আমরা যাকে ঐতিহাসিক ‘মে দিবস’ (May Day) বলে জানি, তা আবার ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ (International Workers’ Day) নামেও পরিচিত। বিশ্বব্যাপী শ্রমিক আন্দোলনের দীর্ঘ পুঞ্জিভূত সংগ্রাম এবং তার অর্জনকে স্মরণ করার জন্যে প্রতিবছর ১ মে বিশ্বজুড়ে এই দিবস পালিত হয়। দিবসটির শেকড় পোঁতা রয়েছে শ্রমিকদের ঐতিহাসিক সংগ্রামের মধ্যে, যারা উন্নত কর্মপরিবেশ, ন্যায্য মজুরি এবং সংগঠিত হওয়ার অধিকারের জন্য লড়াই করেছিলেন যুগের পর যুগ ধরে। প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন অকাতরে। প্রথম মে দিবস উদযাপন হয় উনিশ শতকের শেষের দিকে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের শ্রমিকরা উন্নত চিকিৎসার দাবিতে বিক্ষোভ ও ধর্মঘট করেছিলেন। ১৮৮৬ সালের ৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে দৈনিক ৮ ঘণ্টা শ্রমের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর গুলি চালিয়ে ৮ জনকে হত্যার ঘটনার প্রেক্ষাপটে বিশ্ব মে দিবস পালন করা হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণকালে এই হে মার্কেট পরিদর্শনের সুযোগ আমার হয়েছিল, তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে ১৮৮৬-এর সেই ‘হে মার্কেট কিলিং’-এর কোনও উল্লেখযোগ্য স্মারকবস্তু সেখানে দেখতে পাইনি।
যাহোক, ১৮৮৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব সোশ্যালিস্ট গ্রুপস এবং ট্রেড ইউনিয়নস যৌথভাবে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। বাকিটুকু ইতিহাস।
বর্তমানে মে দিবস সারা বিশ্বের শ্রমিকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে এবং জগতের সব শ্রমিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট আন্দোলনের প্রেরণা হিসেবে কার্যকর ভূমিকা পালন করে আসছে। সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের জন্য চলমান লড়াই বাস্তবায়নের ক্ষেত্র প্রসারিত করছে। আন্তর্জাতিক মে দিবসের এই লিগেসি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং সেই সংগ্রামে শ্রমিক আন্দোলনের ভূমিকার সঙ্গে জড়িত। ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশকে, বাংলাদেশের শ্রমিকরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছ থেকে উন্নত মজুরি এবং কর্মপরিবেশের দাবিতে ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এটি দেশে প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের প্রেক্ষাপট তৈরি করে এবং শ্রমিকদের মধ্যে সংহতিবোধ এবং আন্দোলনের স্পৃহা বৃদ্ধি পায়।
আজ, বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শ্রমশক্তির আবাসস্থল, যেখানে লাখ লাখ শ্রমিক বিভিন্ন শিল্প, যেমন- টেক্সটাইল, কৃষিসহ রকমারি উৎপাদনে নিযুক্ত। বাংলাদেশের গার্মেন্ট চীনের পর বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রফতানিকারক শিল্প। অধিকন্তু, এটি দেশের প্রধান রফতানি খাত এবং বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের মুখ্য উৎস। তবে অধুনা দেশের শ্রমবাজারে বেশ কিছু অগ্রগতি সাধিত হলেও দীর্ঘদিনের কোভিড-১৯ পরিস্থিতি এবং সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন ক্রমশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ছে। শ্রমিকদের অবস্থা এখনও মহান মে ডে’র আদর্শ থেকে অনেক দূরে। বাংলাদেশের শ্রমিকরা, বিশেষ করে পোশাক শিল্পের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, অপর্যাপ্ত মজুরি, অনিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং সীমিত নিরাপত্তা ব্যবস্থার মতো বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। অনেক কর্মী অস্থায়ী ভিত্তিতে নিযুক্ত হওয়ায় স্বাস্থ্যবিমা, অসুস্থতাজনিত ছুটি এবং সবেতনের ছুটির মতো মৌলিক কর্মসংস্থান সুবিধার আওতার বাইরে থাকে। অনেকেই অনিরাপদ পরিস্থিতিতেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন ঝুঁকি মাথায় নিয়ে। তাছাড়া, শ্রম আইন ও প্রবিধান কার্যকর করার ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব পরিলক্ষিত হয়। তদুপরি, শ্রমিক অধিকারকর্মী এবং ইউনিয়ন নেতাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ক্ষুদ্র স্বার্থের রাজনীতি এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের হয়রানি বাংলাদেশে শ্রমিক শ্রেণির ক্ষমতায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিলের রানা প্লাজা দুর্ঘটনা (যেখানে ১১৭৫ জন শ্রমিক নিহত এবং ২ হাজারেরও বেশি আহত হয়েছিলেন, যা বিশ্বের ইতিহাসে তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে) বাংলাদেশের শ্রমবাজার পরিস্থিতির ওপর এক মারাত্মক আঘাত হানে। এর আগে ২০১২ সালে ঘটে তাজরীন ফ্যাশনস অগ্নিকাণ্ড। পরপর সংঘটিত এ দুটো ঘটনায় বাংলাদেশে শ্রমিক নিরাপত্তার শোচনীয় অবস্থার অজুহাতে ২০১৩ সালের ২৭ জুন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে জিএসপি (Generalized Systems of Preferences) সুবিধা বাতিল করে দেয়, যা বাংলাদেশের পোশাক রফতানি খাতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের বিশেষায়িত পণ্যের সেই শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার আজও পুনর্বহাল হয়নি। তবে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় শ্রমিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির প্রভূত উন্নতি হয়েছে এবং বিদ্যমান শ্রম আইন সংস্কার করে অনেকটা শ্রমিকবান্ধব করা হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে জিএসপি সুবিধা পুনরুদ্ধার এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আর এসবের পেছনেও আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের ঐতিহ্যের প্রভাব রয়েছে।
