X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের সংশোধনী যেমন হওয়া উচিত

বেলাল আহমেদ
২৩ আগস্ট ২০২২, ১৮:৫৮আপডেট : ২৪ আগস্ট ২০২২, ১৪:২৬

‘উন্নয়ন অংশীদারখ্যাত’ বেসরকারি উদ্যোক্তারা যেমন শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করেছেন তেমনই সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলেছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার সীমিত সুযোগের বিপরীতে বেসরকারি খাতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে এদেশে নতুন বিপ্লব সূচিত হয়।

তবে শুরুটা মোটেই সহজ ছিল না। নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে সাফল্যের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আজ শিক্ষার্থী প্রায় চার লাখ। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক মানের কোর্স-কারিকুলাম, শিক্ষাদান পদ্ধতি ও সুবিধাদির বিবেচনায় আমাদের বিদেশমুখী শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেকাংশে কমেছে এবং বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হয়েছে ঢের।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন অর্জনগুলো উল্লেখ করার ক্ষেত্রে অনেক কিছুই লিখতে হয়। সে প্রসঙ্গে পরে আসি। বর্তমানে কী বাস্তবতার মধ্য দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যাচ্ছে, তার কিছুটা উল্লেখ করতেই হয়।

এক.

বিশ্বের নামিদামি শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শত বছরের ঐতিহ্যের তুলনায় মাত্র তিন দশকে আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন ও সাফল্য সত্যিই ঈর্ষণীয়। সেই ঈর্ষাই মনে হয় কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরাই আমাদের অবদান ও অর্জনকে তুচ্ছ জ্ঞান করছি। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে একদল পেশাজীবী খুঁজে বেড়াচ্ছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খুঁত-ত্রুটি।

দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব না থাকায় এ খাতের অর্জন, উন্নয়ন যেমন ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে, তেমনি কিছু ব্যক্তি/গোষ্ঠীর বৈরী মনোভাব এবং নেতিবাচক আচরণ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রাকে প্রতিনিয়ত ম্লান করে দিচ্ছে।

গত প্রায় দুই দশক ধরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে কর্মরত অবস্থায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন ক্রান্তিকাল চোখে পড়েনি। বিশেষ করে করোনা সংকটের সময় ও সংকট কাটিয়ে ওঠার কঠিন সময়ে ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’-এর মতো নতুন নতুন সমস্যায় অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়েছে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খাত।

সংকটের মধ্যে অন্যতম— বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস/স্টাডি সেন্টারের অনুমোদন, বিশ্বব্যাপী প্রচলিত এবং দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা তিন সেমিস্টার পদ্ধতি পরিবর্তনের আল্টিমেটাম এবং সর্বশেষ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ হালনাগাদ করার প্রস্তাবনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা-প্রতিষ্ঠাতাদের অধিকার ও প্রাপ্য সম্মান খর্ব করার উদ্যোগ।

এমনিতেই ট্রাস্টি বোর্ড (সংশোধিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী) গঠনের মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাদের কেবল অর্থ সরবরাহকারীর ভূমিকায় সীমাবদ্ধ করা হয়েছে (যেখানে অর্থ উত্তোলনের ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ এবং মনোনীত এক কর্মকর্তাকে)।

তার ওপর, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ হালনাগাদকরণের খসড়া প্রস্তাবনায় কমিটি কর্তৃক যে সকল সুপারিশ করা হয়েছে তা পক্ষান্তরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে অভিভাবকশূন্যই করবে।

বিশ্ববিদ্যালয় অর্থ সংকট ও সিদ্ধান্তহীনতায় স্থবির হয়ে পড়বে। কেননা, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ কথা ধরে নেওয়ার সুযোগ নেই যে, দেশের অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর্থিকভাবে স্বচ্ছল কিংবা তাদের হাজার কোটি টাকার তহবিল রয়েছে।

