু আয়ের ধাঁধাটা কখনও আমার পিছু ছাড়ে না। আমাদের যা মাথাপিছু আয়, বাংলাদেশের অনেকের জন্য তা এক আড্ডার বিল। আবার অনেকে জীবনে অত টাকা কখনও একসঙ্গে দেখেনওনি। এই শুভঙ্করের ফাঁকি নিয়েই অর্থনীতি এগোচ্ছে, উন্নয়ন হচ্ছে। এই ধাঁধা অবশ্য শুধু বাংলাদেশের নয়, মাথাপিছু আয় মাপার এটাই একমাত্র উপায়। মোট আয়কে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলেই বেরুবে মাথাপিছু আয়। এই বৈষম্য সভ্যতার সমান বয়সী। কল্যাণ রাষ্ট্রের কাজ হলো বৈষম্য কমিয়ে রাখা। কিন্তু বৈষম্য একেবারেই থাকবে না, এটা শুধু কল্পনায় সম্ভব, বাস্তবে নয়।

বলছিলাম অর্থনীতির নানান সূচকের কথা। কখনও জিডিপি, কখনও নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ, কখনও উন্নয়নশীল দেশ- আমাদের আশাবাদী করে। তবে ইদানীং অর্থনীতির যে টার্মটি আমাদের জীবনযাপনে দারুণ প্রভাব ফেলছে তা হলো– রিজার্ভ, মানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ‘রিজার্ভ খায় না, মাথায় দেয়’– তা নিয়ে অবশ্য সাধারণ মানুষের কোনও মাথাব্যথা নেই, কোনোকালে ছিলও না। তবে ইদানীং রিজার্ভ নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে।

আমি অর্থনীতির ছাত্র নই, অত ভালো বুঝিও না। তবে যেটুকু বুঝি তা হলো, আপনি যদি অন্য কোনও দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করেন, আরও সহজ করে বললে কেনাবেচা করেন; তাহলে আপনার ডলার লাগবে। আর ডলারের মজুত কত, সেটাই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসেবে পরিগণিত হয়। বিদেশ থেকে কিছু কিনতে যেমন আপনার ডলার লাগবে, আবার বিদেশে কিছু বিক্রি করলেও আপনি ডলার পাবেন।

দুই বছর পর বাংলাদেশের রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসার পর চারদিকে গেলো গেলো রব উঠেছে। এই বুঝি বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাচ্ছে, এই বুঝি বাংলাদেশ পাকিস্তান হয়ে যাচ্ছে। তাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি, ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নামলেও বাংলাদেশের রিজার্ভ এখন ৩৯.৮ বিলিয়ন ডলার, মানে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারই। আর শ্রীলঙ্কার রিজার্ভ মাত্র ২ বিলিয়ন ডলার, পাকিস্তানের ১০ বিলিয়নের আশপাশে। রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নামা নিয়ে যারা শঙ্কিত, তাদের জন্য বলি, ২০০১ সালে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল এক বিলিয়ন ডলার, ঠিকই পড়েছেন– মাত্র এক বিলিয়ন ডলার। ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াতের আমলে রিজার্ভ ছিল গড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তখনও রিজার্ভ ছিল ৮ বিলিয়ন ডলার। এরপর আওয়ামী লীগের উন্নয়ন ভাবনা এবং সঠিক নীতি ও পরিকল্পনার সুবাদে রিজার্ভ বাড়তে থাকে হু হু করে।

গত বছর বাংলাদেশের রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত উঠেছিল। প্রথমে করোনা তারপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় দুই বছর পর বাংলাদেশের রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। এখন একবার ভাবুন ২০০১ সালের এক বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভকে ২০২২ সালে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে তুলে আনাটা বড় কৃতিত্ব নাকি রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসাটা বড় ব্যর্থতা?

বাংলাদেশের বর্তমান প্রায় রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলার নিয়ে অবশ্য একটা বিতর্ক আছে। অনেকে বলছেন, বাংলাদেশের প্রকৃত রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলার। কারণ, বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন তহবিল-ইডিএফ’এ ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। সেটা তরল রিজার্ভ হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। তথ্যটি মিথ্যা নয়। ২০১৪-১৫ সালে যখন রিজার্ভ বাড়তে বাড়তে ২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়, তখন অনেকে বলতে থাকেন, এত রিজার্ভ থাকাও ভালো নয়। বাংলাদেশ তখন রিজার্ভ থেকে রফতানি উন্নয়ন তহবিলে ঋণ দেয়, যা আসলে এক ধরনের বিনিয়োগ। কারণ, সেই তহবিলের সঠিক ব্যবহার আপনার রফতানিতে গতি আনবে। তাৎক্ষণিকভাবে হয়তো নয়, তবে চাইলে আপনি সে বিনিয়োগ তুলেও আনতে পারবেন। নানা রকম উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও রিজার্ভ যখন তর তর করে ৪৮ পর্যন্ত উঠে যায়, তখন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ফুরফুরে হাওয়া বইছিল। এমনকি বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কাকে ২৫০ মিলিয়ন ডলার সাহায্যও দিয়েছে। আপনি যখন বড় লোক হবেন, আপনার হাতে যখন অলস অর্থ থাকবে; তখন আপনি ‘গরিব’ প্রতিবেশীকে সহায়তা করবেন বা লাভজনক কোথাও বিনিয়োগ করবেন। বাংলাদেশও তা-ই করেছে। কিন্তু যখন ঝড় আসবে, তখন আপনাকে দরজা-জানালা বন্ধ করে নিরাপদে থাকতে হবে। ঝড় তো আপনি ঠেকাতে পারবে না, তাই নিরাপদে থাকাটাই একমাত্র উপায়। যুদ্ধের যে ঝড়ো প্রভাব, তা থেকে মুক্ত নয় কেউই। আপনার ঘর কতটা মজবুত, তার ওপর নির্ভর করছে আপনি কতটা নিরাপদ থাকবেন। দুর্বল শ্রীলঙ্কা ধসে পড়েছে, পাকিস্তানও কাঁপছে। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত অনেক মজবুত, তাই এই ঝড়ে আমরা সতর্ক থাকবো, তবে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

