X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের প্রথম সরকার

আশরাফ সিদ্দিকী বিটু
১৭ এপ্রিল ২০২৩, ১২:৪২আপডেট : ১৭ এপ্রিল ২০২৩, ১২:৪২
১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস বাঙালি জাতির জীবনে এক তাৎপর্যপূর্ণ ঐতিহাসিক দিন। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম এবং আমাদের জন্য এক অবিস্মরণীয় সাফল্যগাথা। এদিনই বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বাংলাদেশের জনগণ দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই এই সরকার গঠন করেছিল। এই সরকারই মূলত আমাদের স্বাধীনতার ভিত্তি ও যৌক্তিকতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে এবং দেশ ও বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক, সামাজিক, আইনি, মৌলিক ভিত্তি ও স্তম্ভকে শক্তিশালী করেছে।

এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশের সামরিক, বেসামরিক, আইনি, প্রশাসনিক বৈধতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় কাঠামো গঠনে মৌলিক কর্মকাণ্ড শুরু করেছিল এবং সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাপী আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নৈতিকতা ও ন্যায্যতার বিষয়টি সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। মুজিবনগর সরকারই বাংলাদেশের প্রথম বৈধ ও কার্যকরী সরকার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ও নেতৃত্বে এই সরকার ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন আর বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভা শপথগ্রহণ করে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১, এসবই এক ও অভিন্ন সূত্রে গাঁথা।

মূলত ৭ মার্চের পর থেকেই দেশ চলতে থাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এবং এর আগে ৩ মার্চ গণপরিষদের সভা স্থগিত করা হলে দলের নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুকে পরবর্তী যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব অর্পণ করেন। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণার পর জাতির পিতাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গ্রেফতার করার পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক আওয়ামী লীগ নেতারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন, কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ অনেকে গোপনে ভারতে গমন করে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করা শুরু করেন।

১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চের ভয়াল রাতের পর আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে ২৭ মার্চ প্রথমে ঝিনাইদহ যান। মার্চের ৩০ তারিখে ভারতে গিয়ে তাঁরা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে, ১লা এপ্রিল দিল্লিতে গিয়ে ৪ এপ্রিল ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছিলেন। সেই সাক্ষাতে নানা বিষয়ে আলোচনা হয় এবং ভারত সরকার বাংলাদেশকে সাহায্য প্রদানে ইতিবাচক আশ্বাস দেয়।

তাজউদ্দীন আহমদ ভারতে অবস্থান গ্রহণকারী এমএনএ এবং এমপিএদের নিয়ে একটি গোপন স্থানে অধিবেশন আহ্বান করেন, যেখানে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হওয়ায় তাদের ওই অধিবেশনের আইনগত ভিত্তি ছিল। ওই অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ এবং সরকার পরিচালনার জন্য মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। অধিবেশনে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করে মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যও নিযুক্ত করা হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ওই দিনই (১০ এপ্রিল) তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন। এভাবে ১০ এপ্রিল সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয় এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাকে অনুমোদন করে সে আলোকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করেন। এদিনই মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক হয় এবং এরপর প্রতিদিনই তারা সভায় মিলিত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলা হতে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের এমএনএ ও এমপিএ সমন্বয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশের গণপরিষদ। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক উভয় পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিবর্গ গণপরিষদ সদস্য বা এমসিএ বলে পরিচিত।