বাস্তবতা হলো— প্রথম প্রজন্মের দু-চারটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাদে সকল বিশ্ববিদ্যালয়েরই তহবিল সংকট রয়েছে এবং পরিচালনা ব্যয়সহ উন্নয়ন কার্যক্রমে ট্রাস্টিদের নিয়মিত অর্থের সংস্থান করতে হয়।

এক্ষেত্রে নিজস্ব অনুদান ছাড়া অন্য কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ, বিনিয়োগ বা আর্থিক সহায়তা পায় না কোনও বিশ্ববিদ্যালয়। কারণ ট্রাস্টের অন্তর্ভুক্ত অলাভজনক প্রতিষ্ঠান বলে কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে না। যে কারণে করোনার সময় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশই রুগ্ন হয়ে পড়েছে এবং কোনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্তান্তর হওয়ার খবরও শোনা যাচ্ছে।

এ অবস্থায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ হালনাগাদ করণের প্রস্তাবনায় প্রদত্ত সুপারিশ শিক্ষানুরাগী ট্রাস্টিদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দূরে সরিয়ে দেবে। যার চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করি।

প্রকৃতপক্ষে, ২০১০ সালে নতুন করে প্রণীত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে বিরাজমান সমস্যা, সীমাবদ্ধতা, সমন্বয়হীনতার বিষয়াদি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এ ক্ষেত্রে ‘গোড়ায় গলদ’ প্রবাদের যথার্থতা পাওয়া যায়। তা হলো— বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ট্রাস্ট আইনের আওতায় আনা।

বেসরকারি পর্যায়ে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, বিভিন্ন বেসরকারি কলেজ, এমনকি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা বা পরিচালনার ক্ষেত্রে এমন কোনও বাধ্যবাধকতার বিধান নেই। বেসরকারি পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এহেন দ্বৈতনীতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বড় বাধা।

উল্লেখ্য, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নতুন করে অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয় ২০১৪ সালে ‘বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস/স্টাডি সেন্টার পরিচালনা প্রজ্ঞাপন’ জারির ফলে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ট্রাস্ট আইন-১৮৮২ এর অধীন অলাভজনক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হয়। অথচ বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস/স্টাডি সেন্টারগুলোকে কোম্পানি আইন ১৯৯৪-এর অধীন লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনুমোদন দেওয়ায় কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

কোনও ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলের অর্থ উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় ব্যয় ছাড়া অন্য কোনও উদ্দেশ্যে ব্যয় করা যাইবে না’ মর্মে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এর (৪৪)৭ ধারার উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস/স্টাডি সেন্টার-২০১৪ বিধি- ৭ (ঝ) অনুযায়ী উদ্বৃত্ত অর্থ-সম্পদ উদ্যোক্তা, স্থানীয় প্রতিনিধি ও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আনুপাতিক হারে বণ্টন করার কথা বলা হয়েছে। যা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এর সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা-প্রতিষ্ঠাতাদের সংগঠন বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস/স্টাডি সেন্টার পরিচালনা প্রজ্ঞাপন-২০১৪ পুনঃমূল্যায়ন ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সংশোধনের দাবি জানায়। যা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ হয়।

কিন্তু ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়-১ শাখার একজন উপসচিবের স্বাক্ষরে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক একটি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস/স্টাডি সেন্টার স্থাপন ও পরিচালনার সাময়িক অনুমতি দেওয়া হয় এবং বর্তমানে যার কার্যক্রম চলছে।

স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, দেশে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, বেসরকারি কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ এমনকি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস/স্টাডি সেন্টার প্রতিষ্ঠা এবং লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালনার অনুমোদন ও আইন থাকলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে উল্টোটা কেন? সদুত্তর কারও কাছে পাওয়া যায় না। তাই আশঙ্কা জাগে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যত নিয়ে।

দুই.

