X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

একটি প্লাস্টিকমুক্ত সবুজ পৃথিবীর জন্য

এরশাদুল আলম প্রিন্স
০৫ জুন ২০২৩, ২০:১৮আপডেট : ০৫ জুন ২০২৩, ২০:১৮

প্রতিবছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়। পরিবেশ সচেতনতা বাড়াতেই এই দিবসের আয়োজন। যদিও জলবায়ু ও পরিবেশ আজ প্রতিদিনেরই ভাবনা। ক্রমেই সংকটাপন্ন হয়ে যাচ্ছে আমাদের ধরিত্রী, পরিবেশ, প্রতিবেশ।

পরিবেশ নিয়ে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অনেক আলোচনা-বিতর্ক হচ্ছে এ কথা সত্য, কিন্তু জাতীয় পরিসরে পরিবেশ সচেতনতার কোনও বিকল্প নেই। কিন্তু তারপরও আমরা সচেতন হচ্ছি না। দেশের পরিবেশ ও জলবায়ু উন্নয়নে আমাদের অংশগ্রহণ এখনও তলানিতেই পড়ে আছে। আমরা একটি পরিবেশ সচেতন নাগরিক সমাজের অংশীজন হয়ে উঠতে পারিনি। পরিবেশ ও জলবায়ুর সবচেয়ে বড় সংকট এটিই।  

গত কয়েক বছরে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় আমাদের সক্ষমতা কিছুটা বেড়েছে এমন দাবি করা হলেও বাস্তবে সে সক্ষমতা কতটুকু বেড়েছে সেটি ভেবে দেখা দরকার। জলবায়ুর গতি-প্রকৃতির আজ আর আগের মতো নেই। এর ভয়াবহতার রূপও পাল্টে গেছে। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা কোনও কিছুই আর আগের মতো নেই। তার আসা-যাওয়ার দিনক্ষণও বদলেছে। কাজেই এসবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে টিকে থাকার সক্ষমতা আমাদের কতটুকু বেড়েছে সেটিই আসল কথা। কেবল উঁচু সাইক্লোন আশ্রয়কেন্দ্র ও জনগণের কাছে ঝড় পূর্বাভাস পৌঁছে দেওয়ার নামই জলবায়ু সক্ষমতা নয়। খরা, অতি বৃষ্টি, বন্যা এমনকি অতি শীত মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি কী সেটিই বড় প্রশ্ন।’

এরকম একটি পরিস্থিতিতেই এ বছর পরিবেশ দিবস পালিত হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য– প্লাস্টিক দূষণ এড়ানো (Beat Plastic Pollution)। প্লাস্টিক একটি বৈশ্বিক পণ্য। পরিবেশ ও জলবায়ুর সংকটও বৈশ্বিক সংকট। বাংলাদেশের জন্য এবারের প্রতিপাদ্যটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিক একটি অপরিহার্য উপাদান। প্লাস্টিকের বিভিন্ন পণ্য আমরা ব্যবহার করি। দামে সস্তা ও সহজে ব্যবহারযোগ্য হওয়ায় এর ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। আমাদের ঘরবাড়ি, অফিস-আদালত, দোকানপাট সবকিছুই আজ প্লাস্টিকের দখলে চলে গেছে। প্লাস্টিক পণ্য অন্য সুবিধাজনক হলেও প্লাস্টিক আমাদের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য এক মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে।

প্লাস্টিক আমাদের জীবন ও পরিবেশের ক্ষতি করছে। এসব প্লাস্টিক পণ্য অধিকাংশই পুনঃচক্রায়ন হয় না। ব্যবহার শেষে এগুলো পরিবেশে বর্জ্য হিসেবেই থেকে যায় বছরের পর বছর। পচেও না, গলেও না। মাটি, পানি ও বায়ুর সঙ্গে মিশেও যায় না। ৪০০ থেকে ১ হাজার বছর পর্যন্ত এগুলো পরিবেশে বর্জ্য হিসেবে থেকে যায়। মিশ্রিত হয় না।

রাজধানী ঢাকাতেই প্রতিদিন গড়ে ৬৪৬ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। প্লাস্টিকের এই অতি ব্যবহার কেবল আমাদের দেশেই নয়, অন্যান্য দেশেও হচ্ছে।

আমেরিকায় প্রতিবছর ৫ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদন হয়, যার মাত্র ২৪ শতাংশ পুনঃচক্রায়ন হয়। বাকি (৩.৮ মিলিয়ন টন) প্লাস্টিক বর্জ্য আকারে পরিবেশেই পরিত্যক্ত হয়।

প্লাস্টিক একটি অপচ্য পদার্থ। এটি পুনঃচক্রায়ন না হওয়া পর্যন্ত পরিবেশেই অবস্থান করে। পরিবেশে পরিত্যক্ত হয়ে এসব প্লাস্টিক পরিবেশের প্রতিটি উপাদান– মাটি, পানি ও বায়ু সব কিছু্ই দূষিত করে। এমনকি সাগরে বা পানিতে পতিত হলেও এগুলোর ক্ষুদ্র কণা মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর খাদ্যকণার মাধ্যমে তাদের শরীরে প্রবেশ করে। এভাবে ধীরে ধীরে ওইসব প্রাণীকুলের স্বাভাবিক স্বাস্থ্য, বংশবিস্তার ও প্রজনন চক্রেও পরিবর্তন সাধন করে।  

