X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

সঞ্চয় কি শুরু করেছেন?

সাইফুল হোসেন
০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ২২:৫১আপডেট : ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ২২:৫১

অনেকে মনে করেন সঞ্চয় হচ্ছে সামর্থ্যের ব্যাপার। কিন্তু সঞ্চয়ের জন্য সামর্থ্যের চেয়ে বেশি দরকার সঞ্চয়ী মনোভাব বা সেভিংস মাইন্ডসেট। মন যদি সঞ্চয় করার জন্য রেডি থাকে তাহলে দেখবেন আপনি যেকোনোভাবেই আয়ের ছোট্ট একটা অংশ হলেও সঞ্চয় করতে পারছেন।

অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করে থাকেন, সঞ্চয় শুরু করবো কিন্তু কীভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। অনেকে বলছেন, সঞ্চয় শুরু করে কী হবে? অনেকে বলছেন, এতদিন এই কথাগুলো শুনিনি, শুনলে আমরা আরও আগে থেকে সঞ্চয় শুরু করতাম। এই সব প্রশ্নের মধ্যে একটি প্রশ্ন খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হচ্ছে, কীভাবে সঞ্চয় শুরু করবেন? আমরা প্রত্যেকে, আয় করি বা না করি, খরচ ঠিকই করি। খরচ করি কোন টাকা? কোনও না কোনোভাবে আমাদের কাছে যে টাকা আসে, সেই টাকা। এটা আমাদের বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন কেউ দিতে পারে, কেউ উপহার পেতে পারে, কেউ বৃত্তি পেতে পারে বা যে কোনোভাবেই কোনও না কোনও দিক থেকে টাকা না এলে আপনি খরচ করতে পারবেন না। যেহেতু খরচটা আপনার হাতে তাই সেভিংসের একটা জায়গা কিন্তু এখানে থেকে যায়।

১। সেভিংস করার জন্যে প্রথমে মাইন্ডসেট রেডি করতে হবে যে আমি সঞ্চয় করবো। যদি একবার সেভিংস মেন্টালিটি তৈরি হয়, তাহলে মন সবসময় কম খরচ করে বাকি টাকাটা সেভ করার পক্ষে সায় দেবে। মনটা ওইভাবে টিউনড হয়ে যাবে। তাই প্রথম দরকার নিজের মনকে রেডি করা যে– সেভ করা শুরু করবেন। কখন করবেন? উত্তর হচ্ছে আজ এখন থেকে শুরু করবেন। আমরা মনে করি ‘কাল করবো’। বেতন একটু বেশি হোক, তারপরে করবো। আরও বড় একটা চাকরি পাই, তারপরে করবো। আমি এখনও যুবক এই বয়সে কী সেভ করবো? এখন খরচ করতে থাকি, এনজয় করতে থাকি, আরেকটু বয়স বাড়ুক, তারপর সঞ্চয় করবো ইত্যাদি।

বিভিন্ন ঝামেলায় পড়ে, বিভিন্ন মতামতের কারণে সঞ্চয়টা শুরু করা হয় না। এই জন্যই সঞ্চয় শুরু করবেন এখন থেকে, আজ থেকে। অন্তত মনকে প্রস্তুত করে ফেলতে হবে আজকে। তাহলে, মন সঞ্চয় করার দিকে উদ্বুদ্ধ হবে।

২। এরপর কী করবেন? এর পরের কাজটাই হচ্ছে ইমারজেন্সি ফান্ড গঠন করা। আমি অনেক লেখাতে ইমারজেন্সি ফান্ডের কথা বলেছি। শুধু ইমারজেন্সি ফান্ড নিয়েই আমার আলাদা লেখা ও ভিডিও আছে। এই ইমারজেন্সি ফান্ড একদিনে গঠন করতে পারবেন না। একমাসের বেতন দিয়ে আপনি গঠন করতে পারবেন না। এটি প্রতি মাসেই ১০/২০ শতাংশ হোক বা ৩০ শতাংশ হোক একটা পরিমাণ বাঁচিয়ে, ইমারজেন্সি ফান্ড গঠন করতে হবে।

