X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

দফা দিয়ে বিএনপি কিছু আদায় করতে পারবে না

আশরাফ সিদ্দিকী বিটু
১৩ জুলাই ২০২৩, ১৫:৪৭আপডেট : ১৪ জুলাই ২০২৩, ১৭:৫০

বাংলাদেশের জনগণ ও রাজনীতি সংশ্লিষ্ট মানুষ বিএনপি এবং তাদের নেতৃত্বাধীন জোটের বিভিন্ন দফা-কর্মসূচি গত কয়েক বছর যাবৎই পেয়ে আসছে। বিএনপি নেত্রী ঘোষিত রূপরেখা ২০২৩, ২০২২-এর ডিসেম্বরের ১০ দফা, ২০১৫ সালে অবরোধকে সামনে রেখে ৭ দফা– এমন বেশ কয়েকটি দাবি ও দফা দেশের মানুষ কয়েকবার পেয়েছে এবং এগুলোকে ঘিরে কর্মসূচির নামে সহিংসতাও করেছে বিএনপি। সাধারণ মানুষকে তারা পুড়িয়ে মেরেছে। দেশের অর্থনীতির ক্ষতি করেছে কয়েক লাখ কোটি টাকার। তবে বিএনপির এসব দফা ও কর্মসূচির ফলাফল শূন্য। কারণ, এসব কর্মসূচি সার্বিকভাবে জনসম্পৃক্ততা পায়নি বা সরকারের পতন ঘটানোর মতো কিছু করতে পারেনি।

যদিও মাঝে-মধ্যে তারা মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি তুলে হাস্যরস সৃষ্টি করেছিল। এসব ঘোষণাপত্রে কৌশলে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি চাওয়া হয়েছিল। বিএনপি নেত্রী বক্তৃতায় বলেছিলেন, পদ্মা সেতু জোড়াতালি দিয়ে করা হচ্ছে। কিন্তু কোনও কর্মসূচি তাদের দলকে চাঙা করতে পারেনি, আস্থাও অর্জন করতে পারেনি। ফলে ভয়াবহ আগুন সন্ত্রাস, পেট্রোলবোমার হামলা থেকে বিএনপি বাধ্য হয়ে সরে আসে।

এখন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর ছয় মাস, তাই বিএনপির নেতৃত্ব হয়তো ভাবছে কেউ তাদের বাইরে থেকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে– কিন্তু এই দিবাস্বপ্ন কোনোদিনও পূরণ হবে না। বিএনপির এক নেতা বলেছিল, ১০ ডিসেম্বর থেকে দেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়। তারপর কিছুই হলো না। শুধু তাদের ৭ জন এমপি পদত্যাগ করলো। এই ৭ জন এমপি সংসদে ছিল বিধায় হয়তো লন্ডন কেন্দ্র হিংসা করছিল, সেজন্য তাদের পদত্যাগ করানো হলো। তবে ‘টেক ব্যাক বাংলাদেশে’র অর্থ কী–এর দ্বারা তারা কী বোঝাতে চায়? ‘রাষ্ট্র সংস্কারের মানে কী’–কাদের নিয়ে তারা এসব করার পরিকল্পনা করছে?

এই প্রসঙ্গে ছোটবেলার স্কুল জীবনের একটা গল্প মনে পড়ছে। ক্লাস এইটে পড়ার সময় স্কুলে এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে ক্লাসে পেছন থেকে শার্টে কলমের কালি মেরেছিল, কালি-খাওয়া বন্ধুটি স্যারকে নালিশ করলে স্যার যার দিকে কালি মারার অভিযোগ ছিল তাকেই দায়িত্ব দিয়েছিল কে কালি মেরেছে তা খুঁজে বের করতে। বিএনপির ‘টেক ব্যাক’ বা ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ অনেকটা এমন, যে কালি মেরেছে তাকেই কালি মারা ছাত্রকে বের করতে দেওয়ার মতোই। যারা নিজেদের অপকর্মে নিমজ্জিত তারা যে কী সংস্কার করবে তা সবাই বোঝে।

