X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনের আড়ালে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ

মো. জাকির হোসেন
২৩ মার্চ ২০২৩, ১৮:০৭আপডেট : ২৩ মার্চ ২০২৩, ১৮:০৭

যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশসহ পৃথিবীর ১৯৮টি দেশ ও অঞ্চলের স্থানীয় মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ‘কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিসেস, ২০২২’ এই শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনে নির্বাচন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আদালত ব্যবস্থা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, নির্যাতন, কারাগারের পরিস্থিতি, বিচারব্যবস্থা, নাগরিক সমাজ ও সরকার সমালোচকদের প্রতি হুমকি, হয়রানি, মত প্রকাশের স্বাধীনতাসহ নানা বিষয়  তুলে ধরা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ নিয়ে কিছু মৌলিক প্রশ্ন রয়েছে –

এক. যুক্তরাষ্ট্র কোন আন্তর্জাতিক আইন বলে এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারে? অপর রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অধিকার রাখে? অপর রাষ্ট্রে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক আইন ও বৈশ্বিক আদালতের রায় রয়েছে। ১৯৬৫ সালে জাতিসংঘ প্রণীত ‘Declaration on the Inadmissibility of Intervention and Interference in the Domestic Affairs of States’ এবং ১৯৭০ সালের ‘Declaration on Principles of International Law concerning Friendly Relations and Cooperation among States in accordance with the Charter of the United Nations’-এ অপর রাষ্ট্রে হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনেও হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ। এছাড়াও আন্তর্জাতিক আদালতের একাধিক রায়ে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিকারাগুয়ার মামলায় আন্তর্জাতিক আদালত বলেছেন, নিকারাগুয়ার কন্ট্রা বিদ্রোহীদের সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। কারণ, এটি অপর রাষ্ট্রে হস্তক্ষেপ।

বৈশ্বিক আদালতের এই রায় থেকে আরও প্রতীয়মান হয় যে অ-হস্তক্ষেপের নীতি কেবল সরাসরি শক্তি প্রয়োগ বা শক্তি প্রয়োগের হুমকির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। কোনও রাষ্ট্রের ইচ্ছার কাছে অপর রাষ্ট্রকে বাধ্য করার পরোক্ষ চাপও হস্তক্ষেপ। আন্তর্জাতিক আইনবিদদের মতে, ‘Nicaragua case implicitly recognized that the non-intervention principle could extend to indirect interference through other means, such as economic and political pressure.’ ২০০৫ সালে উগান্ডার বিরুদ্ধে ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক ও কঙ্গোর মামলায় আন্তর্জাতিক আদালত নিকারাগুয়া মামলার রায়ের নীতি পুনর্ব্যক্ত করে উল্লেখ করেন, “the principle of non-intervention prohibits a State ‘to intervene, directly or indirectly, with or without armed force, in support of an internal opposition in another State.” হস্তক্ষেপের মানদণ্ড নিয়ে যতই ধোঁয়াশা থাকুক যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক আইন ও বৈশ্বিক আদালতের রায়ের লঙ্ঘন।

দুই. প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পর্যবেক্ষকদের বিবেচনায় বাংলাদেশে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র তো নির্বাচনে কোনও পর্যবেক্ষক পাঠায়নি। তাহলে কোন পর্যবেক্ষকদের কথা বলছে যুক্তরাষ্ট্র?

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। গত সাড়ে চার বছর ধরে এই সরকারের সাথে লেনদেন করেছে। তাহলে হঠাৎ কেন নতুন গীত। প্রবাদ আছে, ‘শীতকালে চৈত্র মাসের ওয়াজ’। সরকারের শেষ সময়ে আগামী নির্বাচনের আগে কেন গত নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে প্রশ্ন? যুক্তরাষ্ট্রের নিজের নির্বাচন নিয়েও তো বিতর্ক রয়েছে, যা আজও সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়। আমি এ বিষয়ে গার্ডিয়ান, নিউজউইক, নিউইয়র্ক টাইমস ও ফোর্বস পত্রিকার কয়েকটি সাম্প্রতিক শিরোনাম উল্লেখ করছি – ‘More than 40% in US do not believe Biden legitimately won election- poll’ (The Guardin, 5 Jan 2022); ‘40% of Americans Think 2020 Election Was Stolen, Just Days Before Midterms’ (Newsweek, 11/2/22); ‘Most Republicans Say They Doubt the Election. How Many Really Mean It?’ (The Newyork Times, Nov. 30, 2020), ‘More Than Half of Republicans Believe Voter Fraud Claims And Most Still Support Trump, Poll Finds’ (Forbes, April 5, 2021)।