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এর খসড়া প্রস্তুতের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের একজন সদস্যের নেতৃত্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবসহ ৫ সদস্যের একটি কমিটি কাজ করছে। যেখানে অংশীজনের প্রতিনিধি রাখা হয়নি।

ফলে মাঠ পর্যায়ে বর্তমান আইনের সীমাবদ্ধতা এবং চলমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা এবং সেগুলোর সমাধানের বিষয়টি উপেক্ষিতই রয়ে গেছে।

সম্প্রতি জাতীয় দৈনিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ হালনাগাদ করণে গঠিত কমিটির উদ্ধৃতি দিয়ে অনিয়ম রোধ, শিক্ষা উদ্যোক্তা তথা ট্রাস্টি বোর্ডের ক্ষমতা হ্রাস ও ইউজিসি কর্তৃক কোর্স ফি নির্ধারণ, সরকারি ব্যবস্থাপনায় সরাসরি উপাচার্য নিয়োগ, উপাচার্যকে সকল আর্থিক ক্ষমতা দেওয়ার বিধান রাখার কথাও বলা হয়েছে।

আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় যে, এটি কি আধা-সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নাকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়? কমিটির প্রস্তাবনা একপেশে বলে মনে করেন অনেক শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষা-উদ্যোক্তা।

প্রসঙ্গত, ড. ফরাসউদ্দিন আহমেদ, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে যথাযথই বলেছেন, ‘সবকিছু যদি সরকার নির্ধারণ করে দেয়, তবে আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কেন?’ আইন সংশোধনের নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের অর্থ, মেধা, শ্রম ও অবদানকে অস্বীকার করে তাদের স্থাপিত প্রতিষ্ঠানেই তাদেরকে গুরুত্বহীন করার সুদূর প্রসারী ফলাফল হবে বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ বন্ধ করে দেওয়া। 

২০১০ সালের বিদ্যমান আইনে ট্রাস্টি বোর্ড/উদ্যোক্তাদের সে অর্থে কোনও ক্ষমতাই দেওয়া হয়নি। অথচ অভিযোগ আছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় ট্রাস্টি বোর্ড হস্তক্ষেপ করে। আর্থিক সুবিধা গ্রহণ, কেনাকাটা, নিয়োগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ট্রাস্টিদের ওপর প্রভাব খাটানো হয়।

মূলতঃ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের সিদ্ধান্তটি ২০১০ সালের আইনের বড় একটি ভুল। কারণ ট্রাস্টের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে নিয়ম অনুযায়ী কোনও আর্থিক বা অন্য কোনও সুবিধা কেউ নিতে পারবে না। বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে গিয়ে নিজেদের সর্বস্ব বিনিয়োগ, মূল্যবান সময়, মেধা ব্যয় করেছেন যে উদ্যোক্তারা— ২০১০ সালের আইনে তাদের কোনও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

ফলে যখন বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় ট্রাস্টি বোর্ড হস্তক্ষেপ করতে যায় তখনই সেটা ২০১০ সালের আইন পরিপন্থী হিসেবে পরিগণিত হয়। অভিযোগের তীর ছোড়া হয় ট্রাস্টি সদস্যদের প্রতি।

এসব অভিযোগ বিদ্যমান আইনের ভুলের কারণেই তৈরি হয়েছে। এরকম একটি আইন সংশোধনের পর আবারও ট্রাস্টি বোর্ড ব্যবস্থা রয়ে গেলে ট্রাস্টি সদস্য বা উদ্যোক্তারা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় অনিয়মে জড়িয়ে পড়তে পারেন। এতে আইনের চোখে আরও অভিযোগ বাড়বে এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ধীরে ধীরে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে।

মনে রাখা দরকার যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃশ্যমান উন্নয়ন উদ্যোক্তাদের স্বপ্ন, মেধা, দূরদর্শিতা, নিরলস ও কঠোর পরিশ্রমের ফসল।

সদিচ্ছা ও শিক্ষার প্রতি অনুরাগ না থাকলে এদেশে বেসরকারি পর্যায়ে আন্তর্জাতিক মানের উচ্চশিক্ষার প্রসারে তারা অর্থ লগ্নি করতেন না। কেবল মুনাফা অর্জনের ইচ্ছা থাকলে গার্মেন্টস কারখানা বা এ জাতীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানেই বিনিয়োগ করতেন।

