X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশকে প্রতিপক্ষ বানাবেন না

প্রভাষ আমিন
১৬ জুন ২০২৩, ১৬:০০আপডেট : ১৬ জুন ২০২৩, ১৬:৫১

আগামী ডিসেম্বরে বা সর্বোচ্চ আগামী বছরের জানুয়ারির শুরুতে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ভোট গ্রহণের জন্য আরও ৬ মাসের কিছুটা বেশি সময় বাকি থাকলেও তফসিল ঘোষণার পরই আসলে নির্বাচনি প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে। সে হিসেবে মাস চারেক বাকি আছে বলা যায়। নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, বাংলাদেশ যেন ততই দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের খেলার মাঠ হয়ে উঠছে।

এটা ঠিক বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে একটা বিতর্ক আছে। বিতর্ক না বলে অচলাবস্থা বলাই ভালো। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আমাদের প্রধান দুই দল একদম বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছেন। একসময় আন্দোলন করে বিএনপি সরকারের কাছ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করা আওয়ামী লীগ এখন এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। আর আওয়ামী লীগের আন্দোলনের সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অসারতা প্রমাণে ব্যস্ত থাকা বিএনপি এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনেই যেতে রাজি নয়। এটা আমাদের রাজনীতিরই ট্র্যাজেডি, ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দাবির যৌক্তিকতাও বদলে যায়। তখন বিএনপির কাছে অযৌক্তিক মনে হলেও আওয়ামী লীগের আন্দোলনের তীব্রতার মুখে তারা দাবি মানতে বাধ্য হয়েছিল। আর এখন বিএনপির দাবি যত যৌক্তিকই হোক, তীব্র আন্দোলন করতে না পারলে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে তা আদায় করা সম্ভব নয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ধারণাটাই বিরাজনীতিকরণের। যাদের কাছে আমরা ৫ বছরের জন্য দেশের দায়িত্ব দিতে পারবো, তাদের আমরা তিন মাসের জন্য বিশ্বাস করতে পারবো না কেন? অরাজনৈতিক লোকজন এসে আমাদের রাজনীতি ঠিক করে দেবে, এটা রাজনীতিবিদদেরই ব্যর্থতা। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সন্দেহ, অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা এত বেশি; যার কোনও তুলনা নেই বিশ্বে।

নানা কারণে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন ভালো হয়নি। এর দায় অবশ্যই আওয়ামী লীগের। তবে বিএনপিকেও দায় নিতে হবে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। তাই নির্বাচন একতরফা হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি নিজেদের নিবন্ধন টিকিয়ে রাখতে নামকাওয়াস্তে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। জয় নয়, বিএনপির লক্ষ্য ছিল দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তা প্রমাণ করা। বিএনপির পাতা ফাঁদে পা দিয়ে আওয়ামী লীগ দুটি নির্বাচনেই অপ্রয়োজনীয় বাড়াবাড়ি করেছে। সে কারণে তাদের এখন খারাপ নির্বাচনের দায় মাথায় নিতে হচ্ছে।

এখন সবার চাওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি যেন অংশগ্রহণমূলক হয়। সবার অংশগ্রহণে যেন হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্র ফিরে আসে। মানুষ যেন তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে। দেশের মানুষের এই চাওয়া বিদেশি বন্ধুদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে। তারাও বাংলাদেশে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। কিন্তু মজার ব্যাপার  হলো, বিদেশি বন্ধুরা তাদের চাওয়াটা স্পষ্ট করেছে। কিন্তু কেউই এখন পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বলেনি। বিদেশি বন্ধুরা অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর যেমন চাপ দিচ্ছে, তেমনি বিএনপিকেও বলছে নির্বাচনে অংশ নিতে। গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি ঘোষণার পর বদলে গেছে বাংলাদেশের রাজনীতির চালচিত্র। মার্কিন নীতি অনুযায়ী যারাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পথে বাধা হবে, তারাই মার্কিন ভিসা পাওয়ার অযোগ্য হবেন। এই নীতি সরকারি ও বিরোধী দল সবার জন্যই প্রযোজ্য। তাই গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি ও বজায় রাখার দায় যেমন সরকারি দলের, তেমনি বিরোধী দলেরও। অবাধ ও সুষ্ঠু না করতে পারলে সেটা অবশ্যই নির্বাচন কমিশন ও সরকারি দলের ব্যর্থতা বলে গণ্য হবে। আবার নির্বাচন বর্জন এবং প্রতিহতের চেষ্টাও মার্কিন নীতির পরিপন্থি হবে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের নতুন ভিসানীতি ঘোষণার পর বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়, তা নিশ্চিত করতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে চিঠি লিখেছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ৬ সদস্য। মার্কিন ৬ কংগ্রেসম্যানও একই ধরনের আকাঙ্ক্ষায় পদক্ষেপ নিতে বলেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে।

বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সবার এই চাওয়া আসলে বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন। এই চাওয়ার সঙ্গে আমাদের কোনও দ্বিমত নেই। কিন্তু একই সঙ্গে বিদেশি বন্ধুদের এটাও মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ। আমাদের মর্যাদাকে খাটো করে এমন কোনও চাপ যেন কেউ না দেয়।

আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটানোর চেষ্টায় কেউ যেন বাংলাদেশকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে না ফেলেন। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগের ক্ষেত্রে মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয় যাচাই-বাছাইয়ের আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।

জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জাঁ পিয়ের লাক্রোয়ার বাংলাদেশ সফরকে সামনে রেখে তার কাছে এ আহ্বান জানানো হয়েছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ খুবই মর্যাদা ও সাহসের সঙ্গে অংশ নিয়ে আসছে। এটা ঠিক বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছিল। ক্রসফায়ারের নামে হত্যা আর গুম পরিণত হয়েছিল ডাল-ভাতে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র‌্যাবের বর্তমান ও সাবেক ৭ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারপর থেকেই বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির দারুণ উন্নতি হয়েছে। এই উন্নতির কথা স্বীকার করেছেন মার্কিন কর্তারাও। গত দেড় বছরে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তেমন কোনও অভিযোগ নেই। এই সময়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এই চাওয়া অবশ্যই ষড়যন্ত্রমূলক। এখানে স্পষ্টতই বাংলাদেশকে প্রতিপক্ষ বানানো হয়েছে। এই চাওয়া আসলে আমাদের দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি অন্যায় করার শামিল।

র‌্যাবের বর্তমান ও সাবেক ৭ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে। নতুন ভিসানীতির পর উন্নতি হয়েছে নির্বাচনি প্রক্রিয়া ও গণতান্ত্রিক পরিবেশের। ভিসানীতি ঘোষণার পর অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো যথেষ্ট ভালো হয়েছে। বিএনপি নির্বিঘ্নে সভা-সমাবেশ করতে পারছে। এমনকি ১০ বছর পর জামায়াতকেও কর্মসূচি পালনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আমাদের সবার উচিত মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক পরিবেশের এই উন্নতি ধরে রেখে ধাপে ধাপে চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ– সবার আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের আর সর্বত্র মানবাধিকার আর গণতন্ত্রের নহর বইছে।

বাংলাদেশকে ঠিক করলেই গোটা বিশ্ব ঠিক হয়ে যাবে। আপনার সবাই গণতন্ত্রের পক্ষে থাকুন, মানবাধিকার সমুন্নত রাখুন, বাংলাদেশের পাশে থাকুন; বাংলাদেশকে প্রতিপক্ষ বানাবেন না।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ও মোটরসাইকেল নিয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা
ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ও মোটরসাইকেল নিয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা
অপহৃত ১০ বাংলাদেশিকে ফেরত দিয়েছে আরাকান আর্মি
অপহৃত ১০ বাংলাদেশিকে ফেরত দিয়েছে আরাকান আর্মি
ধানমন্ডিতে ছাদ থেকে পড়ে গৃহকর্মী আহত 
ধানমন্ডিতে ছাদ থেকে পড়ে গৃহকর্মী আহত 
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