আধুনিক বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলোর মধ্যে একটি হয়ে থাকবে ২৫ জুন ২০২২ তারিখটি। কারণ, এদিনে আমাদের আত্মমর্যাদার প্রতীক পদ্মা সেতু উদ্বোধন করা হয়। দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করে নিজেদের অর্থায়নে সেতু নির্মাণের সাহসী ঘোষণা দিয়েছিলেন যিনি, সেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই যাত্রা করলো বাংলাদেশিদের গর্বের প্রতীক হয়ে দাঁড়ানো এই সেতু।
এবার পদ্মা সেতুর সঙ্গে যোগ হলো রেলসংযোগও। ১০ অক্টোবর ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ৮২ কি.মি. রেলপথ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর সঙ্গে সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ ত্রিমাত্রিক (সড়ক, নৌপথ ও রেলযোগাযোগ) যোগাযোগের যুগে প্রবেশ করলো। একটা সময় প্রমত্ত পদ্মার ওপর সেতু হবে, কেউ ভাবতেই পারেনি, সেখানে সেতু নির্মাণের এক বছর সময়ের ব্যবধানে রেলসংযোগও স্থাপন করে দেখিয়ে দিলো শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার।
পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে পুরো দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল এখন রেলওয়ের আওতাভুক্ত হয়ে গেলো। পুরো প্রকল্পের আওতায় ঢাকার কমলাপুর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে নির্মাণ করা হবে নতুন ১৪টি স্টেশন ও ৬৬টি বড় সেতু। এছাড়াও ৬টি পুরনো স্টেশন পুনর্নির্মাণ ও ২৫৪টি ছোট সেতু নির্মাণ করা হবে। বর্তমানে ঢাকার সঙ্গে রেলপথে খুলনার দূরত্ব ৪৬০ কিলোমিটার। পদ্মা সেতু হয়ে যশোর রেলপথে যাতায়াতে রাজধানী থেকে খুলনার দূরত্ব কমবে ২১২ কিলোমিটার। এতে প্রায় অর্ধেক সময় বাঁচবে। ভাঙ্গা থেকে পাচুরিয়া-রাজবাড়ী সেকশনটিও পদ্মা সেতু হয়ে সরাসরি ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হবে। নতুন করে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও নড়াইল জেলা রেলওয়ে নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী বরিশাল ও পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরকে এই রুটের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। পদ্মা সেতুর ওপারে সংযোগ সড়ক থেকে ভাঙ্গা উপজেলা হয়ে তিন দিকে তিনটি রাস্তা চলে গেছে। এর একটি বরিশাল, একটি খুলনা অংশে, আরেকটি রাজবাড়ী, যশোর, বেনাপোলে। এ তিনটি রেলপথ যুক্ত হবে মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর এবং বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে। ফলে তিন বন্দর দিয়েই আমদানি পণ্য দ্রুত ঢাকাসহ শিল্পাঞ্চলগুলোয় প্রবেশ করতে পারবে।
শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতে ট্রান্স-এশিয়ান রেল রুটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে পদ্মা সেতুর রেল রুট। পদ্মা সেতুর রেল রুটটি পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতকে সংযুক্ত করে বেনাপোল-যশোর-নড়াইল-ভাঙ্গা-মাওয়া হয়ে নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-টঙ্গী-আখাউড়া-চট্টগ্রাম-দোহাজারি হয়ে মিয়ানমারের গুনদুম সীমান্তে গিয়ে মিশবে। এর মাধ্যমে আন্তদেশীয় রেলসংযোগের একটি নতুন দ্বার উন্মোচন হলো। এরই মধ্যে ভারতের সঙ্গে আমাদের সংযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এবার আমরা মিয়ানমারকে সংযুক্ত করতে যাচ্ছি। সেখান থকে চীনের সঙ্গে সংযোগ ঘটবে। অর্থাৎ সঠিক বাস্তবায়নে সম্ভাবনা অনেক।