এই গণপরিষদের এমসিএরা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এখানে উল্লেখ্য যে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল তারিখে ‘আইনের ধারাবাহিকতা প্রয়োগ আদেশ-১৯৭১’ জারি করেন। সেখানে বলা হয়, এই আদেশ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর হয়েছে বলে গণ্য হবে। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় স্বাধীনতার ঘোষণা ২৬ মার্চ উল্লেখিত এবং এই আদেশও ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারে মন্ত্রিসভা গঠনের কথা বিশ্ববাসীকে অবহিত করেন। মন্ত্রিসভার সদস্যরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত সংলগ্ন মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় শত শত দেশি-বিদেশি সাংবাদিক এবং উপস্থিত জনগণের সামনে মন্ত্রী হিসেবে ১৭ এপ্রিল শপথগ্রহণ করেন। সেদিনের সেই ঘোষণাপত্রই বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। ১১ এপ্রিল ভারতের আগরতলায় এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে চুয়াডাঙ্গায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী পরিষদের সদস্যরা ১৪ এপ্রিল প্রকাশ্যে শপথগ্রহণ করবেন। এই সিদ্ধান্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী চুয়াডাঙ্গায় প্রবল বোমাবর্ষণ করে। মন্ত্রিপরিষদের ১৬ এপ্রিলের সভায় শপথগ্রহণ বিষয়ে আলোচনা হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে চুয়াডাঙ্গার পার্শ্ববর্তী মেহেরপুর মহকুমার (বর্তমানে জেলা) বৈদ্যনাথতলায় বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নেবে।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল দিনটি ছিল শনিবার। সীমান্তবর্তী বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আমবাগানের চারদিকে রাইফেল হাতে কড়া পাহারায় বীর মুক্তিযোদ্ধারা। হাজার হাজার মুক্তিকামী বাঙালির উপচে পড়া ভিড় চারদিকে। ঐতিহাসিক স্বাধীনতার মুহূর্তটি ধারণ করতে দেশি-বিদেশি ১২৭ জন সাংবাদিকও প্রস্তুত। মুক্ত আকাশের নিচে চৌকি পেতে তৈরি করা হয়েছে শপথ মঞ্চ। মঞ্চের ওপর সাজানো ৬টি চেয়ার। অনুষ্ঠানের প্রবেশ পথে বাংলায় লেখা ‘স্বাগতম’। স্থানীয় সময় ১১টা বেজে ৫০ মিনিটে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের নেতারা একে একে আসতে থাকেন। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে প্রকম্পিত চারদিক। প্রথম শপথ মঞ্চে উঠে এলেন বঙ্গবন্ধুর আজীবনের ঘনিষ্ঠ সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাঁর পেছনে তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান ও জেনারেল এমএজি ওসমানী। অনুষ্ঠানের সূচনায় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, গিতা ও বাইবেল থেকে পাঠ করা হয়। স্থানীয় শিল্পী এবং হাজারো মানুষের কণ্ঠে গাওয়া হয় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। এরপর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম উত্তোলন করেন মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। এরপর আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।

নতুন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রিবর্গ ও সেনাবাহিনীর প্রধানকে শপথবাক্য পাঠ করান তিনি। শপথগ্রহণের পর সশস্ত্র তেজদীপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের রাষ্ট্রীয় কায়দায় ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রথম সরকারের মন্ত্রিপরিষদের আনুষ্ঠানিক শপথ ছাড়াও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ ও মুক্তিবাহিনীর কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের নামকরণ করা হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকায় তাঁকে রাষ্ট্রপতি করেই ঘোষণা করা হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সেদিন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে শপথ নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সরকারের মন্ত্রিসভায় শহীদ তাজউদ্দীন আহমদকে সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী, এএইচএম কামারুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়।

শপথ গ্রহণের পরপরই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার ভাষণে বলেন, ‘আজ এই আম্রকাননে একটি নতুন জাতি জন্ম নিলো। …পৃথিবীর মানচিত্রে আজ নতুন রাষ্ট্রের সূচনা হলো এবং তা চিরদিন থাকবে।’

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা যা করছি সবই শেখ মুজিবের নির্দেশে। তবে তিনি কোথায় আছেন বলবো না।’ আরও বলেন, ‘পাকিস্তান আজ মৃত। অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে।…স্বাধীন বাংলাদেশ আজ একটি বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এই নতুন শিশু রাষ্ট্রকে লালন-পালন করছেন। দুনিয়ার কোনও জাতি এই নতুন শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না। আজ হোক, কাল হোক দুনিয়ার ছোট বড় প্রতিটি রাষ্ট্রকে গ্রহণ করতে হবে এ নতুন জাতিকে। স্থান করে দিতে হবে বিশ্ব রাষ্ট্রপুঞ্জে।’

ইয়াহিয়া খান বিশ্ববাসীকে দেখাতে চেয়েছিল বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধ হচ্ছে ভারতের মাটিতে বসে। ইয়াহিয়ার এ প্রচারণা মিথ্যা প্রমাণ করার জন্যই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয় বাংলাদেশের মাটিতে বসেই।