প্রথম কাজটি হচ্ছে ইমারজেন্সি ফান্ড গঠন করে নিজেকে ও পরিবারকে নিরাপদ রাখা।

৩। পরের পদক্ষেপ হচ্ছে, সিদ্ধান্ত নেওয়া যে আর নতুন কোনও ঋণ করা যাবে না। যে ঋণগুলো আছে সেটা আস্তে আস্তে পরিশোধ করতে হবে। ঋণ যদি থাকে তাহলে প্রতি মাসে ঋণের পারপাসে একটা বড় টাকা বেরিয়ে যায়। তাই নতুন কোনও ঋণ করা যাবে না। আগে যেভাবে পরিশোধ করছিলেন, সেভাবে পরিশোধ করতে থাকবেন।

৪। ক্রেডিট কার্ডের ঋণকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা। ক্রেডিট কার্ডের ঋণের কিন্তু ইন্টারেস্ট রেট অনেক বেশি। দেখবেন, এই ঋণের কবলে একবার পড়লে নিজেকে আপনি আর বের করতে পারছেন না। আমার কথা শুনে অনেকেই ক্রেডিট কার্ড কেটে ফেলেছেন। আমি নিজেও ৩টা কেটে ফেলেছিলাম। ক্রেডিট কার্ড আপনার খরচকে উসকে দেয়।

তারপরের ব্যাপার হচ্ছে, আয়ের মধ্যে চলার চেষ্টা করতে হবে। আয় যদি হয় পঞ্চাশ হাজার টাকা তাহলে তার মধ্যে চলবেন। আয়ের ওপরে কোনোভাবেই যাবেন না।

৫। এরপরে আপনার প্রশ্ন আসবে যে আমি যে সেভিংসগুলো করবো, ওই টাকাগুলো আমি রাখবো কোথায়? এটা কি কোনও মাটির ব্যাংকের মধ্যে রাখবো, নাকি বালিশের নিচে রাখবো, আলমিরার মধ্যে ঢুকিয়ে রাখবো, নাকি এটা কোনও ব্যাংকের সেভিংস অ্যাকাউন্টে রাখবো? এই প্রশ্ন সবার মনে ঘুরপাক খায়। এখানে কয়েকটি কথা বলা খুব জরুরি। সেটা হচ্ছে ব্যাংক কিন্তু খুব নিরাপদ একটা অপশন। আপনি টাকাটা ব্যাংকে জমা করতে থাকেন।

ধরুন, মাসে যদি আপনি পাঁচ হাজার টাকা জমান তাহলে আপনি এটা সেভিংস অ্যাকাউন্টে জমা করতে থাকুন। তারপর যখন এটা পনেরো, বিশ হাজার, পঁচিশ হাজার, তিরিশ হাজার, পঞ্চাশ হাজার হবে তখন আপনি একটা FDR করে ফেলুন। FDR-এর চাইতে ভালো রেট এখন সরকারি সঞ্চয়পত্র দিচ্ছে। তাহলে যে তিন চার মাস ইন্টারভেলে একটা করে সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছেন। কিন্তু সেভিংস বিল্ডআপ হচ্ছে। এফডিআর করতে পারেন, সঞ্চয়পত্রে রাখতে পারেন, লাইফ ইন্স্যুরেন্স করতে পারেন।

এছাড়া যেটা করতে পারেন সেটা হচ্ছে, বিভিন্ন ব্যাংকের বিভিন্ন ধরনের স্কিম আছে। দুই বছর, পাঁচ বছর, দশ বছর ইত্যাদি। এই স্কিমগুলোয় আপনার সঞ্চয়কে ঢোকাতে পারেন। ছোট ছোট সঞ্চয়, এটা কিন্তু একসময় অনেক বড় একটা রূপ ধারণ করে। ধরুন, প্রতি মাসে যদি পাঁচ হাজার টাকা রাখেন এটা দেখবেন দশ বছর পরে অনেক বড় একটা অ্যামাউন্ট হয়েছে। আর এখানে নিজের একটা বাধ্যবাধকতা চলে আসে। তখন প্রতি মাসে আপনার টাকাটা দিতে হবে। দেখবেন যে ওই টাকাটা থাকলে হয়তো অন্য কিছু করে উড়িয়ে দিতেন। সেটা না করে একটা স্কিমের মধ্যে ঢোকালেন। এই স্কিম হতে পারে ম্যারেজ স্কিম, হাউজিং স্কিম, হতে পারে এডুকেশন স্কিম।