পদ্মা সেতু রেলসংযোগের আরেকটি নতুনত্ব হলো বাংলাদেশে প্রথম নতুন প্রযুক্তির পাথরবিহীন রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে পদ্মা সেতুতে। মূল সেতুতে ১৩ দশমিক ৩ কিলোমিটার পাথরবিহীন রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে পাথরবিহীন রেলপথ দিয়ে ঘণ্টায় ৩০০ থেকে ৪০০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলতে পারে। পদ্মা সেতুতে এর গতি নির্ধারণ করা হয়েছে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার।
পাথরবিহীন রেলপথে ভ্রমণ হয় আরামদায়ক। সেতুতে যাতে কোনও ঝাঁকুনি না হয়, মূলত এ জন্যই পাথরবিহীন রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে এরইমধ্যে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে পরিবর্তন শুরু হয়েছে। এটাকে আরও বেগবান করবে পদ্মা রেল সেতু। ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের রেলযোগাযোগ সৃষ্টি হওয়ায় পণ্য পরিবহন খরচ অনেক কমে আসবে। স্বল্প আয়ের মানুষ, শ্রমজীবীরা রেলকেন্দ্রিক নতুন কাজের সন্ধান পাবেন। জংশন এলাকায় ক্ষুদ্র ব্যবসা বা হকারি করেও জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন তারা। তথ্যমতে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট থেকে প্রতিদিন প্রায় ৬০০ টন কৃষিপণ্য রাজধানীতে আনা হয়।
সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, এ রেলপথটি আন্তর্জাতিক রুটে পরিণত হবে। মোংলা বন্দর ব্যবহার করে পণ্য বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ভারতে যেতে পারবে, এতে সময় ও খরচ বাঁচবে। আমদানি-রফতানিকারকরা আরও আগ্রহী হয়ে উঠবেন।
চিংড়ি ও সামুদ্রিক মাছের সরবরাহ আসে মূলত দক্ষিণাঞ্চল থেকেই। সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে আছে অসংখ্য মাছের ঘের। কিন্তু পদ্মা সেতু চালু হওয়ার আগে ওই অঞ্চলের মাছ ঢাকায় এনে বিক্রি করা মোটেও সহজ ছিল না। এখন রেল সংযোগ চালু হওয়ায় মাছ শিল্পে আরও বড় ধরনের বিপ্লব ঘটবে। সাধারণ মানুষও তাদের মাছ ন্যায্যমূল্যে কিনতে পারবে।
দক্ষিণাঞ্চলের শুধু খুলনা থেকেই প্রতিবছর প্রায় ৫০০ কোটি টাকার পাট রফতানি হয়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাট কিনে খুলনায় নিয়ে আসা হয়। এ পাট মোংলা বন্দর হয়ে বিদেশে রফতানি করা হয়। আবার খুলনার পাটকলে উৎপাদিত পাটজাত পণ্য রাজধানীতে আনা হয়। এতে যে সময়ের অপচয় হয়, তার আর্থিক মূল্য অনেক বেশি। বিশ্ববাজারে পাটের অবস্থান ভালো করতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রত্যাশা, পদ্মা রেলসেতু চালু হওয়ায় এ খাত আরও এগিয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে দেশের মোট জিডিপির ১ শতাংশ অবদান রাখবে পদ্মা রেল যোগাযোগ।
এই মেগা স্ট্রাকচারের সুফল ঘরে তুলে স্মার্ট বাংলাদেশের পথে এগিয়ে যাবে দেশ। যার নেতৃত্বে আজ বাংলাদেশের এত অর্জন তিনি আর কেউ নন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শূন্য থেকে শুরু করে তিনি ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার পথে নিয়ে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু দিয়ে গেছেন রাজনৈতিক মুক্তি, আর শেখ হাসিনা জাতিকে দিচ্ছেন অর্থনৈতিক মুক্তি।
লেখক: সাবেক উপ-প্রচার সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।