নতুন সরকারের শপথগ্রহণের মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের নাম স্থান পায়। এই মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে ও দক্ষ পরিচালনায় মুক্তিপাগল বাঙালি জাতি নয় মাস মরণপণ সশস্ত্র যুদ্ধ করে ছিনিয়ে আনে মহামূল্যবান বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আরেকটি বিষয় হলো, মুজিবনগর সরকার কর্তৃক জারিকৃত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ নামের এ দলিল যতদিন মুক্তিযুদ্ধ চলেছে ততদিন এই মুজিবনগর সরকারের অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান হিসেবে কার্যকর ছিল। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল Proclamation of Independence, ১৯৭১ ঘোষণা করা হয়, যা অন্তর্বতীকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সংবিধান হিসেবে বিবেচিত। সেদিনের সেই ঘোষণাপত্রই ১৯৭২ সালে প্রণীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ভিত্তি। মুজিবনগর সরকার গঠন ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুমোদন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার সাংবিধানিক ভিত্তি ও মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক ভিত্তি এবং যৌক্তিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করে।

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার ঘোষিত ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ বাংলাদেশের সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ১৫০ অনুচ্ছেদের ৩(১) ধারায় বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ হইতে এই সংবিধান-প্রবর্তনের তারিখের মধ্যে প্রণীত বা প্রণীত বলিয়া বিবেচিত সকল আইন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বা যে কোন আইন হইতে আহরিত বা আহরিত বলিয়া বিবেচিত কর্তৃত্বের অধীন অনুরূপ মেয়াদের মধ্যে প্রযুক্ত সকল ক্ষমতা বা কৃত সকল কার্য এতদ্বারা অনুমোদিত ও সমর্থিত হইল এবং তাহা আইনানুযায়ী যথার্থভাবে প্রণীত, প্রযুক্ত ও কৃত হইয়াছে বলিয়া ঘোষিত হইল। এই তফসিল মতে, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের একটি ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি হিসেবে সংবিধানে সন্নিবেশ করার পাশাপাশি পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই সরকারের প্রধান কার্যালয় কলকাতায় স্থাপন করা হয় প্রধানত নিরাপত্তা এবং মুক্তিযুদ্ধে নির্বিঘ্নে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। এই সরকার কলকাতায় অবস্থান করলেও এর কর্তৃত্ব গোটা বাংলাদেশেই ছিল। দেশের ভেতরে অনেক এলাকা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখলমুক্ত ছিল। পুরো যুদ্ধের সময়কাল এসব এলাকা শত্রুমুক্ত ছিল। এসব অঞ্চলে মুজিবনগর সরকারের ঘোষণামতে মুক্তিযোদ্ধা ও দেশের জনগণ সব ধরনের সহযোগিতা করেছিল। রংপুরের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে, উত্তরে, দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে যেসব এলাকা মুক্তিবাহিনী দখল করেছিল সেসব মুক্ত রাখাই সম্ভব হয়েছিল। রৌমারি, চিলমারী ও দিনাজপুরের বড় অংশ মুক্ত ছিল এবং ফেনী- বেলোনিয়াতেও মুক্তাঞ্চলে এই সরকারের প্রশাসন কার্যকর ছিল। এসব মুক্তাঞ্চলে মুজিবনগর সরকারের সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন নিয়মিত অবাধে যাতায়াত করতো ও কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতো।

বিভিন্ন বিদেশি সাংবাদিকরা এসব মুক্তাঞ্চলে গিয়ে সরকার ও  মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মকাণ্ড দেখে তার প্রতিবেদনও ছেপেছিল।

আওয়ামী লীগের মতাদর্শ এবং নির্বাচনি ঘোষণা (Manifesto) অনুসারে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছিল সংসদীয় পদ্ধতির। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ প্রতিহত করতে মুজিবনগরে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে বহু প্রতিকূল অবস্থা অতিক্রম করতে হয়েছিল।

মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথগ্রহণের পর ১৮ এপ্রিল প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের দফতর বণ্টন করা হয়। ১৯৭১-এর ২০ অক্টোবর পর্যন্ত মন্ত্রণালয় ও বিভাগ হয় ১২টি। কলকাতার থিয়েটার রোডে মূল কার্যালয়ের পাশাপাশি এই সরকারের অধীন আঞ্চলিক প্রশাসনগুলোর অধিকাংশকেই কাজ করতে হতো দেশের বাইরে থেকে, যেমন আগরতলা, শিলচর, পশ্চিম দিনাজপুরে আঞ্চলিক প্রশাসন বা অফিস থেকেও বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা হতো। ১২টি মন্ত্রণালয়ের বাইরেও পাঁচটির মতো সংস্থা এই সরকারের অধীনে কাজ করতো। তাছাড়া ১৫টি সংগঠন বাংলাদেশ সরকারের সমর্থনে দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছিল। সেগুলো হলো- যুব নিয়ন্ত্রণ পরিষদ ও প্রশিক্ষণ বোর্ড, বাংলাদেশ হাসপাতাল, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, জয় বাংলা পত্রিকা, বাংলাদেশ বুলেটিন, বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী সংগঠন, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল, বঙ্গবন্ধু শিল্পীগোষ্ঠী,  বাংলাদেশ তরুণ শিল্পীগোষ্ঠী, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পীও কুশলী সমিতি, বাংলাদেশ সংগ্রামী বুদ্ধিজীবী পরিষদ, নিউ ইয়র্ক বাংলাদেশ লীগ, বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি লন্ডন, এবং লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেন্টসিয়া। মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত ১১টি সেক্টর কমান্ড এবং মুক্তিবাহিনীকে সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতার লক্ষ্যে ১৯৭১-এর ১১ জুলাই ১১টি আঞ্চলিক পরিষদ (Zonal Councils) প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা ১৯৭২-এর ১২ জুন পর্যন্ত কার্যকর ছিল। তাছাড়াও ১১টি যুদ্ধাঞ্চল তথা সেক্টরের সঙ্গে জেড ফোর্স, এস ফোর্স ও কে ফোর্স নামে ৩টি ব্রিগেডও গঠন করা হয়েছিল।

বিভিন্ন দেশ থেকে আর্থিক সাহায্য গ্রহণ ও সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ ফান্ড নামে একটি তহবিল প্রতিষ্ঠা করা হয়। চরম যুদ্ধাবস্থার মাঝেও এই সরকার নিয়মিত বাহিনীর সিপাহী-অফিসারদের জুলাই মাস থেকে নিয়মিত বেতন দেওয়া শুরু করে এবং অক্টোবর থেকে অতিরিক্ত ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করে। এই সরকারের অধীনে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হবার পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও  মন্ত্রীরা ২২ ডিসেম্বর একত্রে ঢাকায় ফিরে আসেন। তার আগে ১৮ ডিসেম্বর কয়েকটি অগ্রবর্তী দল ঢাকায় পাঠানো হয়।  ঢাকা ফিরে এই সরকারের কর্তাব্যক্তিরা জাতির পিতার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং  সমগ্র বিশ্বে চাপ সৃষ্টির ব্যবস্থা করেন জাতির পিতার মুক্তির জন্য। অবশেষে সবার প্রচেষ্টা, জাতিসংঘসহ বিশ্বনেতৃবৃন্দের সহযোগিতা ও চাপে জাতির পিতা ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।

এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য, অনেকে ইচ্ছাকৃত এটাকে অস্থায়ী সরকার বা মুজিবনগর সরকার বা প্রবাসী সরকার বলার চেষ্টা করেন। মূলত ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’-এর ঘোষণাপত্র পাঠের সময় থেকে তা কার্যকর হয় ২৬ মার্চ প্রথম প্রহর থেকে।’ এই সরকার হলো ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। মুজিবনগর বললে সে সরকারের গণ্ডিকে খাটো করা হয় এবং একাত্তরের ২৬ মার্চ জনযুদ্ধ শুরুর পর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হওয়ার আগে অনেক এলাকা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে অথবা সেগুলো মুক্ত এলাকা ছিল। তাই প্রবাসী সরকার বলাও ঠিক নয়’।

এটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম সরকার এবং এই সরকার গঠিত হয়েছিল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারাই এবং গণপরিষদের সদস্যরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত ছিলেন এবং এই সরকারের রাষ্ট্রপতিও জনগণ দ্বারা নির্বাচিত। এভাবে সরকার গঠন করে দেশের মুক্তির জন্য যুদ্ধ পরিচালনা করা সত্যিই বিশ্ব ইতিহাসে অনন্য দৃষ্টান্ত।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুক্তিবাহিনী সংগঠন ও সমন্বয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় এবং এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহায়তাকারী রাষ্ট্র ভারতের সরকার ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক রক্ষায় এই সরকারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। এই সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ পরিকল্পিতভাবে গতিশীল হয়ে প্রবল যুদ্ধে রূপ নেয় এবং স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বিজয় অর্জন ত্বরান্বিত হয়। ভারতসহ বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা ও বাংলাদেশের সঠিক ভাবমূর্তি, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা ও মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধসহ দেশের স্বাধীনতার জন্য এই সরকার গঠন তখন জরুরি ছিল। এই সরকার নিজস্ব পতাকা ব্যবহার করতো। এমনকি এই সরকারের অধীনে যেসব সরকারি অফিসার ও পুলিশ অফিসার কাজ করেছিল তাদের মধ্য থেকে ১৯টি জেলায় ডিসি ও এসপি নিয়োগ দেওয়া হয়, যারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দারুণ কর্মদক্ষতার স্বাক্ষর রাখে। তারা আবার অন্যান্য কর্মকর্তাদের তাদের জেলায় পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। বিদেশি চাপ সামলে এই সরকার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেছে।

এই সরকার গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাস সব পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। পরিচালনা করেছে দীর্ঘ নয় মাসের বীরত্বপূর্ণ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। শরণার্থীদের সাহায্য-সহযোগিতা, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণসহ তাদের যাবতীয় বিষয় দেখভাল করা, খাদ্যসামগ্রী সহায়তা প্রদান, চিকিৎসাসেবা প্রদান, বিভিন্ন ক্যাম্পে অর্থ ও প্রয়োজনীয় খাবার ও জিনিসপত্র বিলিবণ্টন, বিদেশে নিয়মিত যোগাযোগ ও মুক্তিযুদ্ধ ও এই সরকারের পক্ষ জনমত গঠনসহ মুক্তিযুদ্ধের সব কর্মকাণ্ডের যোগসূত্র হচ্ছে মুজিবনগরে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর তিনি সেই সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২ দিন পরে তিনি অধ্যাদেশ জারি করে সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থা বাংলাদেশে উপস্থাপন করেন। এই সরকারের ধারাবাহিকতায় ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের অনুসরণে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২-এর ২৩ মার্চ সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতির গণপরিষদ আদেশ জারি করেন।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে স্বাধীনতা সংগ্রাম ঐক্যবদ্ধ, সঠিক ও গতিশীলভাবে পরিচালনাসহ দেশি-বিদেশি বাস্তবতার নিরিখে এবং আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদ প্রভৃতি নানাবিধ বিষয়কে একক ব্যবস্থাপনা ও কাঠামোর মধ্য দিয়ে বিজয়কে সুনিশ্চিত করতে মুজিবনগর সরকার গঠন ও এর কর্মকাণ্ড ছিল অত্যন্ত দূরদর্শী ও সুবিবেচনাপ্রসূত। যার সুফল জাতি পেয়েছিল। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় মুজিবনগর সরকার অকল্পনীয় ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দিন ১৭ এপ্রিল।  


লেখক: রাজনৈতিক কর্মী ও কলামিস্ট।
 
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভিসা অব্যাহতি ও বাণিজ্য সম্প্রসারণ নিয়ে মিশরের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা
ভিসা অব্যাহতি ও বাণিজ্য সম্প্রসারণ নিয়ে মিশরের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা
বিএনপি নেতাদের কথা মাঠকর্মীরা শোনে না: ওবায়দুল কাদের
বিএনপি নেতাদের কথা মাঠকর্মীরা শোনে না: ওবায়দুল কাদের
কয়েকটি দেশেই আটকে আছে সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার
কয়েকটি দেশেই আটকে আছে সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার
আফসোসে পুড়ছেন হৃদয়
আফসোসে পুড়ছেন হৃদয়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