X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বকাপের ফাইনালে দেখা হবে সাকিব?

প্রভাষ আমিন
১৩ আগস্ট ২০২৩, ১৬:৪৯আপডেট : ১৩ আগস্ট ২০২৩, ১৬:৪৯

ক্রিকেট বিশ্বকাপকে সামনে রেখে সবাই যখন নিজেদের দল গুছিয়ে চূড়ান্ত প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, বাংলাদেশ ক্রিকেটে তখন ঝড়ো হাওয়া। বিশ্বকাপের মাত্র তিন মাস আগে আফগানিস্তান সিরিজের মাঝখানে হুট করে ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবাল। এই ঘোষণা বাংলাদেশ ক্রিকেটে রীতিমতো সাইক্লোন সৃষ্টি করে। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে অবসরের ঘোষণা থেকে সরে আসে তামিম। কিন্তু তখনও বোঝা যায়নি সেই স্বস্তি সাময়িক।

চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে তামিম জানিয়ে দিলেন, তিনি বিশ্বকাপে খেলবেন, তবে অধিনায়কত্ব করবেন না। বিশ্বকাপ খেলা যেকোনও ক্রিকেটারেরই আরাধ্য। আর অধিনায়কত্ব করা তো স্বপ্নের চূড়ান্ত। কিন্তু তামিম ইকবাল কেন বিশ্বকাপকে সামনে রেখে ক্রিকেটই ছেড়ে দিতে চাইলেন, কেন অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাঁড়ালেন। আপাতত ইনজুরিকেই ভিলেন মানা হচ্ছে। তবে ইনজুরি ছাড়াও যে আরও অনেক লুকানো কারণ আছে, সেটা সবাই জানেন বা আন্দাজ করেন।

একসময়কার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাকিবের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, কোচের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই, বোর্ড সভাপতির কথায় অভিমান; সব মিলিয়েই হয়তো অভিমানী তামিম নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু অধিনায়ক হিসেবে না থাকলেও তামিম ওপেনার হিসেবে থাকছেন, এটাই বড় আশার কথা। তামিম বরাবরই ব্যাটে সব সমালোচনার জবাব দিতে চান। ঘোষণা দিয়ে লর্ডসে সেঞ্চুরি, পরপর চার ফিফটিতে সমালোচনার জবাবের কথা তো সবারই মনে আছে। ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতের বিশ্বকাপ শেষ করে দেওয়া ড্যাশিং তামিম ইকবালকে যদি বাংলাদেশ ফিরে পায়, তামিম যদি তার শেষ বিশ্বকাপটি স্মরণীয় করে রাখতে পারেন; তাহলেই বাংলাদেশের লাভ।

যেমনটি আগে বলছিলাম, সবাই যখন দল গুছিয়ে চূড়ান্ত প্রস্তুতিতে নেমে পড়েছে; বাংলাদেশ তখন অধিনায়কের খোঁজে ব্যাকুল। তামিম ইকবাল অধিনায়কত্ব ছাড়ার পর নেতৃত্বের জন্য সাকিবের কোনও বিকল্প ছিল না। কিন্তু সাকিব দেশে না থাকায় সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না বিসিবি। সাকিবের কোনও বিকল্প নেই, এটা যেমন ঠিক আবার, টেস্ট ও টি-২০-এর পর ওয়ানডেতেও নেতৃত্ব দেওয়া, সব ম্যাচ খেলার মতো সময় বের করতে পারবেন কিনা সেটাও বিবেচনায় ছিল। বিবেচনায় ছিল স্বল্প মেয়াদে সাকিবকে অধিনায়ক করা, নাকি দীর্ঘমেয়াদের জন্য কাউকে তৈরি করা। সে ক্ষেত্রে নাম এসেছিল লিটন দাস ও মেহেদী হাসান মিরাজের। কিন্তু নতুন কাউকে বিশ্বকাপের মতো বড় ইভেন্টে তোপের মুখে ফেলে দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হয়তো হবে না। সব বিবেচনায় বিকল্পহীন সাকিবকেই বেছে নিয়েছে ক্রিকেট বোর্ড। আপাতত বিশ্বকাপ পর্যন্ত। বাকিটা ঠিক হবে সাকিব দেশে ফেরার পর। এখানে অনেক যদি-কিন্তু আছে। ক্রিকেট এবং ক্রিকেটের বাইরে সাকিবের যে ব্যস্ততা; তাতে তিনি বাংলাদেশের সব ম্যাচ খেলতেই চান না। বেছে বেছে খেলেন। সেখানে তিন ফরম্যাটেই সাকিবের নেতৃত্ব দেওয়াটা ঠিক প্রত্যাশিত নয়। কোনটা রাখবেন, কোনটা ছাড়বেন; সেটা সাকিবই ঠিক করবেন। এটা ঠিক সাকিব যে ওয়ানডে নেতৃত্বের জন্য বসে ছিলেন বা চেয়ে নিয়েছেন, ব্যাপারটি মোটেই তেমন নয়। বরং বোর্ড আর কোনও উপায় না পেয়ে সাকিবের দ্বারস্থ হয়েছে। বোর্ড সাকিবকে শর্ত দিয়ে অধিনায়ক বানায়নি। বরং সাকিবের শর্ত মেনেই কাজ করতে হবে বোর্ডকে।

