বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে লিখতে গেলে বেশিরভাগ সময় আক্ষেপের গল্প সামনে চলে আসে। সেই যে একসময় আমরা ফুটবলে রাজ করেছিলাম, জিতেছিলাম সাফ ফুটবলের শিরোপা। ২০০৩ সালের পর থেকে বড় কোনও সাফল্য নেই। বরং দেশের অন্যতম জনপ্রিয় খেলাটি যত দিন যাচ্ছে তত রঙ হারাচ্ছে, পিছিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। মাঝে মধ্যে একটি বা দুটি জয় খেলাটিকে পাদপ্রদীপের আলোতে নিয়ে এলেও পরক্ষণে ধপ করে নিভতে সময় লাগছে না।
তবে এই বছরটি আগের সমীকরণ পেছনে ফেলে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। কারণ, দলটি এখন জিতছে এবং এই জয়গুলোর সঙ্গে মাঠের ইতিবাচক পারফরম্যান্স, দলের সামর্থ্য ও ধারাবাহিকতা মিলিয়ে বাংলাদেশ দলের বদলে যাওয়ার ইঙ্গিত স্পষ্ট।
ভারতের বেঙ্গালুরুর সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের পারফরম্যান্স পরিষ্কারভাবে বাংলাদেশ ফুটবলের বদলে যাওয়ার বড় উদাহরণ। ২০০৯ সালের পর সেমিফাইনালে জায়গা করে নেওয়া। তাও আবার লেবানন ও কুয়েতের বিপক্ষে জোরদার লড়াই করে বিদায়টা হয়েছে মাথা উঁচু করেই।
এরপর ঘরের মাঠে র্যাংকিংয়ে এগিয়ে থাকা আফগানিস্তানের বিপক্ষে দুটি প্রীতি ম্যাচে চোখে চোখ রেখে খেলে ড্র করে নিজেদের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছেন জামাল ভূঁইয়ারা। সর্বশেষ বিশ্বকাপ প্রাক বাছাইয়ে ৩৪ ধাপ এগিয়ে থাকা মালদ্বীপকে বধ করে বাংলাদেশের বাছাইয়ে গ্রুপ পর্বে জায়গা করে নেওয়াটা ছিল দারুণ এক সাফল্য।
এই সাফল্যের পেছনে মাঠে খেলোয়াড়দের পাশাপাশি আছে ডাগ আউটে হাভিয়ের কাবরেরার বড় অবদান। মাস্টারমাইন্ড কোচ যেন দলের খোলনলচে পাল্টে দিয়েছেন। ২০২২ সালে স্প্যানিশ কোচের অধীনে গড়পড়তা ফুটবল খেলা দলটি এ বছর অন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে মাঠের পারফরম্যান্স দিয়ে। বলা যায়, কাবরেরা জাদুতে এ-এক বদলে যাওয়া বাংলাদেশ ফুটবল দল।
অথচ ৩৯ বছর বয়সী কোচের নিয়োগের সময় আলোচনা-সমালোচনা কম হয়নি। ক্লাব কিংবা জাতীয় দলের অভিজ্ঞতা ছাড়াই এমন একজনের হাতে বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব তুলে দিয়ে বড় ঝুঁকিই নিয়েছিল বাফুফে।
প্রথম বছর কাবরেরা দল নিয়ে সেভাবে বলার মতো সাফল্য পাননি। ৪-২-৩-১ কিংবা ৪-৩-৩ ছকে খেলে চেষ্টা করেছেন ইতিবাচক কিছু একটা করে দেখানোর। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি। বড় রকমের সাফল্য আসেনি। পরিস্থিতি দ্রুত সামলে এই বছর থেকে ট্যাকটিসে বদল এনে সাফল্য পেতে শুরু করেছেন।