এখন তো বলতেই হয় যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান দেশের তো বটেই, বিদেশি শিক্ষার্থীদেরও আকৃষ্ট করছে। হাজার হাজার শিক্ষার্থী দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা অর্জন করে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির উচ্চ পদে চাকরি করছে। বাস্তবতা হলো, আমাদের বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখন বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালগুলোকেও পেছনে ফেলেছে। আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা গবেষণা, পিএইচডিধারী দেশি-বিদেশি শিক্ষক, বেতন কাঠামো, অবকাঠামো, ল্যাব— ইত্যাদি ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেগুলো এগিয়ে। অথচ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের পেছনে রাষ্ট্রের কোনও খরচই নেই; যেখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যায়গুলোকে প্রতিবছর মোটা অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন যথার্থই বলেছেন, ‘সরকারের একার পক্ষে বিশাল জনগোষ্ঠীকে উচ্চশিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব হবে না। যুগে যুগে দেশে দেশে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের দৃষ্টান্ত অনুসরণে আমাদেরও উন্নয়ন কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সে জন্য বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহ দিতে হবে, স্পেস দিতে হবে।’

উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় উচ্চশিক্ষায় ভূমিকা রাখার সুযোগ অবারিত করতে দেশের প্রচলিত আইনের যথাযথ সংস্কার এবং আইনগতভাবে সকল বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমান সুযোগ থাকা প্রয়োজন।

ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, বেসরকারি কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ এমনকি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস/স্টাডি সেন্টার প্রতিষ্ঠা এবং লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালনার অনুমোদনের বিপরীতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ট্রাস্ট আইনের আওতায় বেঁধে সামঞ্জস্যহীন নিয়ম-বিধি দ্বারা পরিচালনার সুদূরপ্রসারী ফলাফল জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে না।

সম্প্রতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স, উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ বিলম্বের ঘটনা (যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি না পাওয়ার কারণে) যেভাবে ফলাও করে প্রচার হয়, তাতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও এর শিক্ষার্থীদের বিব্রত করার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ সংস্থার অপারগতাই প্রকাশ পায়। অথচ দেশের অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা অনিয়মের পাশাপাশি উপ-উপাচার্য পদ, কোষাধ্যক্ষ পদ বছরের পর বছর শূন্য পড়ে আছে। 

বৈষম্য ও দ্বৈতনীতির শিকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হতাশ উদ্যোক্তারা যদি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেন তাহলে সরকারই বিপাকে পড়বে। নতুন সংশোধনীতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাঠামোকে প্রাথমিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সংকীর্ণ করে ফেলার কারণে যদি উদ্যোক্তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন তাহলে এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

নতুন শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার জন্য তখন কোথায় যাবে? নিঃসন্দেহে ভারত, মালয়েশিয়া, জাপান, চীনে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। তাতে লাভ কার আর ক্ষতি কার সেটাও বিবেচনা করতে হবে।

সরকারের দ্বায়িত্বশীলদের এ ব্যাপারে গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার। দেশে উচ্চশিক্ষার ভারসাম্যহীন নীতির জন্য সংশ্লিষ্টদের অদূরদর্শী মনোভাবকেই দায়ী মনে করেন এ খাতের পেশাজীবী ও উদ্যোক্তারা।  

এখন যা জরুরি

আপাতদৃষ্টেয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খসড়া আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি দায়িত্বশীলদের কাছে মুখ্য বিবেচিত হয় সেটি হলো— ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য উদ্যোক্তাদের চেপে ধরা এবং উচ্চশিক্ষার প্রসার থেকে তাদের দূরে সরিয়া রাখা।

অথচ আইনের খসড়া প্রণয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি, উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি, বিশ্বমানে উন্নয়নের লক্ষ্যে বিদেশে অবস্থানরত আমাদের মেধাবী শিক্ষকসহ বিদেশি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করা, গবেষণা, সৃজনশীল ও শিল্পচাহিদা সম্পন্ন কর্মপযোগী শিক্ষার প্রসারই মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত বলে মনে করেন শিক্ষাবিদ ও শিক্ষানুরাগীদের বড় একটি অংশ।

