X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

চীনে সামরিক অভ্যুত্থানের গুজব: প্রকৃত কী ঘটেছিল?

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
০২ অক্টোবর ২০২২, ২০:১৫আপডেট : ০২ অক্টোবর ২০২২, ২০:২৭

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত হয়– চীনে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে এবং ওই অভ্যুত্থানে চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং গৃহবন্দি হয়েছে। ওই অভ্যুত্থানের প্রচার-প্রচারণা শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সীমাবদ্ধ থাকেনি। মূলধারার গণমাধ্যমে ওই বিষয়ে সংবাদ ও বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে। এক্ষেত্রে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো ছিল অগ্রণী। তারা চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের গৃহবন্দি জীবন নিয়ে বেশ চমকপ্রদ শিরোনামে ধারাবাহিক সংবাদ প্রকাশ করেছে। তবে উপর্যুক্ত প্রত্যেক মাধ্যমই নিশ্চিত করে বলতে পারেনি প্রকৃতপক্ষে চীনে ওই সময় সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছিল, নাকি হয়নি। তারা প্রায় সবাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভর করে সংবাদ প্রকাশ করেছে।

কোনও যাচাই-বাছাই ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমনির্ভর সংবাদ প্রচার মূলধারার গণমাধ্যমের জন্য বিরল ও ব্যতিক্রমী ঘটনা ছিল। অবশ্যই চীনে গণমাধ্যমের ওপর কঠোর সেন্সরশিপ আরোপিত এবং বিকল্পও গণমাধ্যমগুলো ছিল না। একসময় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কারণে গণমাধ্যমগুলো সেন্সরশিপ ভেদ করে সংবাদ সংগ্রহ করতে গুপ্তচর সাংবাদিক নিয়োগ করলেও এখন ওই চল নেই বললেই চলে। ফলে চীনে সামরিক অভ্যুত্থানের সংবাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘হট কেক সংবাদ’ হলেও বেইজিংয়ে ওই সময় আসলে কী ঘটছিল তা নিশ্চিত করে বিশ্বের কোনও গণমাধ্যমই প্রচার করতে পারেনি। আধুনিক গণমাধ্যমগুলোর জন্য তা এক বিরাট কলঙ্ক ও অন্ধকার অধ্যায় বলা যায়।

উজবেকিস্তানের ঐতিহাসিক নগরী সমরখন্দে অনুষ্ঠিত সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও)-এর সামিট শেষে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং দেশে আসেন ১৬ সেপ্টেম্বর  ২০২২। দেশে ফেরার পর থেকে তিনি আর জনসম্মুখে আসেননি। তার ওই অনুপস্থিতির সঙ্গে আরও দুটি ঘটনা ওই সময় আলোচিত হয়–

১) চীনের একটি সামরিক কনভয় রাজধানী বেইজিংমুখী যাত্রার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়;

২) স্যাটেলাইট ভিউ থেকে দেখা যায়, ওই সময়ে চীনের অভ্যন্তরীণ রুটের অসংখ্য ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। ওই ফ্লাইট বাতিলের ঘটনা উল্লেখ করে আমেরিকায় নির্বাসিত চীনা সাংবাদিক জেনিফার জেং টুইটারে লেখেন, চীনে একদিনে ১৬৬০২টি ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে, এরমধ্যে ৯৫৮৩ টি ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে। চীনের ওই নির্বাসিত সাংবাদিক আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক পরিচিত হওয়ায় মুহূর্তে তার ওই পোস্ট ভাইরাল হয়।

এই মাসের ১৬ অক্টোবর চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবে বেইজিংয়ের গ্রেট হলে। ওই কংগ্রেসে সারা দেশ থেকে ২৩০০ ডেলিগেট অংশগ্রহণ করবেন। কংগ্রেসে চীনের ৬৯ বছর বয়সী বর্তমান প্রেসিডেন্ট শিয়ের তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হওয়া প্রায় নিশ্চিত। এমন সম্ভাবনায় প্রেসিডেন্ট শিয়ের বিরোধীরা সন্তুষ্ট নয়। ফলে সম্মেলনকে সামনে রেখে চীনের প্রেসিডেন্ট শিয়ের সপ্তাহব্যাপী অনুপস্থিতি একই সাথে সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ফ্লাইট বাতিল ও রাজধানী বেইজিং মুখে সামরিক কনভয়ের যাত্রার সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় সব ঘটনা মিলে চীনে সামরিক অভ্যুত্থান ও প্রেসিডেন্ট শিকে গৃহবন্দি করার সংবাদ অনেকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবেও তাই গুরুত্ব পায়। আলজাজিরা, সিএনএনয়ের মতো গণমাধ্যমে ওই বিষয় সংবাদ ও বিশ্লেষণ প্রকাশ থেকে তা বোঝা যায়।

তবে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ রোজ মঙ্গলবার চীনের প্রেসিডেন্ট শি জনসম্মুখে আসেন। তিনি ওই দিন সেনাপ্রধান জেনারেল লি কুয়ানিং ও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরো সদস্যদের নিয়ে বেইজিংয়ের প্রদর্শনী হলে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি আয়োজিত একটি প্রদর্শনী পরিদর্শন করেন। প্রেসিডেন্ট শিয়ের বিরোধীরা সেনাপ্রধান জেনারেল লি কুয়ানিংয়ের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান হয়েছে বলে প্রচার করে। ওই দিন প্রদর্শনী হলে প্রেসিডেন্ট শিয়ের সাথে জেনারেল লিও উপস্থিত ছিলেন। ফলে চীনে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে বলে যারা প্রচার করেছিল তারা ব্যাকফুটে চলে যায়। ওই প্রচার-প্রচারণা যে গুজব ছিল তা প্রমাণিত হয়।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, চীনের সামরিক অভ্যুত্থানের ওই গুজব কেন হটকেকে পরিণত হয়? এক্ষেত্রে বলা যায়, চীনে গণমাধ্যমের ওপর কঠোর সেন্সরশিপ বলবৎ আছে। চীনের প্রেসিডেন্ট ভবনের খবর তো দূরের কথা, রাজধানী বেইজিংয়ের আকাশে পাখি ওড়ার খবর সংগ্রহ করা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। গণমাধ্যমে সেন্সরশিপের পাশাপাশি চীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ফলে চীনের অভ্যন্তরীণ খবর খুব কম অন্যরা জানতে পারে।

