X
শনিবার, ১১ মে ২০২৪
২৮ বৈশাখ ১৪৩১

শৈত্যপ্রবাহ এবং দরিদ্রের বিড়ম্বনা

ফেরদাউস আরা বেগম
১৭ জানুয়ারি ২০২৩, ১৮:৩৯আপডেট : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৮:০৮

এই ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতেও সবাই বলছিলাম এ বছর শীত একেবারেই পড়বে না, জলবায়ু পরিবর্তনের এটাও আরেকটি রূপ। এর পেছনে কোনও বৈজ্ঞানিক কারণ কীভাবে স্থাপিত হবে তা ঠিক আমরা সবাই জানি না কিন্তু বলেছি। বিশেষজ্ঞদের মতে শীতের প্রকোপ হ্রাস পাওয়ার অন্যতম কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি। একইসঙ্গে কোনও কোনও দেশের অতি শিল্পায়নের ফলে জলবায়ুর এ ধরনের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এখন অবশ্য যেকোনও আবহাওয়া জনিত  দুর্যোগ আমরা জলবায়ু পরিবর্তন বলে সহজেই সিদ্ধান্ত দেই। তবে এর প্রকোপ বাড়তে থাকার ফলে আমাদের কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে এবং কীভাবে তৈরি হতে হবে তা নিয়ে কতটুকু বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ রয়েছে– সেসব নিয়ে জানা যায় না।

ইদানীং জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বিষয় আলোচনায় সবচেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে এতে সন্দেহ নেই। কপ-২৭-এর পর আবার কপ-২৮-এর আলোচনা শুরু হয়েছে, যেখানে ‘লস  অ্যান্ড ড্যামেজ’-এর বিষয়টি এবং ফান্ডের কথা বারবার বেশি করে আলোচিত হবে সন্দেহ নেই। যা হোক, দরিদ্রের বিড়ম্বনা আছে এবং থেকেই যাবে, এ নিয়ে কোনও উত্তর পাওয়া বেশ কঠিন। এই  ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ থেকে বা এর থেকে যে তহবিল আসবে তা অতি দরিদ্রের জন্য কীভাবে সহায়ক হবে এবং কী মডেল তৈরি এবং কাজ করবে তা আমাদের জানা নেই।

এবার শীত নেই নেই করেও জানুয়ারির প্রথম থেকে শীত বেশ জেঁকে বসেছে। অফিসে  আসা-যাওয়ার পথে  দরিদ্র মানুষকে খড়কুটো দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে শীত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টাও করতে দেখা যাচ্ছে। এ সেদিন ডেইলি স্টারের প্রথম পাতায় ছবিটি সবার মন কেড়েছে, এক দরিদ্র মহিলা তার নিজের কম্বলটি একটি পাশে থাকা কুকুরের সঙ্গে ভাগাভাগি করে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে। পশু-পাখি, গবাদিপশুও শীতে কষ্ট পায়, সেটাও একটা বড় বিবেচ্য। কারণ, আমরা নিজেদের থাকা-খাওয়ার জন্য আরামের ব্যবস্থা করলেও গৃহপালিত গবাদিপশুর জন্য তেমন চিন্তা করি না, তবে এরা কিন্তু সর্বদা মালিকের কল্যাণের কথাই চিন্তা করে। গ্রামগঞ্জে গৃহপালিত পশুদেরও কাপড় দেওয়ার ছবি অবশ্য গণমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে।

উত্তর গোলার্ধে শীত শুরুর কথা ডিসেম্বরের ২১ তারিখ থেকে। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি– এ তিন মাস শীত বলেই জানি। শীতের দক্ষিণায়ন অর্থাৎ শীতের শুরু যখন সূর্যের সর্বনিম্ন অবস্থান পরিলক্ষিত হয় বা নিম্নাভিমুখী ঝোঁকে। আবহাওয়া পরিদফতর অবশ্য ডিসেম্বরের শেষে শীত ঘনীভূত হবে বলে আগেই আভাস দিয়েছিল। তবে গরিবের প্রস্তুতির তেমন কিছু নেই, তাদের মতে, সবার যা হবে আমাদেরও তা-ই হবে।

বাসার কাজের বুয়া রোজ সকাল ছয়টায় এসে কলিং বেল চাপে। জিজ্ঞেস করি কীভাবে চলেছে? বলে, পেট তো চালাতে হবে, শীত বলে বাসায় বসে থাকলে কি আমাদের চলে। তার অভিজ্ঞতায়, রাতে টিনের চালে শিশির জমে ঠান্ডা হয়ে টুপটাপ করে বৃষ্টির ফোঁটার মতো কাঁথা কম্বলের ওপর পড়ে। জানতে চাইলাম এতে তো খুবই কষ্ট, সে জানালো সবারই একই সমস্যা, তাই সবার মতো আমাদেরও অপেক্ষা করতে হবে কবে শীত কমবে।

