X
মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪
২৪ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তচিন্তায় হাতকড়া, মুক্তচিন্তার রিমান্ড

প্রভাষ আমিন
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১৩:০৩আপডেট : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১৩:২৮

Probhash Aminশেষ পর্যন্ত কি মৌলবাদী জঙ্গিদেরই জয় হবে? জঙ্গিরা রীতিমত তালিকা করে মুক্তচিন্তার লেখক-প্রকাশক-ব্লগারদের ওপর হামলা করছে, তাদের হত্যা করছে। একের পর এক এই হামলার মূল উদ্দেশ্য- ভয় দেখিয়ে মুক্তচিন্তাকে রুদ্ধ করা। আমি নিশ্চিত জানি ভয় দেখিয়ে কখনওই মুক্তচিন্তাকে রুদ্ধ করা যায়নি, যাবেও না।
কিন্তু প্রাথমিকভাবে জঙ্গিরা কিছুটা হলেও সফল। আমি জানি এবারের মেলায় প্রকাশকরা অনেক সাবধান ছিলেন, গতবছরের তুলনায় এ বছর মেলায় মুক্তচিন্তার বই অনেক কম প্রকাশিত হয়েছে। আর জঙ্গিদের সাফল্যের ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে ‘ইসলাম বিতর্ক’ বই নিষিদ্ধ এবং ‘ব-দ্বীপ প্রকাশনী’র স্টল বন্ধ করার মধ্য দিয়ে। শুধু তাই নয়, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে করা মামলায় প্রবীণ রাজনীতিক, লেখক ও ব-দ্বীপ প্রকাশনীর মালিক শামসুজ্জোহা মানিক, তার ভাই শামসুল আলম এবং বইটির ছাপা প্রতিষ্ঠান শব্দকলি প্রিন্টার্সের মালিক ফকির তসলিমকেও রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। 
তাদের দাগী আসামীর মতো হাতকড়া পরিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। তাদের হাতে হাতকড়া দেখে ভয়ের একটা ঠাণ্ঠা স্রোত, ক্ষোভের একটা তীব্র জ্বালা বয়ে যায় শরীরে। মুক্তচিন্তার হাতেই বুঝি হাতকড়া, মুক্তচিন্তাই বুঝি আজ রিমান্ডে।
বাংলাদেশে মুক্তচিন্তাকে অনেকে ইসলাম বিরোধিতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। আর এই ভুল ধারণাই সব নষ্টের গোড়া। সভ্য মানুষ, শিক্ষিত মানুষ, জ্ঞানী মানুষ প্রশ্ন করবেই। প্রশ্ন থেকেই জ্ঞান, জ্ঞান থেকেই সভ্যতা। তাই মানুষ প্রশ্ন করবে নানা বিষয় নিয়ে। মত প্রকাশ করা, চিন্তা প্রকাশ করা, মানুষের মৌলিক অধিকার, মানুষের বিবেকের স্বাধীনতা। তাই তারা সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন করে। সেই প্রশ্নগুলো কখনও ঠিক, কখনও ভুল, কখনও যৌক্তিক, কখনও হয়তো অযৌক্তিক। একসময় তো মানুষ বিশ্বাস করতো সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে। সেই বিশ্বাসও তো ভুল ছিল। তবে আমি সবসময়ই বিশ্বাস করি, আমার স্বাধীনতা আরেকজনের নাক পর্যন্ত। আমার কোনও লেখা যেন বৃহৎ জনগোষ্ঠির অনুভূতিতে আঘাত না করে। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে আমরা আগেও কথা বলেছি। আমরা জানি এই আইনের অপব্যবহার সম্ভব এবং হবে। কারণ সব লেখাই কারও না কারও অনুভূতিতে আঘাত করবে। রাজনীতি কিছু লিখলেই হয় আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির অনুভূতিতে আঘাত লাগবে। ধর্ম নিয়ে কিছু লিখলেও কারও না কারও অনুভূতিতে আঘাত লাগবে। কারণ ইসলামে নানা মত ও পথ আছে। কেউ মিলাদ পড়ে, কেউ পড়ে না; কেউ মাজারে যায়, কেউ যায় না। একপক্ষ আরেক পক্ষকে মুরতাদ ঘোষণা করে। তো আপনি সত্যি কথা লিখলেও মুরতাদ হয়ে যেতে পারেন। তাই রাষ্ট্রের উচিত সতর্কতার সঙ্গে স্পর্শকাতর বিষয়গুলো বিবেচনা করে বিচার করা।