নিজের দেশের বিতর্কের অবসান না করে অপর দেশের নির্বাচন নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করার নৈতিক অধিকার যুক্তরাষ্ট্রের আছে কি?

তিন. জাতিসংঘের মানবাধিকার চুক্তিগুলোর আলোকে মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ে এই বার্ষিক প্রতিবেদন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র নিজেই অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তি ও নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তি অনুমোদন করেনি। বিশ্বের মাত্র ৬টি রাষ্ট্র এই চুক্তি দুটো অনুমোদন করেনি। যুক্তরাষ্ট্র তাদের একটি। অভিবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষা বিষয়ক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তিতে স্বাক্ষরই করেনি যুক্তরাষ্ট্র।

চার. কোনও রাষ্ট্রের মানবাধিকার বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করার আগে সেই রাষ্ট্রের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকা স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের নীতি। আমেরিকান আঞ্চলিক মানবাধিকার সুরক্ষা ব্যবস্থায় আন্ত-আমেরিকান মানবাধিকার কমিশন ওই অঞ্চলের রাষ্ট্রসমূহের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। তবে এরূপ প্রতিবেদন প্রকাশের আগে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রকে অবশ্যই প্রতিবেদনটি সরবরাহ করে তার বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের অজানা কি?

পাঁচ. প্রতিবেদনের তথ্য সংগ্রহেও রয়েছে মারাত্মক ত্রুটি। জনশ্রুতি, সরকারবিরোধী এনজিও, দূতাবাসে প্রাতরাশ কিংবা  নষ্ট সুশীলদের থেকেও তথ্য সংগ্রহ অনুমান করা যায়। যে এনজিও শাপলা চত্বরে নিহত মানুষের বিষয়ে পরিকল্পিত মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিবন্ধনহীন রয়েছে তার বক্তব্য দিয়েও প্রতিবেদন সাজানো হয়েছে।

ছয়. যুক্তরাষ্ট্র দেশে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে, গণতন্ত্র সম্মেলন করে। অথচ ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভূমিধস জয় পেলেও যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচিত আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান না নিয়ে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পক্ষ নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি জান্তাকে অস্ত্র, অর্থ দিয়ে বাঙালি গণহত্যায় সহযোগিতা করেছিল।

