X
সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫
২৩ আষাঢ় ১৪৩২

পরিবহন খাতের নৈরাজ্য থামাবে কে?

প্রভাষ আমিন
১১ আগস্ট ২০২২, ১৮:৫২আপডেট : ১১ আগস্ট ২০২২, ১৮:৫২
জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধির পর চারদিকে হাহাকার তৈরি হয়েছে। এরইমধ্যে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে জনজীবনে। প্রথম ধাক্কাটা লাগবে পরিবহন খাতে- এটা প্রত্যাশিতই ছিল। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাস ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর আগে জ্বালানি মন্ত্রণালয় বাস ভাড়া সম্ভাব্য কত বাড়তে পারে, তার একটা হিসাব দিয়েছিল। তাতে মহানগরে ১৩ ভাগ এবং দূরপাল্লায় ১৬ ভাগ ব্যয় বাড়বে বলে ধারণা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ভাড়া বেড়েছে যথাক্রমে ১৬ ও ২২ শতাংশ। বাস মালিকরা দাবি করেছিল ৭০ শতাংশ। তাদের দাবির তুলনায় ভাড়া কমই বেড়েছে বলতে হবে। যদিও তা জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের হিসাবের চেয়ে বেশি। তেলের দাম বাড়লেই মালিকরা নানান আজগুবি খরচের হিসাব নিয়ে আসেন। টায়ার-টিউব, রক্ষণাবেক্ষণের বিশাল খরচের বহর দেখিয়ে বাস ভাড়া বাড়িয়ে নিতে চান মালিকরা। তারাও জানেন পুরোটা পাবেন না, তারপরও কামান চাইলে বন্দুক মেলার কৌশলে তারা ৭০ ভাগ বৃদ্ধি চেয়ে সর্বোচ্চ ২২ ভাগ পেয়েছেন। যদিও শুধু তেলের দাম হিসাব করলে এটা বেশি। আবার সিএনজির দাম না বাড়লেও এই সুযোগে সিএনজিচালিত বাসের ভাড়াও বাড়বে। আবার যখন সিএনজির দাম বাড়ে, তখন ডিজেলচালিত বাসের ভাড়াও বাড়ে। এটা খুবই ইন্টারেস্টিং- ডিজেলের দাম বাড়লে মনে হয় সব বাস বুঝি ডিজেলেই চলে। আবার সিএনজির দাম বাড়লে মনে হয় সব বাস বুঝি সিএনজিতেই চলে। বাস মালিকরা সবসময় গাছেরটাও খান, তলারটাও কুড়ান।

সরকার যে ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছেন, সেটা যদি কার্যকর হতো, তাও না হয় কথা ছিল। পরিবহন খাত হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মাফিয়া। তারা বারবার জনগণকে জিম্মি করে দাবি আদায় করে, সেটা ভাড়ার ক্ষেত্রেই হোক আর নতুন আইনের ক্ষেত্রেই হোক।

শুক্রবার মধ্যরাতে জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধির খবর নিয়ে মানুষ ঘুমাতে গেলো। সকালে রাস্তায় বেরিয়ে দেখলো গাড়ি নেই। যাও অল্প কিছু গাড়ি আছে, তারাও ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করছে। ডিজেলের দাম যেহেতু ৪২ ভাগ বেড়েছে, তারাও নিজ দায়িত্বে ভাড়া ৪২ ভাগ বাড়িয়ে দিলো। তেলের দাম বাড়লে ভাড়া বাড়বে, এটা সবাই জানেন; মালিকরাও জানেন। কিন্তু ভাড়া বাড়ানো পর্যন্তও তর সয়নি তাদের। শনিবার দিনভর রাজপথে রীতিমতো ডাকাতি হয়েছে। এগুলো আসলে মালিকরা ইচ্ছা করে করেন। নিজেদের শক্তিটা আগে থেকে দেখিয়ে রাখেন, যাতে ভাড়া বাড়ানোর আলোচনার টেবিলে তারা বাড়তি সুবিধা পান। সমস্যা হলো, সরকার যে ভাড়া বাড়িয়েছে, তা কি পুরোপুরি কার্যকর হয়েছে? বিআরটিএ মোবাইল কোর্ট বসিয়ে লোক দেখানো কিছু অভিযান চালিয়েছে বটে, কিন্তু বাস ভাড়ার নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। সমস্যা হলো, সরকার যে ভাড়া  বাড়িয়েছে, অনেক রুটে আগেই তারচেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছিল। সরকারি নির্দেশ মানতে হলে তাদের ভাড়া কমাতে হবে। সরকার যাই নির্ধারণ করুক, বাস মালিকরা ভাড়া আদায় করবেন নিজেদের ইচ্ছামতো। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর থেকে প্রতিদিন যাত্রীদের সাথে পরিবহন শ্রমিকদের বচসা হচ্ছে, কোথাও কোথাও মারামারিও হচ্ছে। তবে আমার ধারণা, এই অস্থিরতা থাকবে না। একটা স্থিতিশীলতা আসবে। কীভাবে আসবে? আপনাদের কি ধারণা বাস মালিকরা জনগণের দাবির মুখে সরকার-নির্ধারিত ভাড়া আদায় করবে। তেমন আশা যদি কেউ করে থাকেন, আপনাদের আশার গুড়ে কঙ্কর পড়বে। অসংগঠিত মানুষের ক্ষোভ দুয়েকদিন পর প্রশমিত হয়ে যাবে। আরও সব অন্যায়ের মতো এটাও তারা মুখ বুজে সয়ে যাবেন। সুসংগঠিত পরিবহন মাফিয়াদের সঙ্গে সাধারণ মানুষ কখনোই পারেনি, পারবেও না। না পারার মূল কারণ, পরিবহন খাত যারা নিয়ন্ত্রণ করেন, তারা সবাই সরকারি দলের বিশাল বিশাল নেতা। শাজাহান খান যখন মন্ত্রী ছিলেন, তখন তার সরকারি বাসায় বসে পরিবহন ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং সেখান থেকে ফোনে সবাইকে জানানো হয়েছে। এই যদি হয় অবস্থা, আপনি কখনও তাদের সাথে পারবেন না।