এবার আসুন রিজার্ভ কীভাবে বাড়ে-কমে সেটা দেখি। আপনি যখন বেশি কিনবেন, তখন আপনার খরচ বেশি হবে; বেশি বিক্রি করলে আয় বেশি হবে। এটাই সহজ হিসাব। বাংলাদেশের রিজার্ভের মূল উৎস দুটি- রফতানি থেকে পাওয়া অর্থ এবং রেমিট্যান্স। আর এই রিজার্ভ খরচ হয় আমদানিতে এবং ঋণের কিস্তি শোধে। আপনার কেনার পরিমাণ যখন বিক্রির চেয়ে বেশি হবে; তখনই আপনার টান পড়বে। সাম্প্রতিক অস্থিরতায় ডলারের দাম আকাশে উঠে যাওয়ায় আমদানি করতে বেশি ডলার খরচ হচ্ছে। তাতেই নিম্নমুখী রিজার্ভ। এ কারণেই সরকার এখন সাশ্রয়ে মনোযোগী। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি আমদানি করতে চলে যায় আমাদের মোটা অঙ্কের ডলার। তাই সরকার বিদ্যুৎ সাশ্রয় করে আমদানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। শুধু বিদ্যুৎ খাত নয়, সব খাতেই সাশ্রয়ের চেষ্টা হচ্ছে। বিপদের দিনে সবাই এমনটাই করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিতে যে টালমাটাল অবস্থা সৃষ্টি করেছে, তাতে আপাতত সংযমের কোনও বিকল্প নেই। আর রিজার্ভ কিন্তু শুধু বাংলাদেশের কমেনি, সব দেশেরই কমেছে। আপনার আমদানি নির্ভরতা যত কমবে, আপনার অর্থনীতি তত শক্তিশালী হবে, রিজার্ভ তত বাড়বে। দেশীয় উৎপাদন যত বাড়বে, আমদানি নির্ভরতা তত কমবে। তাই নজর দিতে হবে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর দিকে। এটা হয়তো রাতারাতি সম্ভব নয়। তবে মনোভাব বদলালে এবং সঠিক নীতি সহায়তা পেলে দেশীয় পণ্যের বাজার আরও বড় হবে।

এমনিতে তিন মাসের পণ্য আমদানি করার মতো রিজার্ভ থাকলে অর্থনীতির ভাষায় সেটা নিরাপদ। বাংলাদেশের এখন যা রিজার্ভ তাতে প্রায় ৬ মাসের পণ্য আমদানি করা সম্ভব। আর শুধু খাদ্যপণ্য বিবেচনা করলে ৯ মাস পর্যন্ত আমদানির অর্থ আছে আমাদের কাছে। তাই ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কু-তর্কে অভ্যস্ত অনেকে বলছেন, ৬ মাস পর কী হবে। তাদের কথা শুনে মনে হতে পারে, আগামী ছয় মাস বাংলাদেশ শুধু কিনবে, কিছুই বিক্রি করবে না। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের আমদানি ব্যয় যেমন বেড়েছে, তেমনি রফতানি আয়ও বেড়েছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানি প্রথমবারের মতো ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।

আমাদের রিজার্ভের আরেক বড় উৎস রেমিট্যান্সেও গতি আছে। গত ঈদের আগে পরে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ছিল স্বস্তিদায়ক। গত বছর বাংলাদেশ থেকে ৯ লাখ মানুষ নতুন করে দেশের বাইরে গেছেন। তারা যখন টাকা পাঠানো শুরু করবেন, রেমিট্যান্স আরও গতি পাবে। তাই আমদানি করতে গিয়ে রিজার্ভ যেমন খরচ হবে, পাশাপাশি রফতানি ও রেমিট্যান্সে রিজার্ভের ট্যাঙ্ক পূর্ণও হবে। তাই ট্যাঙ্ক একেবারে ফুরিয়ে যাওয়ার কোনও ভয় নেই। তবে আমাদের আয়-ব্যয়ের ব্যবধানটা কমিয়ে আনতে হবে, দেশি পণ্যের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হবে, আমদানি কমাতে হবে। আর ডলারের বাজার স্থিতিশীল রাখতে হবে। তাতেই রিজার্ভ ঠিক থাকবে বা আবার বাড়তে থাকবে। তাই ভয়ের কিছু নেই। তবে সাবধান থাকতে হবে।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা   
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা  
সিলেটে আবারও শুরু হচ্ছে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম
সিলেটে আবারও শুরু হচ্ছে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম
ভ্রমণ শেষে ভারত থেকে তিন দিনে ফিরলেন ১৫ হাজার পর্যটক
ভ্রমণ শেষে ভারত থেকে তিন দিনে ফিরলেন ১৫ হাজার পর্যটক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