শুধু যে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমন হয়েছে তাই নয়। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ইরানের মোহাম্মদ মোসসাদেগ, গুয়েতেমালার জ্যাকব আরবেঞ্জ, কংগোর প্যাট্রিস লুলুমবা, ডমিনিকান রিপাবলিকের জুয়ান বশচ, ইকুয়েডরের অ্যারোসেমানা, ব্রাজিলের জোয়াও গৌলার্ত, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্নো, গ্রিসের জর্জ প্যাপানড্রিয়াস, কম্বোডিয়ায় প্রিন্স সাহৌনেক, বলিভিয়ার জুয়ান টরেস, চিলির সালভেদর এলেন্ডে, এল সালভেদরের ওস্কার রোমেরো ও হাইতির জিন বাট্রান্ড অ্যারিস্টাইডসহ অনেককে উৎখাত করে সামরিক জান্তা কিংবা আমেরিকার পুতুল সরকারকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে নির্বাচিত নেতাদের উৎখাত করেই ক্ষান্ত হয়নি যুক্তরাষ্ট্র, তাদের হত্যাও করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা বহুল আলোচিত। নির্বাচিত নেতাদের উৎখাতই নয়, যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেশের নির্বাচনেও সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে। ডভ লেভিন তার বই ‘মেডিং ইন দ্য ব্যালট বক্স’-এ দেখিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন (পরবর্তীকালে রাশিয়া) ১৯৪৬ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে প্রকাশ্যে বা গোপনে ১১৭টি বিদেশি নির্বাচনে প্রার্থী বা দলকে সাহায্য বা বিরুদ্ধে কাজ করেছিল। এরমধ্যে ৮১টি ক্ষেত্রেই (৬৯%) যুক্তরাষ্ট্র জড়িত ছিল। বিদেশি নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের বড় একটি উদাহরণ হলো– ১৯৪৮ সালে স্নায়ুযুদ্ধের শুরুতে ইতালির নির্বাচনে সিআইএ’র গোপন তৎপরতা। ইতালির নির্বাচনে কমিউনিস্ট প্রার্থীদের পরাজয় নিশ্চিত করতে গোপনে কাজ করেছিল তারা। তখন তাদের সমর্থিত ইতালিয়ান রাজনীতিবিদদের প্রচার-প্রচারণায় সহায়তা দিতে মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়েছিল। একই রকম আরও বহু প্রচেষ্টা পুরো স্নায়ুযুদ্ধের সময় ধরে চলতে থাকে। ‘রিগড’ নামক বইয়ের লেখক ডেভিড শিমারকে সিআইএ-র ইতিহাসবিদ ডেভিড রোবার্জ বলেছিলেন, “ওই সময়ে এজেন্সিটি ‘মাঝে মাঝে’ ভোটে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতো।” স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময়েও যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপের নীতি অব্যাহত রাখে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০০০ সালে যুগোস্লাভের প্রেসিডেন্ট স্লোবোডান মিলোয়েভিয়ের পুনর্নির্বাচিত হওয়া ঠেকাতে তার বিরোধীদের সমর্থন দিতে সিআইএ-কে গোপন তৎপরতা চালানোর অনুমতি দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। ২০১৬ সালে পশ্চিমা গবেষক টনি কার্তালুসসি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভর্তুকিতে পরিচালিত এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন এএনএফআরইএল-এর কার্যাবলির পর্দা ফাঁস করে জানান, থাইল্যান্ডের গণভোটকে প্রভাবিত করতে কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি। যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দ হিসেবে থাকা থাকসিন সিনাওয়াত্রাকে ক্ষমতায় রাখতে কাজ করে যায় প্রতিষ্ঠানটি। একই অভিযোগ রয়েছে মালয়েশিয়া ও কম্বোডিয়ার নির্বাচনের ক্ষেত্রেও।

সাত. প্রতিবেদনে সুশাসন, আইনের শাসন, নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক সহনশীলতার কথা বলেছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র গোপনে ও প্রকাশ্যে অন্য দেশে অবৈধ হস্তক্ষেপ করে, আক্রমণ করে, আক্রমণের হুমকি দেয়, সরকার উৎখাত করে পোষ্য সরকারকে ক্ষমতায় বসায়, দেশপ্রেমিক রাজনীতিকদের হত্যা করে, সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী সৃষ্টি করে, তাদের অর্থ ও অস্ত্র দেয়, অন্তর্ঘাত চালায়, দখল করে, দখলে মদত দেয়। টেক্সাস ছিল স্বাধীন রাষ্ট্র। সেই স্বাধীন টেক্সাসকে দখল ও আত্মসাৎ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে মেক্সিকোর অর্ধেক অংশ, তথা বর্তমান ক্যালিফোর্নিয়া, অ্যারিজোনা, নেভাডা, নিউ মেক্সিকো, কলোরাডোর মতো বেশ কিছু রাজ্য নিজের অধিকারে নিয়ে নেয় যুক্তরাষ্ট্র।

সাম্রাজ্যবাদ কবলিত পৃথিবীতে বাস করছি আমরা। সাম্রাজ্যবাদীরাই বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে মুক্তবিশ্ব, মানবাধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা, গণতন্ত্র আর ধর্মের স্বাধীনতাসহ নানা চটকদার কথা বলে। অথচ দেশে দেশে আগ্রাসন, গণহত্যা, জুলুম, স্বৈরতন্ত্র, অবৈধ হস্তক্ষেপ ও ষড়যন্ত্র করছে এই সাম্রাজ্যবাদীরাই।

