X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

নিজের মেরামত হবে কবে?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২১ ডিসেম্বর ২০২২, ১৭:৫২আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০২২, ১৭:৫২

মাত্র কয়দিন আগেই পালিত হলো সংবিধান দিবস। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয়, যা ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর (বিজয় দিবস) থেকে কার্যকর হয়। স্বাধীনতার ৫১ বছর পার করে এসে এখন ভাবনার জায়গা তৈরি হয়েছে যে বাংলাদেশের মানুষ লড়াই করে, বিজয়ী হয়ে আত্মশাসনের জন্য যে অধিকার পেয়েছিল, যে সংবিধান রচনা করেছিল, তার আলোকে অতি অল্প শতাংশ নাগরিক হতে পেরেছেন আর বাকি বড় অংশই আসলে সবকিছু থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। দেশের বহুদলীয় ব্যবস্থা, নিয়মিত নির্বাচন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, বহুস্বরের মুক্ত পরিসর কখনোই পুরোপুরি আমাদের গৌরব হয়ে উঠতে পারেনি।

আমাদের রাজনীতিতে বিভাজন খুব শানিত, তাই বিদ্বেষও স্পষ্ট। মৌলিক জাতীয় ইস্যুগুলোতে কোনও ঐক্য নেই। এবং যাদের ভূমিকার কারণে আজ এ অবস্থার সৃষ্টি তারা যখন নতুন করে রাষ্ট্র মেরামতের কথা সামনে আনে তখন রাজনৈতিক আলোচনা, বিতর্ক গতি পায় ঠিকই, তবে আশা জাগায় না।

গত সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা উপস্থাপন করেছে বিএনপি। এই মেরামত কথাটা অনেক দিন ধরেই কিছু ইউটিউবার বলে আসছেন। এবার সেটি নিজেদের করে নিলো। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া একসময় ভিশন ২০৩০ নামে কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন, তখন এই রাষ্ট্র মেরামত কথাটি ছিল না, তবে সেই আলোকেই এবারের মেরামত করার ২৭ দফা এসেছে বলে বিএনপি জানিয়েছে।

প্রাথমিক যেসব প্রতিক্রিয়া এসেছে তাতে অনেকেই বলছেন ২৭টি দফা আছে, কিন্তু তেমন কোনও নতুনত্ব নেই। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বই এমন। তারা সত্যই মনে করেন কিনা যে নাগরিকরাই প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী, তারা মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে সেই ক্ষমতার অছিমাত্র? সেই বোধ অন্তরে থাকলে প্রতি মুহূর্তে নাগরিকদের ওপর দাপট দেখাতে তৎপর হতেন না। এই দাপটই একসময় সাধারণ মানুষের ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপদ্রব ও অত্যাচার হয়ে দেখা দেয়।

বিএনপি যখন রাষ্ট্রকে গণতন্ত্রায়নের পথে নিতে মেরামতের কথা বলে, তখন নিজের মেরামতের প্রসঙ্গটি আসে কিনা সেটি একটি বড় জিজ্ঞাসা। দলের ভেতরে গণতন্ত্র চর্চা কতটুকু হয়, সেটি এক বড় প্রশ্ন। দলটির কাঠামো এবং গঠনতন্ত্র এমনই যে এখানে দলের প্রধানই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা কোম্পানির মতো তিনি যে কাউকে যখন তখন দল থেকে বের করে দিতে পারেন, যখন তখন যে কাউকে দলের যেকোনও পদ পদবি দিয়ে দিতে পারেন। তাই যখন দুইবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি থাকতে পারবে না বলছে, তখন দেখা দরকার যে নিজেরা কোন জায়গায় অবস্থান করছে। এ দেশের রাজনীতির বাস্তবতা হলো বিরোধী দলে থাকতে রাজনীতিবিদরা ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা বলেন, তবে নিজেদের বেলায় তা মানেন না। বলেন গণতন্ত্র, সুশাসন ও সহিষ্ণুতার কথা, কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে তাঁরা বেমালুম ভুলে যান।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার যে কথা এখন বলা হচ্ছে, সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেটি আর থাকেনি। পুরো সংসদীয় পদ্ধতিকে প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রিক করেছিল বেগম খালেদা জিয়ার সরকারই। ওই সময় প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দিয়ে প্রায় রাষ্ট্রপতি শাসিত সিস্টেমের প্রধানমন্ত্রীর শাসন কায়েম করেছিল ।

রেইনবো নেশনের যে ধারণা উপস্থাপন করা হয়েছে তা পরিষ্কার নয়। এর মধ্য দিয়ে কি জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করার কোনও উদ্দেশ্য আছে? বিষয়টি পরিষ্কার করা প্রয়োজন। রাষ্ট্র মেরামতের প্রস্তাবে বিএনপি যে ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার স্লোগানটি সংযুক্ত করেছে সেটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দেশের ভূখণ্ডে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হবে না বলে যে অঙ্গীকার করেছে, সেটি বলার আগে স্বীকার করে নেওয়া ভালো এই দলটির আমলেই বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানানো হয়েছে। বিএনপির আমলেই ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের পুরো নেতৃত্বকে নির্মূল করার চেষ্টা হয়েছে। কোথায় সরকার বিচার করবে, তা না করে বিচারের নামে জজ মিয়া নাটক মঞ্চস্থ করেছে। রাষ্ট্র মেরামতের প্রতিশ্রুতির আগে এই বিষয়গুলোতে নিজের অবস্থান সমাধান করে আসতে হবে বিএনপিকে। হরকাতুল জেহাদ ও জেএমবির মতো জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে দলের অনেক পরিচিত নেতার সখ্যও ব্যাপক আলোচিত।

বিএনপির রূপরেখায় জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছে। কাদের নিয়ে এই জাতীয় ঐকমত্য বা জাতীয় সরকার হবে সেটিও স্বচ্ছ করা প্রয়োজন। এখন সরকারের বিরুদ্ধে যেসব রাজনৈতিক দল আন্দোলন করছে, তাদের নিয়ে যদি হয় তাহলে সেটি কল্পনা ছাড়া কিছু নয়।

রূপরেখায় অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন গঠন, নির্বাচন কমিশন আইন সংশোধন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি, জুডিসিয়াল কমিশন গঠন, দেশীয় জ্বালানি সম্পদ অনুসন্ধান, ন্যায়পাল নিয়োগ, ধনী ও দরিদ্রের বৈষম্য কমানো, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো, শিক্ষার মানোন্নয়ন ও স্বাস্থ্যসেবার বাজেট বৃদ্ধি, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের তালিকা তৈরি করার যেসব প্রস্তাব এসেছে এগুলোকে নির্বাচনি ম্যানিফেস্টো বলে মনে হয়েছে। আর এ দেশে নির্বাচনি ম্যানিফেস্টো মানেই ভুলে যাওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতি দেওয়া।

তবে কেউ অস্বীকার করবে না যে দেশের রাজনৈতিক সংকট সমাধান করতে হলে শাসনব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। কিন্তু সেটি করতে হলে যার যার কৃতকর্মের দায় স্বীকার করতে হবে সবার আগে। এবং নিজেদের মেরামত করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে সক্রিয়ভাবে।

লেখক: সাংবাদিক

 

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
ঈদে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে চলবে ১৫ ফেরি, ২০ লঞ্চ
ঈদে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে চলবে ১৫ ফেরি, ২০ লঞ্চ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