X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

‘তওবা কইরা বল খেলাটা ছাড়’!

আহসান কবির
২৮ নভেম্বর ২০২২, ১৮:২৯আপডেট : ২৮ নভেম্বর ২০২২, ১৮:৩৩

ফুটবল হলো ভুলের খেলা! যে যত কম ভুল করবে দিনশেষে সেই খেলায় জিতবে।– জোহান ক্রুইফ

বাংলা লোকগানে ফুটবল নিয়ে একটা জনপ্রিয় গান আছে যার কথা এমন– ‘হারবেইচ্চারে (পারবেইচ্চারে) বল খেলাডা তওবা কইরা ছাড়/ আমি তোরে না করতাছি পাগলও ছত্তার!... বাইশ জনে একটা বল লইয়া/বড় একটা মাঠে গিয়া/ দৌড়াদৌড়ি ক্যার লাগিয়া/এইডা কী ব্যাপার/ হারবেইচ্চারে (পারবেইচ্চারে) বল খেলাডা তওবা কইরা ছাড়…’– গানটা বিশ্বকাপের মৌসুমে শুনে দেখতে পারেন। মানুষের জীবন নাকি ফুটবলের মতো। যে যারে লাথি মারে মওকা পায় যখন!

এই মওকা রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি। রাজনীতিতে যে হয় ফুটবল, লাথি খেতে খেতে তার ‘হাওয়া’ চলে যায়। হাওয়া ছাড়া ফুটবলের ঠাঁই ডাস্টবিনেও হয় না। এই ফুটবল জনগণ কিনা সেই আলোচনাতে না গিয়ে আমরা আপাতত ফুটবল নিয়ে থাকি। পৃথিবীর সব ভালো ফুটবলাররা নাকি স্বর্গে থাকে, শুধু রেফারিরা থাকে না। স্বর্গ নরকের একটা গল্পে এমন আছে।

স্বর্গ আর নরকের মধ্যে ফুটবল খেলা হবে জেনে স্বর্গের মানুষরা খুশিতে আত্মহারা। খেলা শুরু হবার পর দেখা গেলো নরকের লোকরা নাচানাচি বেশি করছে। কী ব্যাপার? স্বর্গের লোকরা জানতে পারলো রেফারিদের কেউ স্বর্গে ছিল না, তাদের ঠাঁই হয়েছিল নরকে! সবাই এমন ধারণা পোষণ করতে চান যে রেফারিরা নিরপেক্ষ থাকুক। ১৯৩৪ সালের বিশ্বকাপে সেটা ঘটেনি। ইতালি সেবার বিশ্বকাপ আয়োজন করেছিল এবং তখন ইতালি শাসন করতেন স্বৈরশাসক বেনিতো মুসোলিনি। তিনি নাকি যাচাই বাছাই করে রেফারি নিয়োগ দিয়েছিলেন। ফলাফল– ইতালি চ্যাম্পিয়ন! যদিও ২০২২ সালের বিশ্বকাপে ইতালিই নেই।

১৯৩০ সালে বিশ্বকাপের প্রথম আসরে দুর্দান্তভাবে ছিল উরুগুয়ে। বিশ্বকাপের অনেক কিছুই তখন গোলমেলে ছিল। যেমন কার আনা ফুটবলে খেলা হবে?

প্রথম বিশ্বকাপে দুই ফাইনালিস্ট দল ছিল উরুগুয়ে ও আর্জেন্টিনা। তখন অফিসিয়াল ফুটবল বলে কিছু ছিল না। তাই কোন ফুটবল দিয়ে খেলা হবে সেটা নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। সমাধান হয় এভাবে– ফার্স্ট হাফ খেলা হবে আর্জেন্টিনার বল দিয়ে আর সেকেন্ড হাফ খেলা হবে উরুগুয়ের আনা বল দিয়ে। আর্জেন্টিনা তাদের বল দিয়ে ফার্স্ট হাফে দুই গোল দিতে পেরেছিল। আর সেকেন্ড হাফে উরুগুয়ে তাদের বল দিয়ে চার গোল দিয়ে ফেলে।

প্রথম আসরের ফাইনালটা আরও একদিক থেকে আলোচনায় এসেছিল। তখন ব্যক্তিগত নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে খেলা দেখার সময় পিস্তল বা রিভলবার ব্যবহার করা যেত, গ্যালারিতে বসে পানও করা যেতো। কী মনে করে প্রথম আসরের ফাইনাল খেলায় অস্ত্র বহন নিষিদ্ধ করা হয়। ফাইনাল খেলার আগের কয়েক ঘণ্টায় স্টেডিয়ামে ঢোকার মুখে অস্ত্র জমা দিতে বলা হলে ১৬০০ পিস্তল, রিভলবার ও বন্দুক জমা পড়ে।

প্রথম বিশ্বকাপ থেকেই ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা ‘সর্বহারা’। ব্রাজিল হেরেছিল প্রথম বিশ্বকাপের প্রথম খেলায় সে সময়কার যুগোশ্লাভিয়ার কাছে আর ফাইনালে হেরেছিল আর্জেন্টিনা। সর্বহারার শিল্পিত খেলা খ্যাত ফুটবলে এখনও এই দুই দল মানুষের ভালোবাসায় বেঁচে আছে।