একদিন কাজের বুয়া কামাই দিলে আমাদের চলে না কিন্তু এরা কতটা সুবিধাবঞ্চিত। কবে এদের মাথায় একটি ছাদ হবে, সবাই এ সমস্যা থেকে রেহাই পাবে তার কোনও নিশ্চয়তা আমরা দিতে পারি না। সামাজিক সেফটি নেটের ব্যাপারে ব্যাপক আলোচনা হয়, এ বিষয়টি কি আমরা মাথায় রাখি।

এ ছাড়া ফুটপাত, রেলস্টেশন, রাস্তার কোণে বৃদ্ধ বয়সী সুবিধাবঞ্চিত মানুষ অত্যন্ত কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। ইতোমধ্যে অবশ্য কম্বল বিতরণ শুরু হয়েছে, বিত্তবানরা এগিয়ে এসেছেন শীতের গরম কাপড় বিতরণের জন্য।

হাসপাতালের চিকিৎসকদের কাছ থেকে জানা গেলো ঠান্ডা জনিত রোগের প্রকোপ বেড়েছে, যাদের অ্যাজমা, কাশি আগেই ছিল তাদের তো কথাই নেই। গরিবের অতি শীতেও জালা আবার অতি তাপদাহেও জ্বালা।

জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু এই জাঁকিয়ে বসা শীত, আবহাওয়া অধিদফতরের মতে শৈত্যপ্রবাহ আরও কিছু দিন থাকবে। যদিও শৈত্যপ্রবাহ মানে তাপমাত্রা ৬-১০ বা এরকম কিছু, তবে এখনকার তাপমাত্রা এতটাও কম নয়। এ সময়টি বড়লোকদের জন্য বেশ আরামদায়ক। তারা বাড়তি পোশাক ব্যবহারের সুযোগ পায়। দোকান মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তাদের গরম কাপড়ের বিক্রি বাড়তির দিকে, দামও বেশ ভালো। তবে অতি দরিদ্র এই কাপড় ক্রয়ে ততটা সক্ষম নয়। সূর্যের আলোই তাদের ভরসা। এ বাড়তি সমস্যা যদিও সাময়িক তবে বেশ কিছু জনগোষ্ঠী রয়েছে, যারা যেকোনও আবহাওয়া জনিত সমস্যায় দুর্বল।

সারা দেশের তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে প্রায় ৯-১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার কিছু কম ও বেশি। টেকনাফে সর্বাধিক তাপমাত্রা দেখানো হয় ২৮ ডিগ্রি, তবে রাতের তাপমাত্রা অনেকটা কমে যায়। কোল্ড ওয়েভ সর্বাধিক দেখা যায় উত্তর, উত্তর-দক্ষিণ এবং উত্তর-পূর্ব অংশে, তাদের দুর্ভোগও তাই অনেকটা বেশি।

পুরো গত সপ্তাহ আমাকে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে অফিস যাতায়াত করতে হয়েছে, খুব কাছ থেকে শীতকে উপলব্ধি করলাম। রাস্তাঘাটে যানজট ব্যাপক অর্থাৎ বাস, ট্রাক, সিএনজি, অটো, ঠেলা, প্রাইভেট গাড়ি, মেট্রো সব ঠিকঠাক চলছে, অর্থাৎ কেউ শীত বলে ঘরে বসে নেই। ব্যাপক পরিমাণে ফেরিওয়ালা, ভিক্ষুক, রিকশা সবই আছে, সে সঙ্গে পুলিশ বাহিনীর সদস্য তৎপর রয়েছে। তবে একটা জিনিস চোখে পড়ার মতো– তা হলো সিএনজি চালক কিন্তু যথেষ্ট সজাগ তার বেশ-ভূষায়, গায়ে কোট, মাফলার, পায়ে স্যান্ডেল, মাথায়  টুপিও আছে। সে মোবাইলে দ্রুত কথাও বলছে পরিচিত জনের কাছে। শীত বলে একটু বাড়তি পয়সাও নিচ্ছে।

অর্থাৎ তারা এখন এগুলো ব্যবহারে সক্ষম। মনে মনে আনন্দ পেলাম এটা ভেবে যে আমাদের প্রধান তিনটি সাংবিধানিক চাহিদা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের অন্তত একটিতে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পেরেছি। রিকশাওয়ালার ক্ষেত্রেও বিষয়টি অনেকটা সত্যি, তবে একেবারে খোলা আকাশের নিচে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় তার যে কষ্ট হয় এতে সন্দেহ নেই। দু’-একজনের সঙ্গে কথা হয়েছে, তাদের আয় রোজগার খুব একটা কমে যায়নি। কারণ, অফিস ফেরত মানুষের কমতি নেই, যে যেভাবে পেরেছেন যানবাহন ম্যানেজ করে অফিসে যাতায়াত করছেন।

বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত। ২০৪১ সালে আমরা উন্নত দেশের স্বপ্ন দেখছি। মাথাপিছু আয় বেড়েছে কিন্তু অসমতা বেড়েছে বেশি,  আগে ওপরের দিকের পাঁচ ভাগের আয় ছিল মোট আয়ের পঁচিশ ভাগের মতো। এখন তা বেড়েছে, কোনও কোনও জায়গায় বলা হয়েছে তা এখন প্রায় ২৮ ভাগের মতো। অর্থাৎ সবাই উন্নয়নের অংশীদার হতে পারছে না। এ অবস্থার উত্তরণ দরকার।

বাংলাদেশ লেবার  ফোরস সার্ভে ২০১৬-১৭ অনুযায়ী  নিজস্ব অ্যাকাউন্ট কর্মী প্রায় ৪৪.৩১%। ইকোনমিক রিভিউ ২০২২ অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে জনসংখ্যা ৬.৩৫ কোটি। অর্থাৎ প্রায় তিন কোটির মতো জনগোষ্ঠী এর মধ্য পড়ে, যারা নিজেই নিজের মতো করে আয় করেন পরিবার পরিচালনার জন্য। যাদের জন্য তেমন সুরক্ষার ব্যবস্থা নেই। এদের সবার অবস্থা অবশ্য একই রকম নয়, তবে এদের মধ্য কারা কীভাবে আছে তার পরিসংখ্যান নেই। বিবিএস-এর তথ্য অনুযায়ী কর্মে নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় আড়াই কোটি। বাকিদের মধ্য রয়েছে কর্মদানকারী প্রায় ৪.৪৫%  অর্থাৎ এমপ্লয়ার,  পরিবারে আনপেইড  সহায়তাকারী প্রায় ১১.৫%  এবং অন্যান্য প্রায় ০.৬৫%। বিবিএসের ইকোনমিক ইন্ডিকেটর অনুযায়ী একটি বিশেষ সংখ্যক ওন অ্যাকাউন্ট ওয়ার্কার, যাদের মধ্য ব্যাপক সংখ্যক ইনফরমাল ওয়ার্কার রয়েছে। এদের গণনার মধ্য নিয়ে আসা দুষ্কর।

স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির একটি বড় উপকরণ, বাংলাদেশের লেবার প্রোডাক্টিভিটি অনেক দেশের তুলনায় কম। দরিদ্র লোকের মধ্য অসুস্থতা একটি বড় সমস্যা, তারা যা আয় করেন তার একটা বড় অংশ রোগবালাই সারাতে ব্যয় হয়ে যায়, পুষ্টিকর খাদ্য তো অনেকটা বিলাসিতা। এই শ্রেণির লোক অল্প বয়সেই কর্মক্ষমতা হারিয়ে পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এতে কর্মক্ষম ব্যক্তির ওপর বেশি চাপ পড়ে। এটি একটি জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে অন্নের সঙ্গে সঙ্গে বাসস্থানের যুগোপযোগী সমাধান এখনই দরকার।

শীত এলে আমাদের কিছুটা আনন্দ অনুভূতি, বিয়েশাদি, অনুষ্ঠান বেড়ে যায়। শীত মানে গুড়ের গন্ধ, পিঠা পুলির আয়োজন, অনেক ক্ষেত্রে এটি একটি নতুন আয়ের উৎস। পৌষের নবান্নের কথা আমাদের ঘরে ঘরে প্রচলিত। সবকিছুর মধ্য ভালো-মন্দ দুটোর মিশ্রণ চিরন্তন সত্য। তবে শীতের কষ্টে বা শৈত্যপ্রবাহে মানুষ মারা যায় এটাও সত্য। আমরা সবাই ভালো থাকতে পারি, আমাদের উন্নয়ন মডেল যাতে সেদিকটি লক্ষ রেখে প্রণীত হয়।

লেখক: সিইও, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভক্তকে অটোগ্রাফ দেওয়ার সময় জোকোভিচের মাথায় বোতলের আঘাত
ভক্তকে অটোগ্রাফ দেওয়ার সময় জোকোভিচের মাথায় বোতলের আঘাত
এবারও চালু হচ্ছে ‘ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন’, ঢাকায় আম আনতে খরচ কত?
এবারও চালু হচ্ছে ‘ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন’, ঢাকায় আম আনতে খরচ কত?
হায়দার আকবর খান রনোর মৃত্যুতে ওবায়দুল কাদেরের শোক
হায়দার আকবর খান রনোর মৃত্যুতে ওবায়দুল কাদেরের শোক
রাজধানীর খালে-ড্রেনে কী ফেলা হচ্ছে, দেখানোর আয়োজন করেছে ডিএনসিসি
রাজধানীর খালে-ড্রেনে কী ফেলা হচ্ছে, দেখানোর আয়োজন করেছে ডিএনসিসি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