X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাংলা একাডেমির ‘আদর্শ’

শেরিফ আল সায়ার
১৯ জানুয়ারি ২০২৩, ১৫:৪৮আপডেট : ১৯ জানুয়ারি ২০২৩, ১৭:৩২

একটু পেছনে ফিরি। ২০১৩ সালে ৮৪ জন ব্লগারের একটা তালিকা করা হয়। এই তালিকা হেফাজতের হাত হয়ে সরকারের কাছে আসে। তারপর কিছু গণমাধ্যম প্রকাশ করলে তোলপাড় শুরু হয়। এর জের ধরে তিন জন ব্লগারকে আটকও করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরবর্তী সময়ে ৮৪ জনের ওই তালিকা ধরেই জঙ্গিরা কিলিং মিশন শুরু করে। যারা ব্লগ জগতের সঙ্গে জড়িত তাদের অনেকেই এখনও মনে করেন, ৮৪ জনের ওই তালিকা তৈরির পেছনে ছিল খোদ কিছু ব্লগারই, হেফাজত কিংবা সরকারের কেউ নয়। তাহলে তালিকা তৈরির নেপথ্যে কারা—এই প্রশ্ন আজও আছে। এই প্রসঙ্গটি কেন তুললাম সেই জায়গায় পরে আসছি।  

এ বছর বইমেলায় প্রকাশনী সংস্থা আদর্শ স্টল পায়নি। এটি নিয়ে বাংলা একাডেমি আনুষ্ঠানিক কোনও বিবৃতি দেয়নি। তবে যেটা অভিযোগ উঠেছে–তাদের প্রকাশিত তিনটি বইয়ে সরকারের সমালোচনা করা হয়েছে। অর্থাৎ বাংলা একাডেমি যেটাকে বলছে ‘সরকারবিরোধী’ কিংবা ‘ভিন্নমত’। প্রকাশনী সংস্থা আদর্শ তাদের অফিসিয়াল ফেসবুকে বলেছে, ‘কয়েকজন প্রকাশক বাংলা একাডেমিতে আদর্শ থেকে প্রকাশিত ৩টি বইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। বইগুলোতে নাকি ভিন্নমতের বক্তব্য রয়েছে। তাদের এই অভিযোগের কারণে বাংলা একাডেমি আদর্শর স্টল স্থগিত করেছে।’  

আদর্শের সঙ্গে এমন ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও ২০১৯ সালে বইমেলায় তাদের স্টল আটকে দিয়েছিল বাংলা একাডেমি। তখন প্রকাশনা সংস্থার প্রধান নির্বাহী মাহাবুবুর রাহমান আমাকে জানিয়েছিলেন, অন্য একটি প্রকাশনী সংস্থা বাংলা একাডেমিতে তার ব্যক্তিগত কিছু ফেসবুক স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশটের প্রিন্ট কপি জমা দেয়। স্ট্যাটাসগুলোর কারণে বইমেলায় তাকে স্টল দেওয়া হয়নি। বারবার কেন কিছু প্রকাশক আদর্শ’র বিরুদ্ধে অভিযোগ দিচ্ছে—এই প্রশ্ন আসতেই পারে। তবে সাদা চোখে দেখলে এটা যে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব, সেটা পরিষ্কার।

এবার আগের জায়গায় আসি, ব্লগারদের হিটলিস্ট তৈরি করে দিয়েছিল ব্লগারদের ভেতরেরই মানুষ। একইভাবে একটি প্রকাশনা সংস্থাকে আটকে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে এই প্রকাশনা জগতেরই কিছু মানুষ। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, যেসব ব্লগার ৮৪ জনের তালিকা বানিয়ে খুব আনন্দবোধ করেছিলেন, আক্ষরিক অর্থে কয়েক বছরের মধ্যে তারাও নিশ্চিতভাবে জঙ্গি হামলার ভয়ে দিন-রাত কাটিয়েছেন। কারণ, ওই তালিকা ধরে যখন জঙ্গিদের কিলিং মিশন শুরু হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই ‘ব্লগার’ হওয়াটাই হয়ে পড়ে আতঙ্কের।

একইভাবে সরকারকে ‘খুশি’ করার বাহানায় নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থে অন্য সহকর্মীকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার যে চেষ্টা– সেটাও পুরো প্রকাশনা জগতে বড় ধরনের ধাক্কা দেবে ভবিষ্যতে। যে ফাঁদ অন্যের জন্যে করা হচ্ছে, সেই ফাঁদে একদিন নিজেদেরও পড়তে হবে।

এসব বিষয় নিয়ে বাংলা একাডেমিকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।

প্রথম প্রশ্ন হলো– সরকারের কোনও বিষয় নিয়ে সমালোচনা করা কি অপরাধ?

দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো– বাংলা একাডেমির কোন আইনে আছে সরকারের সমালোচনা থাকলে কোনও বই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত বইমেলায় রাখা যাবে না?

তৃতীয় প্রশ্ন হলো– বাংলা একাডেমিকে কি সরকার দায়িত্ব দিয়েছে কোন কোন বইয়ের কনটেন্টে সরকারের সমালোচনা আছে সেটা বের করার?

শেষ প্রশ্ন হলো– যে বইগুলোর কারণে আদর্শকে স্টল দেওয়া হয়নি, সেই বইগুলো কি নিষিদ্ধ করা হয়েছে?

অবশ্য বাংলা একাডেমির জন্য এসব নতুন কোনও বিষয় নয়। বাংলা একাডেমি এর আগেও ২০১৬ সালে শ্রাবণ প্রকাশনীকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছিল, যদিও প্রবল চাপের মুখে পরে তারা সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। তার আগে ২০১৫ সালে হেফাজতে ইসলাম রোদেলা প্রকাশনীর একটি বই নিয়ে আপত্তি জানায়। বাংলা একাডেমি ত্বরিত সেই প্রকাশনী সংস্থার স্টলই বন্ধ করে দেয়।  

অনেকে ভাবতে পারেন বাংলা একাডেমি কেন এমন আচরণ করে? এটা আসলে বাংলা একাডেমির একার দোষ নয়। সমাজে গত কয়েক বছরে এক ধরনের ক্ষমতাবান শ্রেণি তৈরি হয়েছে, যারা সর্বক্ষণ নিজের ক্ষমতা দেখানোর জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। আবার এই শ্রেণির আশপাশে একটা তোষামোদ শ্রেণিও গড়ে ওঠে। যারা সহমতের বন্যায় ভাসছে।

এদের মধ্যেই গড়ে উঠেছে ‘পুলিশিং মানসিকতা’। কে কী স্ট্যাটাস দিলো, কে কোথায় কী বক্তব্য দিলো, কোন বইয়ে কী লিখলো- এসব দেখাই তাদের কাজ। নিজের মতের সঙ্গে না মিললে জামায়াত-বিএনপি বানানোর রাজনীতিও আমরা দেখেছি, দেখছি। এদের অধিকাংশের মূল টার্গেট থাকে নানান সুযোগ-সুবিধার আশা কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করা।

এই স্বার্থবাজ শ্রেণিটির আধিপত্য এখন সমাজকে ক্ষয় করে চলেছে। এদের কেউ কিছু বলতেও ভয় পায়। বাংলা একাডেমির কাছে কে কোন অভিযোগ করলো সেটা বড় বিষয় নয়। অভিযোগ তারা কতটা আমলে নেবে সেটাই দেখার বিষয়। বাংলা একাডেমির মতো একটা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান একটা বইয়ে সরকারের সমালোচনা করা হয়েছে, এমন অদ্ভুত যুক্তিতে একটি প্রতিষ্ঠানের স্টল বরাদ্দ কীভাবে স্থগিত করতে পারে?  তার মানে কি যেসব প্রকাশক আদর্শের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তারা বাংলা একাডেমি থেকে বড় হয়ে উঠেছে?

বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানকে যদি বোঝাতে হয় সরকারবিরোধী আর রাষ্ট্রবিরোধী এক বিষয় নয়– তখন সেখানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্ববোধ নিয়েও প্রশ্ন করা উচিত। কারণ, তাদের এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ বরং সরকারের অনেক ভালো কাজকেও ম্লান করে দেয়। সরকার নিশ্চয়ই বলেনি আমার বিরুদ্ধে কেউ কিছু লিখলে তাকে বইমেলায় স্টল দেওয়া যাবে না।

বাংলা একাডেমির আদর্শ হওয়ার কথা ছিল বাকস্বাধীনতার পক্ষে লড়াই করা। বাংলা একাডেমির আদর্শ কি কতিপয় কিছু অসৎ লোকের ব্যবসায়িক স্বার্থকে দেখা, নাকি সহমতের বন্যায় নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়া?

লেখক: হেড অব রিসার্চ অ্যান্ড প্ল্যানিং, বাংলা ট্রিবিউন

/এমওএফ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