ব্রাজিল আর্জেন্টিনা দলের মতো ফুটবলকে সর্বহারার খেলা বলা হয় একারণে যে অনেক ফুটবলার পাওয়া যাবে যারা সর্বহারা অবস্থা থেকে শুধু ফুটবল গুণে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পেরেছিলেন। ব্রাজিলের পেলে, রোনালদো, রিভালদো, রোনালদিনহোর মতো এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন ২০২২ বিশ্বকাপের ‘বাইসাইকেল কিক’ খ্যাত রিচার্লিসন।

রিচার্লিসন যে বস্তিতে থাকতেন সেই বস্তিতে মাদক বিক্রি হতো। কোনোদিন ছেলেটা এই লাইনে হাঁটেনি। বাবা-মা’র আলাদা হওয়ার সময়ে সে দৌড়ে বাবার কাছে এসেছিল এ কারণে যে বাবা তাকে ফুটবল কিনে দিতে পারবেন। মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতো এমন একজন তার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়েছিল। আর বস্তিতে ফিরবেন না কথা দেওয়ায় রিচার্লিসনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। হৃদয় দিয়ে ফুটবলকে ভালোবেসে তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন ফুটবলের কাছেই। আজ এই মানুষটার জন্য শত কোটি টাকা বাজি ধরে ক্লাবগুলো। উপার্জনের একটা বড় অংশ তিনি ব্যয় করেছেন জনসেবায়। খেলা আছে, খেলোয়াড় আছেন অনেক, কিন্তু এমন খেলোয়াড় সহসা কি দেখা যায়?

২০২২-এর কাতার বিশ্বকাপে দুটো জিনিস দেখা যাবে না। প্রথমটা পান! প্রকাশ্যে কিংবা স্টেডিয়ামে বিয়ার, হুইস্কি, ভদকা বা ব্রান্ডি খাওয়া যাবে না। দ্বিতীয়টা সুন্দরীদের উন্মাদনা নাচ। সংক্ষিপ্ত পোশাকে চিয়ার্স গার্লদের দেখা যাবে না এই আসরে। ২০০৭ সালে ‘মিস মস্কো’ প্রতিযোগিতায় নিজেকে চিনিয়েছিলেন নাতালিয়া। পরে তিনি কিছু পর্নো ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। ২০১৮ সালে লুঝনিকি স্টেডিয়ামে তাকে চিয়ার্স করতে দেখা গিয়েছিল। তাকেও  এবার আর বিশ্বকাপে দেখা যাবে না। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়াও এই বিশ্বকাপে নেই। কী আর করা? চিয়ার্স গার্লদের দেখা না গেলেও খেলার উত্তেজনা কিংবা উন্মাদনা কোনোটারই কমতি নেই ২০২২-এর বিশ্বকাপে।

বাংলাদেশে এই উন্মাদনার কারণ ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। ভারত ও পাকিস্তান ক্রিকেট, আশি নব্বই দশকের আবাহনী বা মোহামেডানের খেলা কিংবা আওয়ামী লীগ-বিএনপি সমর্থনের মতো এই দুই দলের সমর্থকরা অন্তত চার দশক ধরে বিভাজিত। কেউ কাউকে কথা বলতে ছাড়ে না।

আত্মহত্যা, হার্টফেল কিংবা মারামারির ঘটনাও খবর হয়ে আসে। এসবের কারণ লোক দেখানোর আয়োজন। সমর্থক গোষ্ঠী বানানো, পিকনিক বা খাবার আয়োজন, দীর্ঘ পতাকা বানানো, বড় স্ক্রিনে খেলা দেখার নামে আয়োজনের সমাহার করা হলেও হৃদয় দিয়ে কয়জন ধারণ করে ফুটবল?

আর্জেন্টাইন গ্রেট লিওনেল মেসির একটা কথা জনপ্রিয় হয়েছে– ‘পা দিয়ে ফুটবল খেলা এক বিষয় আর হৃদয় দিয়ে ফুটবল খেলা অন্য বিষয়’!

ফুটবল খেলাতে কেউ নাকি নিরপেক্ষ নন। বাংলাদেশ দল বিশ্বকাপ ফুটবলে খেলছে না বলে কোনও সমষ্টিগত স্বার্থ না থাকলেও যখনই কেউ ফুটবল নিয়ে লেখেন বা খেলা দেখেন, অজান্তেই তার সমর্থন চলে যায় তার ভালো লাগা দলের প্রতি। ম্যারাডোনা যখন হাত দিয়ে গোল করেন তখন কেউ কেউ কাব্য করে বলেন ‘ঈশ্বরের হাত’। আর পেলের তুলনা পেলে নিজেই। ফুটবলের কারণে তার নামটাই বদলে গেছে। বাংলাদেশে ফুটবল উন্মাদনা এই পর্যায়ে পৌঁছেছে যে একসঙ্গে পেলে আর ম্যারাডোনাকে ভালোবাসা যাবে না। নেইমার আর মেসিকে তুলনা করা কিংবা দুজনকে ভালোবাসা যাবে না। আপনাকে বেছে নিতে হবে যেকোনও একদলকে।