যুগপৎ আন্দোলনের নামে রাজপথে ফয়সালার হুমকি দিয়ে প্রথমে ৫৪/৫৬ দলকে সঙ্গে নিতে চাইলে পরে এই জোট ৩৩/৩৪ দলে নেমে আসে। এই ৩৩/৩৪ দলের বেশিরভাগের জনসমর্থন নেই এবং বেশ কয়েকটি দলের নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন নেই। এদের সঙ্গে কয়েকজন দলছুট নেতাও জুটেছেন। এদের মধ্যে কয়েকজনের অতীতে বিভিন্ন নির্বাচনে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। সরকারকে নানা হুমকি-ধমকি দিয়ে কোনও সুবিধা বিএনপি ও তাদের জোট করতে পারেনি। গত কয়েক বছরে বিএনপি ও তাদের দোসররা কিছু করতে না পারলেও কোটি কোটি টাকা খরচ করে দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারটা ভালোই করতে পেরেছে। জনগণের কাছে না গিয়ে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করে দেশের বিরুদ্ধে নানা কুৎসা রটাতে পেরেছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে কয়েকজনকে বেতন দিয়ে নানা মিথ্যা ও অসত্য ভিডিও এবং অন্যান্য রিলস ও মিম  করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে হেয় করার কাজে এই ১৪ বছর বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধান, রাজনৈতিক নেতা, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর প্রধানরা- যারাই গত কয়েক বছর বাংলাদেশ সফর করেছেন তারা দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার প্রশংসাই করেছেন।  

সম্প্রতি কয়েক ধাপে অনুষ্ঠিত গাজীপুর, খুলনা, সিলেট, বরিশাল ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি সরাসরি অংশগ্রহণ করেনি। তবে তাদের দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। তারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচন করায় বিএনপি তাদের বহিষ্কার করে কিন্তু তাদের অনেকে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ওয়ার্ড কাউন্সিলর হয়েছে। তৃণমূল নেতৃত্ব বিএনপির কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত মানেনি। সিটি করপোরেশনগুলোতে ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে বিএনপির ১১৬ জন অংশ নেন, তাদের মধ্যে একজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাস করাসহ মোট ৩৪ জন বিজয়ী হয়েছে। অথচ বিএনপি বারবার এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে নানান প্রশ্ন তুলে আসছে। কিন্তু বিএনপির যারা পাস করেছে তারা কিন্তু এসব বলছে না। এর মাধ্যমে সহজেই বোঝা যায় যে বিএনপির দাবি সঠিক নয়। কারণ, তাদের তৃণমূলের নেতারা নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছে। বিএনপির এমন দোষারোপের রীতি ও রাজনীতি মজ্জাগত। সবসময় সত্যকে অস্বীকার করে ভ্রান্ত মতামত প্রকাশ ও প্রচার করাই তাদের কাজ।

এক দফাকে সামনে রেখে বিএনপির ভিতরে ভিতরে কী ভাবছে বা পদক্ষেপ নিচ্ছে সেটা ভাবনার বিষয়। কারণ, এই কয়েক মাসে সরকারকে হটাতে কোনও কিছু তারা করতে পারবে না, গত ১৪ বছরেও পারেনি। হয়তো বিদেশিদের তারা জনসমর্থন দেখাতে চায় বা তাদের দিয়ে সরকারকে চাপে ফেলতে চায়। এও হতে পারে এসব নানান ঘোষণার মাধ্যমে দলকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করছে। যদিও তাদের দলীয় মনোনয়ন নিয়ে দলের মধ্যে নানা দ্বন্দ্ব। কারণ, গত নির্বাচনে এক আসনে ৭-৮ জনকে মনোনয়ন দেওয়ার মধ্য দিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল, যার ফল তারা নির্বাচনে ভরাডুবির মাধ্যমে পেয়েছিল।

