X
বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫
৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

শোকাবহ আগস্ট: মুজিবের রক্তই শেখ হাসিনার সংগ্রামী শক্তির উৎস

শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান
১৫ আগস্ট ২০২৩, ১৬:৪৭আপডেট : ১৫ আগস্ট ২০২৩, ১৬:৪৭

প্রখ্যাত ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ প্রয়াত জেমস আলেকজান্ডার লেমন্ড বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করায় শুধু বাংলাদেশই এতিম হয়নি, বরং পৃথিবী তার গর্বিত এক সন্তানকে হারিয়েছে’। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাই শুধু বাঙালি জাতির বেদনাবিধুর দিনই নয়, এটি পুরো পৃথিবীর জন্য গভীর শোকের একটি দিন। একই সঙ্গে ঘৃণা ও কলঙ্কেরও। যে মানুষটি বাঙালি জাতিসত্তার স্রষ্টা, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের রূপকার, সেই মহানায়ককে আজ থেকে ৪৮ বছর আগে ১৯৭৫ সালের এই দিন ভোরে সমগ্র দেশবাসী যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন এবং মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে পবিত্র আজানের সুমধুর ধ্বনি-প্রতিধ্বনি অনুরণিত হচ্ছিল, ঠিক সেই পবিত্র মুহূর্তে পাকিস্তানি হায়েনাদের একদল প্রেতাত্মা তথা সেনাবাহিনীর একটি  বিপথগামী দল তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে ইতিহাসের এক ঘৃণ্য, ন্যক্কারজনক অধ্যায় রচনা করে।

কবি হাসান মতিউর রহমান তাঁর বিখ্যাত গানে লিখেছেন–

‘যে মানুষ ভীরু কাপুরুষের মতো,

করেনি কো কখনো মাথা নত;

এনেছিল হায়েনার ছোবল থেকে,

আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা...’

হায়েনার ছোবল থেকে স্বাধীনতা আনা সেই মানুষটিকে স্বাধীন দেশে হায়েনার উত্তরসূরিরা হত্যা করেছে! যে আঙুল উঁচিয়ে সাত কোটি বাঙালিকে ঐক্যের ডাক দিয়েছেন, অধিকার আদায়ের মন্ত্রণা দিয়েছেন, দিয়েছেন মুক্তির দিশা; বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, সেই পবিত্র আঙুলকে চিরদিনের জন্য ভেঙে দেয় হায়েনার দল।

হায়েনার দল বুঝতে পারেনি জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব একশ’গুণ শক্তিশালী, শারীরিক মুজিবের চেয়ে আত্মিক মুজিবের উপস্থিতি পুরো দেশময়, ব্যক্তি মুজিবের চেয়ে আদর্শিক মুজিবের অবস্থান প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে।

বাংলা ও বাঙালির মুকুটহীন সম্রাট, রাখাল রাজা খ্যাত, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান, মুক্তিকামী মানুষের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে সমৃদ্ধ অধ্যায়। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র সাধারণ নির্বাচন, ৭১’র অসহযোগ আন্দোলন ও সর্বশেষ মহান মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা যে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বিনির্মাণ করেছি তাঁর প্রত্যেকটি পদক্ষেপের মূলে স্বর্ণাক্ষরে যার নাম লেখা তিনি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

সাধারণ মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা, মৌলিক ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, মানুষের উন্নত জীবন মান বাস্তবায়ন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মুক্তিকামী জনতার পক্ষে আপসহীন থেকে কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন লড়াই এবং সর্বোপরি বাঙালির অর্থনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির সার্থক অবয়ব নির্মাণে জাতির পিতার নেতৃত্ব প্রবলভাবে নিবেদিত ছিল।

এ কথা সত্য, সেদিন ৩২ নম্বরের বাসগৃহে ঘাতকচক্র জাতির পিতার নশ্বর শরীরকে হত্যা করতে পেরেছে ঠিকই, কিন্তু তাঁর অবিনশ্বর চেতনা ও আদর্শকে মুছতে পারেনি, পারবেও না কোনোদিন। কারণ, বাংলাদেশের বুক থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে দেওয়ার শক্তি পৃথিবীর কোনও বুলেটের নেই।

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে কবি কামাল চৌধুরী লিখেছিলেন–

‘রক্ত দেখে পালিয়ে গেলে/ বক্ষপুরে ভয়, ভাবলে না কার রক্ত এটা/ স্মৃতিগন্ধময়, দেখলে না কার জন্ম-মৃত্যু জাতীয়তাময়’।

জাতির পিতাকে হত্যার পর জার্মান রাজনীতিবিদ ও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী উইলিব্র্যান্ট ওই সময় মন্তব্য করেছিলেন, ‘মুজিব হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যারা মুজিবকে হত্যা করতে পারে, তারা যেকোনও জঘন্য কাজ করতে পারে’!

উইলি ব্র্যান্টের এই উক্তিকে সত্য প্রমাণ করে সবাইকে হতবাক করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ক্ষমতায় বসেন বঙ্গবন্ধুরই দীর্ঘ দিনের সহচর খন্দকার মোশতাক আহমেদ। প্রজন্মের কাছে মীরজাফর হিসেবে পরিচিত সেই মোশতাক ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন!