বিশ্বকাপ নিয়ে কেলেঙ্কারিও আছে। বিশ্বকাপের প্রথম ট্রফি (জুলে রিমে ট্রফি) দুই-দুইবার চুরি হয়েছিল। ১৯৬৬ সালে প্রথমবার উদ্ধার করা সম্ভব হলেও দ্বিতীয়বার চুরির পরে সেটি আর পাওয়া যায়নি। ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড দলের ক্যাপ্টেন ববি মুর গ্রেফতার হন চুরির দায়ে। আর্জেন্টিনার মহাতারকা ম্যারাডোনার মাদক গ্রহণের ঘটনা কমবেশি সবাই জানেন। ১৯৯১ সালে মাদক গ্রহণের জন্য ১৫ মাস নিষিদ্ধ এবং ১৯৯৪ বিশ্বকাপে দুই ম্যাচ খেলার পর আবারও ডোপ টেস্টে ধরা পড়েন, দল থেকে বহিষ্কৃত হন।

১৯৫৪ সালের বিশ্বকাপ দুই কারণে বিখ্যাত। এবছরই জার্সিতে প্রথম নম্বর বসানো হয়। এই বছরই প্রথম টেলিভিশনে খেলা দেখানো হয়, যা আজও অব্যাহত আছে। আর ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপ ছিল অন্যরকম কেলেঙ্কারিতে ভরা। চিলি আর ইতালির ম্যাচে তুমুল মারামারি শুরু হয়, যা গ্যালারিতেও ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। এর পরে লাল আর হলুদ কার্ডের প্রচলন শুরু হয় বিশ্বকাপে। ক্রিকেটের থার্ড বা ক্যামেরা আম্পায়ারিংয়ের মতো ফুটবলেও এমন রেফারিং শুরু হয়েছে ২০১৮-এর বিশ্বকাপে। খেলোয়াড়রা চাইলে রেফারি অবশ্যই সেটা বিবেচনা করে দেখবেন।

হ্যাটট্রিকের রেকর্ড তুলনামূলক কমই হয়েছে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে ফ্রান্সের বিপক্ষে ১৯৫৮ সালে সবচেয়ে কম বয়সে হ্যাটট্রিক করেছিলেন ব্রাজিলের পেলে। বিশ্বকাপের প্রথম আসরে প্রথম হ্যাটট্রিক ম্যান যুক্তরাষ্ট্রের বার্ট পেনাডোট। সেবার আর্জেন্টিনার গুইলেমু স্তাবিলও হ্যাটট্রিক করেছিলেন। ১৯৩৮ সালে পোল্যান্ডের ইউলোমোস্কি চার গোল করেছিলেন ব্রাজিলের বিরুদ্ধে। একই খেলায় ব্রাজিলের লিওনিদাসও হ্যাটট্রিক করেছিলেন। একই খেলায় ডাবল হ্যাটট্রিকের রেকর্ড এই একটিমাত্র খেলায় রয়েছে এবং এই খেলায় ব্রাজিল জিতেছিল ৬-৫ গোলে। ১৯৯৪ সালে একাই পাঁচ গোল করেছিলেন ওলেগ সালেঙ্কো এবং এই খেলায় ৬-১ গোলে ক্যামেরুনকে হারিয়েছিল রাশিয়া। ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপের এক খেলায় ইতালির পাওলো রসি হ্যাটট্রিক করে ব্রাজিলকে হারিয়ে দিয়েছিলেন।

লেখাটা শেষ করি পরিচিত একটা কৌতুক দিয়ে।

মনোবিজ্ঞানের ক্লাস নিচ্ছেন স্যার। তিনি জানতে চাইলেন ছাত্রছাত্রীদের কাছে, ধরো একজন মানুষ সারাক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি করছে। কত কিছু যে বলছে আর হাত পা ছুড়ছে। ক্লান্ত হলে সামান্য সময়ের জন্য বেঞ্চিতে এসে বসছে। পরক্ষণেই একে ওকে ডাকাডাকি করে কত কিছু যে বলছে। বলো তো লোকটা কে হতে পারে? এক ছাত্রী উত্তর দিলো, স্যার লোকটা নির্ঘাত ফুটবল দলের কোচ!

লেখক: রম্যলেখক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা প্যাকেজ পাস
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা প্যাকেজ পাস
এক্সপ্রেসওয়েতে বাস উল্টে প্রাণ গেলো একজনের, আহত ১০
এক্সপ্রেসওয়েতে বাস উল্টে প্রাণ গেলো একজনের, আহত ১০
বেসিস নির্বাচনে ১১ পদে প্রার্থী ৩৩ জন
বেসিস নির্বাচনে ১১ পদে প্রার্থী ৩৩ জন
সিঙ্গাপুরে রডচাপায় বাংলাদেশি তরুণের মৃত্যু
সিঙ্গাপুরে রডচাপায় বাংলাদেশি তরুণের মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