‘নাম্বার নাইন’-কে সামনে রেখে বাংলাদেশ কিছুতেই গোল পাচ্ছিল না। তাই ছক বদলে আগের ৪-৪-২-এর ডায়মন্ড ছকে চলে গেলেন কোচ। করিম বেনজেমা চলে যাওয়ার পর আনচেলত্তির রিয়াল মাদ্রিদ যেভাবে খেলছে, ঠিক সেভাবেই খেলানোর চেষ্টা করছেন কাবরেরা। এই ছকে বাংলাদেশ কোচ সামনে এমন দুজনকে খেলাচ্ছেন, যাদের পিওর স্ট্রাইকার হয়ে খেলার অভিজ্ঞতা নেই! মধ্যমাঠ ভালো খেললে এই দুই ফরোয়ার্ড প্রতিপক্ষের রক্ষণের ওপর চাপ তৈরি করে গোল বের করে আনে। তাছাড়া এই ছকে মিডফিল্ডারদেরও গোল করার সুযোগ থাকে বেশি।
শুধু ট্যাকটিস বা ছকের কথা বলা হচ্ছে কেন? কাবরেরার এই ছকে রাকিব-বিশ্বনাথ-মোরসালিনরা খাপ খাইয়ে নিচ্ছেন অবলীলায়। একটি দল হয়ে যেভাবে আগ্রাসী ফুটবল খেলা উচিত, সেভাবেই প্রতিপক্ষ বুঝে খেলছে লাল-সবুজ দল।
তার আগের কোচ জেমি ডের সময় রক্ষণ জমাট রেখে প্রতি-আক্রমণে গিয়ে সফল হওয়ার চেষ্টা ছিল। কাবরেরা সাহস করেই অবস্থা বুঝে নতুন ছকে খেলানোর চেষ্টা করে সফল হচ্ছেন। নতুন ছকে খেলোয়াড়রাও নিজেদের মেলে ধরছেন ভালোভাবে।
কখন কার কী করতে হবে তা সঠিকভাবে করার চেষ্টা করছেন। পাসিং, ক্রস কিংবা পজিশন জ্ঞানে আগের চেয়ে অনেক উন্নতির রেখা দেখা যাচ্ছে। যেমন, বিশ্বনাথ ঘোষের মাঠে একসময় ‘মাথা গরম’ করে খেলার প্রবণতা ছিল, সেই ডিফেন্ডার এখন নিজেকে আমূল বদলে ফেলেছেন। রক্ষণ সামলানোর পাশাপাশি ওভারল্যাপ করে এসে নিখুঁত পাস বা ক্রস দিচ্ছেন এবং সেগুলো গোলের সুযোগও তৈরি করছে।
রাকিব হোসেন আগে থেকেই ছিলেন আশা জাগানিয়া। দিনকে দিন যেন আরও ক্ষুরধার হয়ে উঠছেন তিনি। এই মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সেরা ফরোয়ার্ড হওয়ার তকমাটা তো মালদ্বীপের কোচই দিয়ে গেছেন তাকে। শেখ মোরসালিন পরিণত হচ্ছেন। ফয়সাল আহমেদ ফাহিম দ্রুতলয়ে প্রতিপক্ষের সীমানায় ঢুকে অভিষেক গোলও পেয়েছেন। ‘সিক্স প্যাক’ শরীরের সাদ উদ্দিনও দলে ফিরে কোনও ভুল করছেন না। অন্যরাও উন্নতি করেছেন দ্রুতলয়ে।
তার ওপর মাদককাণ্ডে তিন জন নিয়মিত জাতীয় দলের খেলোয়াড় না থাকার অভাবটা বড় আকারে বুঝতে দেওয়া হয়নি মালদ্বীপের বিপক্ষে ম্যাচে।
সব কিছুর সফলতার জন্য কাবরেরা খেলোয়াড়দের উদারহস্তে সার্টিফিকেট দিয়েছেন। আর তা দিতেই পারেন। কিন্তু পেছনে যে তার ট্যাকটিস সেটার কথা তুললেই এই মাস্টারমাইন্ড তা এড়িয়ে যান। সব কৃতিত্ব খেলোয়াড়দের দিয়ে আরও বেশি আদায় করতে চান তাদের কাছ থেকে।
একটি দল হয়ে খেলা বাংলাদেশের কাছে প্রত্যাশা বেড়ে এখন দ্বিগুণ। আগের মতো খেলার আগে তারা হারে না। অন্তত দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে। এই একটু একটু করে বদলে যাওয়া দলটি সামনের বিশ্বকাপ বাছাইয়ের গ্রুপ পর্বে অস্ট্রেলিয়া-লেবানন-ফিলিস্তিনের বিপক্ষে কেমন করে তা এখন দেখার। তবে একটা বিষয় বলে দেওয়া যায়। ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেবো সুচাগ্র মেদেনী’– এটাই হবে বাংলাদেশ ফুটবলের থিম সং।
লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।