বাংলাদেশে, শ্রমিক আন্দোলন শ্রমিকদের অধিকারের পক্ষে কথা বলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, বিশেষ করে, পোশাক শিল্প-শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে। গার্মেন্টস শিল্পে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সংগ্রাম মে দিবস উদযাপনের প্রেরণা, যেখানে শ্রমিকেরা উন্নত চিকিৎসা এবং ন্যায্য মজুরির দাবিতে একত্রিত হয়ে থাকে। অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও, বাংলাদেশি শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকারের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন এবং পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার উপযোগী সংস্কারের জন্য দাবি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, যার বাস্তবায়ন তাদের কর্মপরিবেশ উন্নত এবং জাতীয় উৎপাদনে তাদের আপেক্ষিক গুরুত্ব নিশ্চিত করতে পারে।
মে দিবসের মূল চেতনাকে সামনে রেখে বাংলাদেশের শ্রমিকরা তাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন এবং নিয়োগকর্তা ও সরকারের কাছে উন্নত মজুরি, উন্নত চিকিৎসা ও নিরাপদ কর্মপরিবেশের দাবি জানিয়ে আসছেন। এ ব্যাপারে কিছু ইতিবাচক অগ্রগতিও হয়েছে। ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড এবং ২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের কর্মপরিবেশ নিয়ে ক্রেতা দেশগুলোর মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিলে বিদেশি অনেক সংগঠন বাংলাদেশি পোশাক বর্জনের ডাক দেয়। সেই প্রেক্ষাপটে কারখানা পরিদর্শনে ইউরোপীয় ২২৮টি ক্রেতার সমন্বয়ে “অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ” গঠিত হয়, যা সংক্ষেপে অ্যাকর্ড নামে পরিচিতি পায়। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড এবং খুচরা বিক্রেতারা বাংলাদেশ অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি স্বাক্ষর করেছে, যার লক্ষ্য দেশের পোশাক কারখানায় নিরাপত্তার মান উন্নত করা। এরই ধারাবাহিকতায় দুই বছর মেয়াদি “ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকর্ড ফর হেলথ অ্যান্ড সেইফটি ইন দ্য টেক্সটাইল অ্যান্ড গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি” নামে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর হয়। রিটেইল কোম্পানি এবং আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়নগুলোর মধ্যে এই চুক্তির ফলে কারখানার কর্মপরিবেশ ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের মতো চুক্তিতে থাকা আন্তর্জাতিক ক্রেতাদেরও আইনি বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়। এরপর বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার কাজ শুরু হয়। দেড় হাজারের বেশি কারখানার অবকাঠামো উন্নয়ন, আগুন থেকে সৃষ্ট দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা, শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে বাস্তবায়ন করা হয় বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা। তবে মে দিবসের মূল চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বাংলাদেশ এবং সারা বিশ্বের শ্রমিকদের অবস্থা নিশ্চিত করার জন্য এখনও অনেক কাজ করা বাকি আছে।
মে দিবস সারা বিশ্বে শ্রমিকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন যাতে শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস প্রতিফলিত হয়েছে এবং একটি ন্যায্য, অধিকতর ন্যায়সঙ্গত সমাজ বিনির্মাণের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত হয়েছে। মে দিবসের মূল চেতনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে, বাংলাদেশ এবং সারা বিশ্বের শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার এবং শ্রমিক শ্রেণির ক্ষমতায়নের সপক্ষে সোচ্চার হওয়ার জন্য ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার পাওয়া নিঃসন্দেহে শ্রমিক অধিকারের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। শ্রমিকদের একত্রিত হওয়া (দুনিয়ার মজদুর এক হও) এবং অবস্থার পরিবর্তনের দাবি করার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম প্রদান করা মে দিবসের তাৎপর্য উপলব্ধির এক ফলিত দিক। এটি শ্রমিকদের অধিকার-সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আনতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
মে দিবস সারা বিশ্বের শ্রমিকদের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য দিন এবং এর সংহতি ও সামাজিক ন্যায়বিচারের বার্তা আজও প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক। একবিংশ শতাব্দীর রকমারি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সঙ্গে সঙ্গে মে দিবস শ্রমিকদের অধিকারের জন্য চলমান সংগ্রাম এবং আরও ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত সমাজের জন্য লড়াইয়ের গুরুত্বের দ্যোতক হিসেবে কাজ করে। সমাজে শ্রমিকদের মৌলিক ভূমিকার স্বীকৃতি এবং তাদের প্রতি ন্যায্য আচরণ ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান মে দিবসের তাৎপর্য বর্ধন করে। বিশ্বজুড়ে, শ্রমিকদের অবস্থান ঐতিহাসিকভাবে প্রান্তিক হয়ে পড়েছে। শ্রমিকরা আজও নানামুখী শোষণ, অনিরাপদ কাজের পরিস্থিতি এবং মৌলিক অধিকার ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুবিধা বঞ্চিত থেকেই যাচ্ছে। মে দিবসের ঐতিহ্যপুষ্ট শ্রমিক জাগরণ সমস্যাগুলোর সমাধান নিশ্চিত করে শ্রমিকদের প্রাপ্য মর্যাদা ও যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের পথ সুগম করে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক; প্রাক্তন উপাচার্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।