তাই নতুন করে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে একতরফা সুপারিশ চূড়ান্ত করে চাপিয়ে না দিয়ে অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে উচ্চশিক্ষার বৃহত্তর স্বার্থে কল্যাণমুখী, যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন জরুরি।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম দূর করতে উদ্যোক্তা প্রতিনিধিদের নিয়ে আইন প্রণয়ন, কঠোর তদারকি এবং আইনি কাঠামোর মধ্যে প্রত্যেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সক্ষমতার ভিত্তিতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।

যথাযথ আইন প্রণয়ন এবং কার্যকরী প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনকে শক্তিশালী করার জন্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধির পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ের অংশীজন তথা শিক্ষানুরাগী উদ্যোক্তাদের খণ্ডকালীন হলেও সদস্য হিসেবে সম্পৃক্ত করা যায়। যেভাবে বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলে করা হয়েছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ সংশোধন বা হালনাগাদ করণের ক্ষেত্রে ট্রাস্ট আইনের বাধ্যবাধকতা পরিহার করে ভারতের মতো ট্রাস্ট অ্যাক্ট, সোসাইটি অ্যাক্ট এবং কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট— এই তিন পদ্ধতির আওতায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও পরিচালনার অনুমোদন দেওয়া যায়।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ট্রাস্ট আইনের অধীন অলাভজনক বিশ্ববিদ্যালয় যেমন রয়েছে তেমনি অন্যান্য আইনে লাভজনক বিশ্ববিদ্যালয়ও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশে এই পদ্ধতির আওতায় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয়ে আসছে।

ব্রিটেন, ফিলিপাইন, অস্ট্রেলিয়ায় উভয় ব্যবস্থা বিদ্যমান। বিদেশে ওইসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভালো করছে এবং সরকার রাজস্ব আদায় করে অন্য খাতে বিনিয়োগও করছে। বাংলাদেশও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এ কিছু পরিবর্তন এনে কাজটি ত্বরান্বিত করার প্রসঙ্গ বিবেচনা করা যেতেই পারে।

কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন বা সোসাইটি অ্যাক্ট দ্বারা পরিচালিত হলে আর্থিক অনিয়ম বাড়বে— এমনটা ভাবার যুক্তি নেই। কেননা, আইনের মধ্যেই নিয়মমাফিক আর্থিক সুবিধা বা সম্মানি গ্রহণের ব্যবস্থা থাকবে। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে প্রচলিত আইনেই ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ থাকবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন হালনাগাদ বা সংশোধনী এমনভাবেই হওয়া উচিত যাতে আইন দিয়েই অনিয়ম রোধ এবং সবার প্রাপ্য সুযোগ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। 

দেশে বেসরকারি পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নয়ন, গবেষণাধর্মী ও কর্মপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ও সরকারকে উদার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। প্রথম দিকে পাঁচ থেকে সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়/ইউজিসি পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে।

এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন অথবা সক্ষম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বিনিয়োগে শুরু করা যেতে পারে। সক্ষমতা অর্জন করেছে এমন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জাতীয় স্বার্থে এমন কর্ম পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে। অন্যদিকে, সক্ষমতা অর্জনের জন্য অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। 

 

লেখক: জনসংযোগবিদ ও সাংবাদিক

 

/এসএএস/এফএ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বৃষ্টি ও বন্যায় কেনিয়ায় নিহত অন্তত ৪৫
বৃষ্টি ও বন্যায় কেনিয়ায় নিহত অন্তত ৪৫
‘তাই বলে ১৯ গোল খাবো!’
‘তাই বলে ১৯ গোল খাবো!’
বিকেএসপি কাপ ভলিবলে লাল দল চ্যাম্পিয়ন
বিকেএসপি কাপ ভলিবলে লাল দল চ্যাম্পিয়ন
যে দর্শনে পাকিস্তানকে কোচিং করাতে চান গিলেস্পি
যে দর্শনে পাকিস্তানকে কোচিং করাতে চান গিলেস্পি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