‘তথ্যের অপ্রাপ্ততা বাড়ায় গুজব’– চীনের সামরিক অভ্যুত্থানের খবর চাউর হওয়া আরেকবার তা প্রমাণ করেছে।

অন্যদিকে চীনের নিষিদ্ধ ঘোষিত ধর্মীয় সংগঠন গ্লোবাল ফ্যালান গ্যাং মুভমেন্টের সদস্যরা সম্মিলিতভাবে ওই গুজব প্রচার করে। ওই গ্যাংয়ের সঙ্গে যুক্ত এক সাংবাদিকই প্রথম চীনে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন। ওই গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হওয়ায় নিউ তাং ডাইনেস্টি টিভিতেও সংবাদ প্রচার করা হয়। ফলে একটি গ্রুপের সদস্যরা সম্মিলিতভাবে উপর্যুক্ত সংবাদ প্রচার করায় তা সহজে ভাইরাল হয়। ওই গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে সাংবাদিকসহ সুশীল সমাজের লোক থাকায় তা সহজে অনেকের কাছে বিশ্বাসযোগ্যও হয়।

প্রকৃতপক্ষে জিরো কোভিড নীতির কারণে চীনের প্রেসিডেন্ট শি উজবেকিস্তান থেকে ফিরে কোয়ারেন্টিনে ছিলেন। চীনের  জিরো কোভিড নীতিমালা মতে, বিদেশ থেকে ফিরলেই এক সপ্তাহ কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক। ওই কারণে ১৬ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট শি উজবেকিস্তান থেকে ফিরে এক সপ্তাহ জনসম্মুখে আসেননি। এর আগেও তিনি জুলাই মাসে এক সপ্তাহ জনসম্মুখে আসেননি। ওই সময়ও তিনি হংকং থেকে দেশে ফিরেই কোয়ারেন্টিনে চলে যান। এক সপ্তাহ পর তাকে প্রথম দেখা যায় রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে, তার চীনের পশ্চিমাঞ্চল জিনজিয়াং সফরের সংবাদে। এবারও একই ঘটনা ঘটেছে।

প্রেসিডেন্ট শিয়ের জনসম্মুখে না আসার মতো চীনের ওই সময়ে অসংখ্য ফ্লাইট বাতিলের ঘটনার সঙ্গে সামরিক অভ্যুত্থান নয়, কোভিডের সম্পর্ক রয়েছে। চীনের জিরো কোভিড নীতির কারণে প্রায় এমন অসংখ্য ফ্লাইট বাতিলের ঘটনা ঘটে। সামরিক কনভয়ও তাদের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই অন্য অঞ্চল থেকে রাজধানী বেইজিংয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সব স্বাভাবিক ঘটনাকে একত্রে গেঁথে গুজব প্রচারকারীরা কৌশলে চীনে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছে এবং ওই অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট শিকে গৃহবন্দি করা হয়েছে বলে প্রচার করে।

এক্ষেত্রে গুজব প্রচারকারীদের দায় যতটা, সমান দায় রয়েছে চীনা কর্তৃপক্ষের। তারা যদি সংবাদমাধ্যমে চীনের প্রেসিডেন্ট শিয়ের কোয়ারেন্টিনে থাকা, ছুটিতে থাকার সংবাদ গণমাধ্যমকে জানাতো, তাহলে গুজব এভাবে ডালপালা মেলে হটকেকে পরিণত হতো না।

সংবাদ প্রচারের অবাধ প্রবাহ না থাকলে গুজব প্রচারিত হয়, তা উপর্যুক্ত ঘটনায় আবারও প্রমাণিত হলো। নদীর পানির প্রবাহের অবাধ সুবিধা না থাকলে অতিরিক্ত জল কূলে প্রবেশ করবে বন্যায় রূপ নেবে এটাই স্বাভাবিক ও সত্য। তেমনি তথ্যের অবাধ প্রবাহ না থাকলে গুজব ভাইরাল হয়। চীনের মতো একটি ডিসিপ্লিন রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এমন গুজব প্রচার তেমন কোনও রাজনৈতিক-সামরিক সংকট তৈরি করেনি। কিন্তু বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে এমন গুজব যদি সত্যি কখনও ভাইরাল হয় এবং জনগণ সপ্তাহব্যাপী সত্য জানতে না পারে- তাহলে কল্পনা করা যায় কী ঘটতে পারে?

উপর্যুক্ত ঘটনা তাই বাংলাদেশসহ আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর জন্য বড় শিক্ষা। তাই বাংলাদেশসহ সব রাষ্ট্রের উচিত তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা। তথ্যের অবাধ প্রবাহ সেন্সরহীন সংবাদ প্রকাশ আপাতত সরকার বা তার পক্ষের স্বার্থবিরোধী মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে শেষ বিচারে তা একদিকে তা সরকার ও তার দলকে নানা বিপর্যয় থেকে রক্ষা করবে, অন্যদিকে রাষ্ট্রও নানা সংকট থেকে রক্ষা পাবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