সাকিব চেয়ে নেননি, এটা ঠিক। কিন্তু এখন বাংলাদেশের সম্মানের ভার সাকিবের কাঁধে। আর সেই ভার বহন করার মতো যথেষ্ট চওড়া সাকিবের কাঁধ। সাকিব যে এবারই প্রথম ওয়ানডেতে অধিনায়কত্ব করবেন, তেমন নয়। এর আগে তো করেছেনই, এমনকি ২০১১ সালের বিশ্বকাপেও দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তবে সে অভিজ্ঞতা তেমন সুখকর নয়। তবে সেই সাকিব আর এই সাকিব এক নয়। সাকিব আরও পরিণত হয়েছেন, দলে তার কর্তৃত্ব আরও নিরঙ্কুশ হয়েছে। আর এবার যে কায়দায় তিনি অধিনায়ক হয়েছেন, তাতে কর্তৃত্ব যেমন বেড়েছে, চ্যালেঞ্জও বেড়েছে। আর কে না জানে সাকিব আল হাসান চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসেন। এতটাই ভালোবাসেন, কোনও চ্যালেঞ্জ না থাকলে জোর করে চ্যালেঞ্জ বানিয়ে নেন।

সাকিব একই সঙ্গে বাংলাদেশের সবচেয়ে ভালো এবং সবচেয়ে বিতর্কিত ক্রিকেটার। অনেকের ধারণা, বিতর্ক না থাকলে সাকিব অনুপ্রাণিত হন না। তাই পতঙ্গ যেমন আগুনে ঝাঁপ দেয়, সাকিবও তেমনি বিতর্কের আগুনে ঘি ঢালেন। জুয়াড়িদের সঙ্গে প্রমাণিত যোগাযোগে এক বছর নিষিদ্ধ থাকা তো সবচেয়ে বড় বিতর্ক। কিন্তু ছোটখাটো বিতর্কের তালিকাও কম লম্বা নয়। দেশের হয়ে খেলতে না চাওয়া, হুটহাট ছুটি চাওয়া, ব্যবসায় বেশি মনোযোগ দেওয়া, বিসিবিকে পাত্তা না দেওয়া, সিনিয়রদের সম্মান না দেওয়া, টিম ফটোসেশনে অংশ নিতে অনাগ্রহ, মাঠে আম্পায়ারদের সঙ্গে তর্ক, বেয়াদবি, উচ্ছৃঙ্খলা, সমর্থককে পেটানো, সমর্থকের মোবাইল ফেলে দেওয়া, ক্যামেরার সামনে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করা– অন্তহীন বিতর্ক। এত বিতর্কের পরও বিসিবি বারবার সাকিবের দ্বারেই যায়, সাকিবের সব শর্তই মেনে নেয়। কারণ, সাকিব এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার। শুধু বাংলাদেশ বলে নয়, সাকিব বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। আরেকটু নিয়মিত খেললে এবং আরও বেশি খেলার সুযোগ পেলে সাকিব আসলে সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার হতে পারতেন। এখনও সর্বকালের সেরার ছোট্ট তালিকায় রাখতে হবে সাকিব আল হাসানের নাম। বাংলাদেশের মতো একটি দলের হয়ে খেলার পরও এই অর্জন বিস্ময়কর।    

সাকিব আসলে এক নির্ভরতার নাম। কখনও তিনি দলের সেরা ব্যাটসম্যান, কখনও সেরা বোলার। সাকিব থাকলে বাংলাদেশ ১২ জন নিয়ে খেলার সুবিধা পায়। আবার কোনও ম্যাচে সাকিব না থাকলে একাদশ বানাতেই হিমশিম খায়। তবে পারফরম্যান্স-পরিসংখ্যান নয়, সাকিবের শ্রেষ্ঠত্ব আসলে তার মানসিকতায়। সাকিবের মধ্যে একটা রোবটিক ব্যাপার আছে। এই যে এত বিতর্ক, এত আলোচনা, সমালোচনা; কিছুতেই কিছু যায় আসে না তার। নিজের গড়া সাম্রাজ্যে একখেয়ালি রাজপুত্র যেন। মাঠে তার হার না মানা মানসিকতাও তাকে আর সবার থেকে আলাদা করে। এখন সময় এসেছে নিজের সেই হার না মানা মানসিকতা দলের সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার।