বিএনপির কর্মসূচি ঘোষণা হলেই আগুন সন্ত্রাসের স্মৃতি ভেসে ওঠে। বিএনপি যদি ভাবে আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ সরকার দুর্বল হয়ে গেছে তবে তারা ভুল ভাবছে। এই দেশের মাটি ও মানুষের দল আওয়ামী লীগ। জনগণের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততা বেশি, পাশাপাশি মানুষের জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। হুঙ্কার দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে যারা বিদায় করতে চায় তাদের বুঝতে হবে এসব আওয়ামী লীগ পরোয়া করে না। আওয়ামী লীগকে আন্দোলনের ভয় দেখিয়ে কোনও লাভ নেই– কারণ এসব মোকাবিলা করেই আওয়ামী লীগ বারবার এগিয়ে গেছে।

এদিকে বিএনপির তথাকথিত এক দফার সঙ্গে এক হয়েছে নামসর্বস্ব কয়েকটি দল– এরা যোগ দিলেও কিছু যায় আসে না। কারণ, তাদের হাজারখানেক কর্মী-সমর্থকও নেই। এদের নিয়ে জোট করা শুধু হাস্যরস সৃষ্টি করা। সভা-সমাবেশে বাগাড়ম্বর ও মেঠো বক্তৃতা করে এক দফা দাবি করে কোনও লাভ হবে না। বিএনপি হয়তো ভুলে গেছে আওয়ামী লীগ কখনও পালিয়ে যায়নি, পালিয়ে গেছে বিএনপির নেতাই। যে নেতা দেশেই আসে না সে কীসের নেতৃত্ব দেবে?

যারা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ঘটায়, যারা অন্ধকারে মানুষ পুড়িয়ে মারে তাদের মুখে গণতন্ত্রের কথা শোভা পায় না। বিএনপি এত হুমকি দেওয়ার আগে বলুক কেন রাতের অন্ধকারে তাদের গঠনতন্ত্রের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। রাজবন্দিদের মুক্তি দাবি করে আগের মতো এবারও আসলে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি চাইছে বিএনপি। সংবিধান পরিবর্তন করতে হলে বিএনপিকে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাগবে, কিন্তু তারা তো সংসদেই নাই।

বিএনপির এই এক দফার মাঝে পুরাতন কথাই নতুন ভাষায় বলা হয়েছে। কেউ কারও ভোটাধিকার হরণ করেনি, আসলে বিএনপির প্রার্থী না থাকলে তাদের কর্মীরা ভোটকেন্দ্র যায় না– এটা বিএনপির কেন্দ্র থেকে সিদ্ধান্ত দিয়ে দেওয়া হয়। এসব নির্দেশনা উপেক্ষা করেও তৃণমূলের বিএনপির লোকজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচন করেছিল। ভোটাধিকার হরণের ইতিহাস বিএনপির– এটা সবাই জানে।

বিএনপি এই এক দফা মূলত নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম; দলকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম। জনগণকে ভুল বুঝিয়ে ঘোল খাওয়ানোর সেই দিন আর নেই, তা বিএনপি জানলেও স্বীকার করবে না।

নির্বাচনে আসা ছাড়া আর কোনও পথ মনে হয় না বিএনপির জন্য খোলা আছে। জল ঘোলা করে রাজনীতি করে ফসল ঘরে নিতে পারবে না বিএনপি। নির্বাচনে না এলে কোনও দফারই রফা হবে না– এটা বিএনপিসহ তথাকথিত ৩৩/৩৪ দলকে মানতে ও বুঝতে হবে এবং সে নির্বাচন সংবিধান মোতাবেক হবে।

লেখক: কলামিস্ট ও রাজনৈতিক কর্মী।

 
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
ঢাকায় পুনর্মিলন সেরে ক্যাঙ্গারুর দেশে...
ঢাকায় পুনর্মিলন সেরে ক্যাঙ্গারুর দেশে...
নিষ্পত্তির অপেক্ষায় হেফাজতের ২০৩ মামলা
নিষ্পত্তির অপেক্ষায় হেফাজতের ২০৩ মামলা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