১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই নজিরবিহীনভাবে সেই নিকৃষ্ট ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত এবং পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন ঘাতক চক্রের কুখ্যাত দোসর, বন্দুকের নল দ্বারা অন্যায়ভাবে ও অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতায় আসা জিয়াউর রহমান। ইনডেমনিটির অর্থ আমরা সবাই জানি দায়মুক্তি। এই আইন দ্বারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার বিচারের পথ বন্ধ করা হয়। দায়মুক্তি দেওয়া হয় ইতিহাসের নিকৃষ্টতম এই হত্যাকাণ্ডের আসামিদের।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দেশি-বিদেশি নানান ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতার বাইরে রাখা হয় এ দেশের গণমানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করা একমাত্র দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে। কিন্তু যে রাজনৈতিক দলের শিকড় এ দেশের মাটির অনেক গভীরে, সেই দলকে আর কতদিনই বা ক্ষমতার বাইরে রাখা যায়।

জাতির পিতার রক্তের উত্তরাধিকার, দেশরত্ন শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় এলে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকার্য শুরু হয়। দেরিতে হলেও কিছু কিছু জানোয়ারের বিচারকাজ সমাপ্ত হয়েছে। কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। কয়েকজন বিভিন্ন দেশে এখনও পালিয়ে বেড়াচ্ছে। সেসব পলাতক খুনিকে এখন দেশে এনে শাস্তি নিশ্চিত করা সময়ের দাবি।

১৯৭২ সাল ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতাকে মুক্তির লক্ষ্যে গভীর মনোযোগ দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে নতুন করে যে সংগ্রাম তিনি শুরু করেছিলেন, তা সাড়ে তিন বছরের মাথায় তাঁর প্রাণনাশের মাধ্যমে থমকে দেয় কুখ্যাত দোসররা। সেই যাত্রা শুধু থমকে যায়নি। বরং, পরবর্তী সময়ে এই রাষ্ট্র পাকিস্তানি ভাবধারায় ফের পরিচালিত হয় বহু বছর।

আজ পিতার শোককে শক্তিতে পরিণত করে বঙ্গবন্ধু তনয়া, দেশরত্ন শেখ হাসিনা কোটি কোটি মানুষের প্রার্থনায় দুর্বার গতিতে সামনে এগিয়ে চলছেন। পিতার অবর্তমানে জাতিসত্তার পূর্ণ বিকাশ ও পিতা মুজিবের অসমাপ্ত কাজকে পূর্ণতা দিতে বিশ্বদরবারে মস্তক উঁচু করে অত্যন্ত সুচারুভাবে কাজ করে চলছেন তিনি।

বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে এবং আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করাতে দেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানান ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হচ্ছে। আর এই ষড়যন্ত্রের খলনায়কের ভূমিকা পালন করছে ওই ঘাতক চক্র, যারা জাতির পিতাকে কাপুরুষের মতো হত্যা করেছিল।

এমন পরিস্থিতিতে, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে আরেকবার দেশরত্ন শেখ হাসিনা তথা বাংলার ১৬ কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক নৌকার নিরঙ্কুশ জয়কে নিশ্চিত করতে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, আওয়ামী সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের এই শোকের মাসে দেশের জন্য প্রতিজ্ঞা করতে হবে। যেন কোনও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় স্বাধীন পতাকাকে আর  দ্বিতীয়বার খামচে ধরতে না পারে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ভারতের জাতীয় বেতার সম্প্রচার মাধ্যম কলকাতার আকাশবাণী রেডিও থেকে মন্তব্য করা হয়েছিল–

“যিশু মারা গেছেন, এখন লাখ লাখ লোক ক্রস ধারণ করে তাকে স্মরণ করছে। একদিন মুজিবও হবেন যিশুর মতো”।  

মুজিব যিশুর মতো হয়েছেন বা হতে চেয়েছিলেন, সেটি আমরা বলি না, কিন্তু আমরা এখন দেখি, মুজিব হত্যার পর সময় যত অতিবাহিত হচ্ছে, তাঁর আদর্শ, দর্শন, গ্রহণযোগ্যতা বাংলাদেশ ছাপিয়ে পুরো পৃথিবীতে ততই বেড়ে চলছে। তাঁকে নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, তাঁর জীবন দর্শনকে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে এবং দলমত ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ তাঁকে গভীরভাবে অনুভব করছে।

আমরা মনে করি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাংলার তরুণ প্রজন্মসহ সব স্তরের ভোটাররা শেখ হাসিনাকে ভোট দিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের পক্ষের আওয়ামী লীগকে জিতাতে পুনরায় রায় দেবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বঙ্গবন্ধুর এই সোনার বাংলায় যারাই ষড়যন্ত্র করুক না কেন, বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে থামিয়ে দেবে,  মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে নিস্তব্ধ করে দেবে, শেখ হাসিনার স্বপ্নকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখবে, সেই সাধ্য এই মহাবিশ্বের কারোর নেই। আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি–

“লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে,

এক মুজিবের চেতনায়;

সোনার বাংলা সত্যি হবে,

শেখ হাসিনার সাধনায়”

 
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
অকালে চুল পাকা রোধে এই ৫ কাজ করুন এখনই
অকালে চুল পাকা রোধে এই ৫ কাজ করুন এখনই
গোপালগঞ্জ কারাগারে এক হাজতির মৃত্যু
গোপালগঞ্জ কারাগারে এক হাজতির মৃত্যু
গ্রাহকদের জন্য সহজ স্বাস্থ্যসেবা আনলো গ্রামীণফোন ও সুখী
গ্রাহকদের জন্য সহজ স্বাস্থ্যসেবা আনলো গ্রামীণফোন ও সুখী
ডাম্পট্রাকের সঙ্গে মোটরসাইকেলের ধাক্কায় দুই যুবক নিহত, মহাসড়ক অবরোধ
ডাম্পট্রাকের সঙ্গে মোটরসাইকেলের ধাক্কায় দুই যুবক নিহত, মহাসড়ক অবরোধ
সর্বশেষসর্বাধিক