প্রশ্ন হলো, গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা ও মানবাধিকারের মহাজনেরা মানবতা ও মানবাধিকাবিরোধী এমন আগ্রাসী, দস্যুতামূলক কর্মকাণ্ড কেন করছে? ট্রুম্যান নীতির মাধ্যমে ১৯৪৭ সালে স্নায়ুযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। স্নায়ুযুদ্ধ মূলত দুই সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের(বর্তমানে রাশিয়া) আদর্শিক ও প্রভাব বলয় বিস্তারের যুদ্ধ। ডলার ডিপ্লোম্যাসি, ওয়ার ডিপ্লোম্যাসি, গুপ্ত হত্যা, কোনও দেশের বিরোধী দল বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা, প্রোপাগান্ডা ইত্যাদির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশকে নিজের অনুগত করতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। এভাবে অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার ফলে আস্তে আস্তে দেশগুলো আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। এরপর আধিপত্য ধরে রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা সামরিক ক্ষমতা প্রদর্শন, বিশ্ব অর্থনীতি ও বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ, নব্য-উপনিবেশবাদ প্রবর্তন, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামরিক জোট গঠন, মিডিয়া এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি কৌশলী অভিবাসন নীতি ব্যবহার করছে। বিশ্বের প্রায় ৭০টি দেশে ৮০০টির মতো সামরিক ঘাঁটি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। বিভিন্ন দেশে সিআইএ-র অভিযান ও মার্কিন সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ও এই দুটি বাহিনীর নৃশংসতা নিয়ে ১৯৯৫ সালে ‘কিলিং হোপ: ইউএস মিলিটারি অ্যান্ড সিআইএ ইন্টারভেনশনস সিন্স ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন গবেষক ও ঐতিহাসিক উইলিয়াম ব্লাম। তার ওই বইয়ের আলোকে ১৯৯৭ সালে একটি নিবন্ধে সিআইএ-র নৃশংসতার চিত্র সবার সামনে নিয়ে আসেন প্রয়াত সাংবাদিক স্টিভ কাংগাস।

নিবন্ধে বলা হয়, সিআইএ একটি বিশেষ স্কুলে বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনীকে নৃশংস হওয়ার প্রশিক্ষণ দেয়। কুখ্যাত এ স্কুলের নাম দেওয়া হয় ‘স্কুল অব দ্য এমেরিকাস’ (প্রথমে এটি পানামায় খোলা হয়, পরে তা জর্জিয়ায় স্থানান্তর করা হয়)। এটি ‘গুপ্তঘাতকের স্কুল’ নামেও কুখ্যাত। বিশ্ব সন্ত্রাসের আরেক নাম যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’। কখনও ‘ধ্বংসাত্মক ও গণবিধ্বংসী অস্ত্র’ থাকার মিথ্যা অজুহাতে আবার কখনও ‘মানবিক হস্তক্ষেপ’ কিংবা উগ্রবাদ দমনের ছদ্মবেশে চালানো হয়েছে আগ্রাসন। স্বার্থ উদ্ধারে প্রথমে হুমকি-ধমকি, তাতে কাজ না হলে ভয়ংকর সামরিক অভিযানে নির্বিচারে অবকাঠামো ধ্বংস ও লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।

‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই’-এর নামে দেশে দেশে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ নিয়ে একটি মানচিত্র প্রকাশ করেছিল ওয়াশিংটনভিত্তিক খ্যাতনামা ম্যাগাজিন স্মিথসোনিয়ান। এতে বলা হয়েছে, ২০১৭-১৮ সালে বিশ্বের ৮০টি দেশে (যা পৃথিবীর মোট দেশের ৪০ শতাংশ) যুদ্ধ করেছে মার্কিন সেনাবাহিনী। সামরিক শক্তি প্রদর্শনের পাশাপাশি দরিদ্র রাষ্ট্রসমূহকে পদানত রাখতে বিশ্ব অর্থনীতি, মুদ্রাব্যবস্থা ও বাণিজ্য নীতিকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র।

বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ডব্লিউটিওর মতো সংস্থাগুলো প্রতিনিয়ত যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ইচ্ছাতন্ত্রের সহযোগী হিসাবে কাজ করছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের মতো সংস্থাগুলো তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোকে অর্থনৈতিক ও মানবিক সাহায্যের নামে নানাবিধ শর্ত এবং বিধিনিষেধ আরোপ করে। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো পশ্চিমা শক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে নতুন উপনিবেশে পরিণত হয়ে পড়েছে। নব্য উপনিবেশবাদের দাসত্বের নিগড়ে বন্দি দরিদ্র রাষ্ট্রসমূহকে তাদের সার্বভৌমত্ব পশ্চিমাদের ইচ্ছার কাছে সমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা না থাকা সত্ত্বেও কম দামে রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনতে পারছে না অনেক দেশ। এলএনজির ভয়াবহ সমস্যা সত্ত্বেও রাশিয়ার সাহায্য নিতে পারছে না। জোট গঠনের মাধ্যমেও বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপের মিত্র দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত জোট ন্যাটোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অনেক দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে। জাতিসংঘ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করছে। পশ্চিমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া ও চীনতে ঠেকাতে মরিয়া যুক্তরাষ্ট্র। তারা রাশিয়া-ইউক্রেন প্রক্সি যুদ্ধে অংশগ্রহণের পাশাপাশি নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে। চীনকে রুখতে আমেরিকা কোয়াড (QUAD), অকাস (AUKUS), আইপিইএফ (IPEF)-এর মতো জোট গঠন করেছে।

পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবহৃত প্রচলিত কৌশলের অনেকগুলোই কার্যকারিতা হারিয়েছে। তাই কয়েক দশক ধরে নতুন অস্ত্র হলো বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদন। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কেন এই অস্ত্র? বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা মার্কিন ইচ্ছাতন্ত্রের কাছে পুরোপুরি মাথা নোয়াতে রাজি নন।

‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ এই পররাষ্ট্রনীতি পাল্টে রাশিয়া ও চীনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতেও রাজি নন। যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে এটি অমার্জনীয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপে নৌ-ঘাঁটি স্থাপনের স্বপ্ন দেখছে যুক্তরাষ্ট্র। বিএনপির শাসনামলে ১৯৯১ সালে হওয়া ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত সেন্টমার্টিন দ্বীপে সহায়তা প্রদানের নামে নৌ-ঘাঁটি স্থাপনের বিষয়ে পর্যবেক্ষণ ও পরিসংখ্যান করে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এই স্বপ্নের পথে সবচাইতে বড় বাধা শেখ হাসিনা। আর সে কারণেই শেখ হাসিনা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টিতে সরকারের মেয়াদের শেষ প্রান্তে এসে গত নির্বাচনের ত্রুটি নিয়ে প্রতিবেদন। যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের পছন্দের তাঁবেদার সরকার বসাতে চায় বাংলাদেশে। কেউ কেউ মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র আরও একবার ব্যবহার করতে চাইছে এএনএফআরইএল-কে।

এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় নিজেদের পছন্দের সরকার গঠনে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করেছে এবং কম্বোডিয়ায় নির্বাচন বন্ধ করে নিজেদের পছন্দের সরকারকে ক্ষমতায় রেখেছে। মানবাধিকার প্রতিবেদন ও এএনএফআরইএল-এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ওপর পশ্চিমা কর্তৃত্ব খাটিয়ে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সাম্রাজ্যবাদীরা নিজের স্বার্থে করতে পারে না এমন কিছু নেই।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
শিল্পী সমিতির নির্বাচন, মিশা-ডিপজলে কুপোকাত কলি-নিপুণ
শিল্পী সমিতির নির্বাচন, মিশা-ডিপজলে কুপোকাত কলি-নিপুণ
ভাগ্নিকে শায়েস্তা করতে নাতিকে হত্যা
ভাগ্নিকে শায়েস্তা করতে নাতিকে হত্যা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