লেখার জবাব জঙ্গিরা দেয় চাপাতি দিয়ে, রাষ্ট্র দেয় রিমান্ড দিয়ে।

হুটহাট কথায় কথায় বই নিষিদ্ধ করা, স্টল বন্ধ করা, লেখক-প্রকাশকদের হাতকড়া লাগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় মৌলবাদী জঙ্গিদের চিন্তার ছাপ আছে; কোনও দায়িত্বশীল রাষ্ট্রের আচরণ নয় এটি। লেখার জবাব জঙ্গিরা দেয় চাপাতি দিয়ে, রাষ্ট্র দেয় রিমান্ড দিয়ে। দুয়ের মধ্যে তফাৎ কী তবে? যে রাষ্ট্রে প্রশ্ন করা যায় না, সে রাষ্ট্র মৃত বা মৃতবৎ। প্রশ্ন-উত্তর, যুক্তি-পাল্টা যুক্তি, তর্ক-বিতর্ক দিয়েই এগিয়ে যাবে সমাজ, দেশ, সভ্যতা।

‘ইসলাম বিতর্ক’ বইটিতে কী আছে আমি জানি না। এই বইটির লেখা যার বা যাদের অনুভূতিতে আঘাত করেছে তিনি বা তারা আরেকটি বই লিখে এর জবাব দিতে পারতেন। ইসলামের পক্ষে লেখার জন্য নিশ্চয়ই যুক্তির অভাব হতো না। কথায় কথায় যাদের অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়, আমি বিশ্বাস করি তাদের ঈমান দুর্বল। ইসলাম অত ঠুনকো নয় যে কোথাকার কারও কথাতে তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

একুশের বইমেলা বাঙালির সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। লেখক-পাঠকদের চমৎকার এই মিলনমেলাকে ঘিরে গড়ে উঠছে বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প। বইমেলাকে ঘিরেই বিকশিত হয় আমাদের সৃজনশীলতা, চিন্তা। কিন্তু এই বইমেলাতেই বারবার মুক্তচিন্তাকে রুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। ঠুনকো কারণে বই নিষিদ্ধ করা হয়েছে, স্টল বন্ধ করা হয়েছে। এবার একদম লেখক-প্রকাশকদের হাতকড়া পরিয়ে রিমান্ডে নেওয়া হলো। ফেসবুকে সবাই মজা করে প্রস্তাব করছে, এই যদি হয় অবস্থা তাহলে বইমেলার আয়োজনের দায়িত্ব বাংলা একাডেমিকে না দিয়ে ইসলামিক ফাইন্ডেশনকে দেওয়া হো্ক। কিন্তু আমরা এমন চাই না। আমরা চাই বাংলা একাডেমি এবং বইমেলা হোক সকল প্রগতিশীলতা আর মুক্তচিন্তার বিকাশের ক্ষেত্র। কোনও কুপমন্ডুকতা যেন ঠাঁই না পায় সেখানে। একটা কথা সবাই মাথায় রাখলে ভালো, ভয় দেখিয়ে কখনও জয় করা যায় না।

আমরা অবিলম্ব ব-দ্বীপের স্টল খুলে দেওয়া এবং লেখক-প্রকাশকদের মুক্তি দাবি করছি। আর দাবি জানাচ্ছি ৫৭ ধারা অবিলম্বে বাতিলের।

লেখক:  অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।

 ইমেল: [email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গাজায় ত্রাণ প্রবেশের প্রধান দুটি ক্রসিং বন্ধ রেখেছে ইসরায়েল: জাতিসংঘ
গাজায় ত্রাণ প্রবেশের প্রধান দুটি ক্রসিং বন্ধ রেখেছে ইসরায়েল: জাতিসংঘ
পিছিয়ে পড়েও সানডে-ইমনের গোলে ফাইনালে মোহামেডান
পিছিয়ে পড়েও সানডে-ইমনের গোলে ফাইনালে মোহামেডান
আচমকা এলো দেড় মিনিটের উসকানিমূলক ‘তুফান’!
আচমকা এলো দেড় মিনিটের উসকানিমূলক ‘তুফান’!
প্রকল্প নেওয়ার আগে জনগণের উপকার বিবেচনার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
প্রকল্প নেওয়ার আগে জনগণের উপকার বিবেচনার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