তবে দলের অন্য সবাইকে উপেক্ষা করার মানসিকতা থেকে তাকে বেরিয়ে আসতে হবে। গত বিশ্বকাপের আগে মিরপুর স্টেডিয়ামে এসেও দলের ফটোসেশনে অংশ নেননি। হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন, তিনি এই দলের মানের নন। সবার চেয়ে আলাদা। আসলেই তিনি সবার চেয়ে আলাদা। তিনি যে আলাদা সেটা প্রমাণও করেছেন মাঠে। ব্যাটে-বলে অসাধারণ নৈপুণ্য করেছেন। যা করেছেন, তাতে ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্টের সম্মান তার প্রাপ্য ছিল। কিন্তু সেই পারফরম্যান্স দলকে বেশি দূর এগিয়ে নিতে পারেনি বলেই তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ আরেকটু ভালো করলে সাকিবই হতো ২০১৯ বিশ্বকাপের ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট। আর সবার চেয়ে আলাদা হলেও এখন সাকিবকে চলতে হবে সবাইকে নিয়ে। কারণ, তিনি এখন নেতা। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স তো থাকলোই, দলীয় পারফরম্যান্সের ভালোমন্দের দায়ও তাকে নিতে হবে।

১৯৯৯ সালে প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে পাকিস্তানকে হারিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল বাংলাদেশ। সেই সাফল্যের পথ বেয়েই এসেছে টেস্ট স্ট্যাটাস। ২০০৭ সালে ভারতের বিশ্বকাপ স্বপ্ন শেষ করে দিয়ে আবার আলোড়ন তুলেছিল বাংলাদেশ। তবে ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালই এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা পারফরম্যান্স। গত বিশ্বকাপে সাকিব অসাধারণ খেললেও বাংলাদেশ ভালো করতে পারেনি। অক্টোবরে শুরু হতে যাওয়া বিশ্বকাপকে ঘিরে দারুণ আশায় বুক বেঁধেছে সবাই। অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশ দারুণ ক্রিকেট খেলছে, বিশেষ করে ওয়ানডেতে। অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের দারুণ মিশেল আছে এই দলে। দায়িত্ব নিয়ে টি-২০ ফরম্যাটে বাংলাদেশের মানসিকতা বদলে দিয়েছেন সাকিব। এবার যদি ওয়ানডে দলেও সেই মানসিকতা ছড়িয়ে দিতে পারেন, তাহলে বড় স্বপ্ন দেখাই যায়। অধিনায়ক নিয়ে যে বিতর্ক তা শেষ করে দল গুছিয়ে নেওয়ার যথেষ্ট সময় এখনও আছে হাতে। সামনে এশিয়া কাপ ও নিউজিল্যান্ড সিরিজে দলকে একাট্টা করার সুযোগ পাবেন সাকিব।

কয়েক দিন আগে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ট্রফি বাংলাদেশে এসেছিল। পদ্মা সেতুতে ফটোসেশন হয়েছে। ঢাকায়ও বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শন করা হয়েছে। বিশ্বকাপ ট্রফি দেখার পর অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে সাবেক ক্রিকেটার ও বর্তমানে ধারাভাষ্যকার আতহার আলী খান বলেছেন, তার মন বলছে এবার কিছু একটা হবে। তিনি সেই স্বপ্নের দিনেও ধারাভাষ্য কক্ষে থাকতে চান। আতহারের মতো আমরাও এবার বড় স্বপ্ন দেখতে চাই। আর নেতৃত্বে সাকিব বলে আমাদের স্বপ্ন দেখার সাহসও বেড়ে গেছে।

বাংলাদেশ বিশ্বকাপে যাচ্ছে তৃতীয় দল হিসেবে। ওপরে তো মাত্র দুটি দল, এবার যেকোনও কিছু হতে পারে। ১৯ নভেম্বর বিশ্বকাপের ফাইনালে দেখা হবে সাকিব?

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ও মোটরসাইকেল নিয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা
ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ও মোটরসাইকেল নিয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা
অপহৃত ১০ বাংলাদেশিকে ফেরত দিয়েছে আরাকান আর্মি
অপহৃত ১০ বাংলাদেশিকে ফেরত দিয়েছে আরাকান আর্মি
ধানমন্ডিতে ছাদ থেকে পড়ে গৃহকর্মী আহত 
ধানমন্ডিতে ছাদ থেকে পড়ে গৃহকর্মী আহত 
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