এছাড়া মাটিতে পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা বিভিন্ন গবাদিপশু ও অন্যান্য পশু-পাখির খাদ্যমূল্যের সঙ্গে মিশে ওইসব প্রাণীর স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি করে। এভাবে জলজ ও স্থলজ প্রাণীর মাধ্যমে মানুষের শরীরেও এসব প্লাস্টিক অতি ক্ষুদ্ররূপে ধীরে ধীরে প্রবেশ করে। ফলে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করে। কিন্তু এসব ক্ষতি ধীরে ধীরে প্রতীয়মান হয়। ফলে অধিকাংশ সময়ই এসব ক্ষতির কারণ অগোচরেই রয়ে যায়। প্লাস্টিক এভাবেই পরিবেশ ও অন্যান্য যাবতীয় প্রাণীরই ক্ষতি করে। সব প্রাণীর স্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে। এর ক্ষতির তালিকা অনেক দীর্ঘ।

প্লাস্টিক প্রতিরোধে অনেক দেশ কাজ করছে। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় কয়েকটি দেশ প্লাস্টিক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। কিছু দেশ প্লাস্টিক দূষণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। অনেক দেশ প্লাস্টিক বর্জ্যের ওপর কর আরোপ করেছে। কিছু দেশ প্লাস্টিক বর্জ্যকে পুনঃচক্রায়নের ওপর জোর দিচ্ছে।

ভারতও প্লাস্টিক বোতলের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে নীতি প্রণয়ন করেছে। সিকিম রাজ্য বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠান ও সভায় প্লাস্টিক বোতলের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। বিহার রাজ্যেও সরকারি সভায় প্লাস্টিক বোতলের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিছু কিছু রাজ্য শূন্য বর্জ্য ক্রীড়াস্থানের লক্ষ্যে কাজ করছে। আমাদের দেশেও এরকম কার্যক্রম হাতে নেওয়া জরুরি।

আমাদের দেশে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিশেষ কোনও আইন, বিধি এমনকি সরকারি নীতিমালাও নেই। পরিবেশ দূষণ রোধে যদিও একাধিক পরিবেশ বিষয়ক আইন ও বিধি আছে। তবে, প্লাস্টিক জাতীয় পণ্য ব্যবহার ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বিশেষ নীতিমালা থাকা জরুরি। সরকার একসময় পলিথিন নিষিদ্ধ করেছিল। এর সুফলও আমরা পেয়েছিলাম। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে পলিথিন আবার জেঁকে বসেছে। পলিথিন ও প্লাস্টিকের এরকম যত্রতত্র ব্যবহার রোধ করতে নীতিমালা দরকার।

দেশে প্লাস্টিক উৎপাদন, বিপণন ও এর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে। বৃহৎ পরিসরে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য  কোনও শ্রেণিভিত্তিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আমাদের নেই। এখানে সব ধরনের বর্জ্যই একই পদ্ধতিতে সংগৃহীত ও পরিশোধিত হয়, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।

পরিবেশ ও প্রতিবেশ বাঁচাতে প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার হ্রাস করতে হবে। বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব পাট বা পচনশীল (বায়োডিগ্রেডেবল) প্লাস্টিকের ব্যবহার্য সামগ্রী তৈরি করতে হবে। এর ব্যবহার রোধে প্রয়োজনে পুলিশিংয়েরও ব্যবস্থা করতে হবে।

প্লাস্টিকের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহারে আইন প্রণয়ন ও এর কঠোর বাস্তবায়ন জরুরি। গণমাধ্যমে প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে ও পরিবেশের পক্ষে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে।

সর্বোপরি দেশের মানুষকে সম্পৃক্ত করে পরিবেশ আন্দোলন বেগবান করতে হবে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক স্তরে পরিবেশ রক্ষায় মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। পরিবেশ রক্ষায় দেশের প্রতিটি নাগরিককে ইতিবাচকভাবে অংশগ্রহণ করতে হয়। সবার অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রয়াসই পরিবেশ রক্ষার মূল চালিকাশক্তি। সময় হয়েছে আজ প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে, প্লাস্টিকের ব্যবহার সীমিত ও রোধ করতে যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখার, পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে আসার।  

 

লেখক: আইনজীবী

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মাদ্রাসা ক্যাম্পাস সবুজায়নের নির্দেশ
তীব্র তাপপ্রবাহমাদ্রাসা ক্যাম্পাস সবুজায়নের নির্দেশ
যুবদল সভাপতি কারাগারে, রিজভীর নেতৃত্বে প্রতিবাদ মিছিল
যুবদল সভাপতি কারাগারে, রিজভীর নেতৃত্বে প্রতিবাদ মিছিল
ইন্ডিয়া আউট কর্মসূচি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেবে ১২ দলীয় জোট
ইন্ডিয়া আউট কর্মসূচি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেবে ১২ দলীয় জোট
কানাডার স্টেডিয়ামে রেকর্ড গড়লেন দিলজিৎ
কানাডার স্টেডিয়ামে রেকর্ড গড়লেন দিলজিৎ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