ভাড়া বাড়ানোর যে বৈঠক হয়, কখনও সেই বৈঠকে যাত্রী প্রতিনিধি থাকে না। পরিবহন খাতের এই নৈরাজ্য বা বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ যদি আপনার বিশ্বাস না হয়, তাহলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরুল্লাহকে জিজ্ঞাসা করুন। এই অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে তিনি বাসে চড়েছিলেন। তাকেও বাড়তি ভাড়া দিতে হয়েছে।

বাড়তি ভাড়া নেওয়ার পরও তারা যদি একটু ভালো সেবা দিতো, তাহলেও যাত্রীরা নিজের মনকে সান্ত্বনা দিতে পারতেন। কিন্তু বাংলাদেশের আরও সব খাতের মতো পরিবহন খাতেও সেবার কোনও ধারণাই নেই। বাড়তি ভাড়া দিয়ে আপনাকে বাদুড়ঝোলা হয়ে অফিসে যেতে হবে। বসার সুযোগ যদি আপনার ভাগ্যে জোটেও বাসের আসনে ঠিকমতো পা মেলতে পারবেন না। আর নিজের মানসম্মান নিয়ে বাসায় ফিরতে চাইলে পরিবহন শ্রমিকদের অন্যায়ের প্রতিবাদ না করাই ভালো। বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করেছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে, উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জন করেছে, কিন্তু পরিবহন ব্যবস্থা মোটেই আমাদের উন্নয়নযাত্রার সমান্তরাল নয়। ঢাকার রাস্তার গাড়ি দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না এটা উন্নয়নশীল দেশ বা আমাদের মাথাপিছু আয় আড়াই হাজার ডলারের বেশি। ঢাকার যানজটের একটা প্রধান কারণ পরিবহন খাতের এই নৈরাজ্য। তারা কে কার আগে যাবে, এই নিয়ে দিনভর প্রতিযোগিতা করে প্রতিটা স্টপেজকে স্থবির করে রাখে। একটা জনবান্ধব, আরামদায়ক গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে, ছোট গাড়ির ওপর চাপ অনেক কমে যেতো। তাতে রাস্তাটা আরও সহনীয় হতো।

বাস ভাড়ার পর এখন লঞ্চ ভাড়া বাড়ছে। কিন্তু সেখানেও সেবার নামে লবডঙ্কা। ট্রেন ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়নি, তবে রেলমন্ত্রী জানিয়েছেন, ট্রেন ভাড়া বাড়ানোর বিষয়টি আলোচনা হয়েছে। তার মানে আগে আর পরে ট্রেন ভাড়াও বাড়বে।

সরকার ইচ্ছামতো তেলের দাম বাড়াবে। তারপর পরিবহন খাতে ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়বে। কিন্তু সাধারণ মানুষ কই যাবে? কার কাছে প্রতিকার চাইবে। নীতিনির্ধারকরা কথায় কথায় বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দেন। তারা তো অনেক দেশ দেখেছেন। বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ গণপরিবহন ব্যবস্থা আর কোন দেশে আছে? একটা জনবান্ধব গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা কি একদম অসম্ভব?
 
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (৭ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (৭ জুলাই, ২০২৫)
মধ্যরাতে সংবর্ধনায় বিশ্বকাপ স্বপ্নের কথা বললেন ঋতুপর্ণা ও আফঈদারা 
মধ্যরাতে সংবর্ধনায় বিশ্বকাপ স্বপ্নের কথা বললেন ঋতুপর্ণা ও আফঈদারা 
গণভবন জয় করেছি, এবার জাতীয় সংসদ জয় করবো: নাহিদ ইসলাম
গণভবন জয় করেছি, এবার জাতীয় সংসদ জয় করবো: নাহিদ ইসলাম
একটি দলের কারণে ঐকমত্য কমিশনে মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবনা আটকে যাচ্ছে: আখতার
একটি দলের কারণে ঐকমত্য কমিশনে মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবনা আটকে যাচ্ছে: আখতার
সর্বশেষসর্বাধিক