যেকোনও একটা ব্যাংকে এটা করবেন না। ইন্টারনেট থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের রেট জেনে নিয়ে যেটা বেস্ট রেট মনে হয়, সেই রেটে এই স্কিমগুলো করবেন। কিন্তু আবার খেয়াল রাখতে হবে, স্কিমের চাপে যেন প্রচণ্ড কষ্ট না হয়। আপনার বাজেটিং করার সময় আপনি আয়-ব্যয়ের একটা হিসাব দাঁড় করাবেন। তারপর দেখবেন কত টাকা থাকছে। যে টাকাটা থাকে সেরকম একটা অ্যামাউন্ট, যেটা প্রতি মাসে অ্যাফোর্ড করতে পারেন, সেটা আপনি স্কিমের মধ্যে ঢোকাবেন।

আমি দেখেছি, যখনই বেতন বাড়ে তখন কেউ কেউ একটা নতুন স্কিম খোলে। এটা ভালো। সেভিংস করতে হলে আসলেই একটু স্যাক্রিফাইজ করতে হবে, অনেক আরাম আয়েশ, অনেক নেশা, অনেক আড্ডা থেকে আপনাকে দূরে থাকতে  হবে। কারণ আপনার আয় লিমিটেড কিন্তু খরচের অনেক জানালা।

সুতরাং, খরচ করতে চাইলে সহজেই করতে পারবেন, কিন্তু আয় করতে চাইলে কিন্তু এত সহজ না।

সেদিন আমি রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, আমার সামনে একজন মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। আমার অনুমান হলো উনি তাঁর স্ত্রীর সাথে কথা বলছেন। আমি শুনে খুব মজা পেলাম, উনি বলছেন দুনিয়ার সবচেয়ে সহজ কাজ কি জানো? সবচেয়ে সহজ কাজ হচ্ছে খরচ করা। আর সবচেয়ে কঠিন কাজ আয় করা। আর আমি বলি, এর চাইতেও কঠিন কাজ হচ্ছে নিজের লোভকে সংবরণ করে সঞ্চয় মনোভাব গড়ে তোলা। কিন্তু আয় করা যতটা গুরুত্বপূর্ণ, সঞ্চয় করাটা তারচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সঞ্চয় আপনার পরিবারের মেম্বারদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্যে দরকার।

এখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি যে অবস্থায় চলছে আমরা সঞ্চয় করবো কীভাবে? এই প্রশ্ন কিন্তু অমূলক নয়। এখন সঞ্চয় করতে হলে মনকে আরও শক্ত করতে হবে।

এখন ইনফ্লেশনের কারণে আমাদের প্রকৃত আয় কমে গেছে, ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে। আগে আপনি ১০০ টাকায় যে জিনিস কিনতেন, এখন আপনি ১০০ টাকায় সেই জিনিস কিনতে পারবেন না। এর মধ্যে আপনি সঞ্চয় করবেন কীভাবে? এটি কঠিন, আদৌ সহজ নয়। দুটি পথ খোলা আছে, একটি হচ্ছে ইনকাম বাড়ানো, যেটাও কঠিন কিন্তু চেষ্টা করলে বাড়ানো যায়। আর যদি আয় বাড়ানো না যায় তাহলে খরচের মধ্যে এডজাস্টমেন্ট করতে হবে। আপনার সেভিংস ঠিক রাখতে হবে। সেভিংস নষ্ট করা যাবে না। কারণ, আপনি জানেন না, এই যে কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি, এর চেয়েও কঠিন সময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে কিনা। সামনে নির্বাচন আছে। সরকার পরিবর্তন হয় কি হয় না আমরা জানি না। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ কতদিন চলবে আমরা জানি না। অনেক কিছুর প্রভাব আছে অর্থনীতিতে। ফলে সামনে যদি আরও খারাপ সময় আসে আর আপনার সেভিংস যদি শূন্য থাকে, তখন আপনার জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে পড়বে। তার চেয়ে বরং আপনার খরচকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করুন।

আমি যে পরামর্শগুলোর কথা উল্লেখ করলাম, এগুলো মেনে চললে আপনার দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় বাড়াতে পারবেন। এর মধ্যে যদি বোনাস একটু বেশি পান, কোন জায়গা থেকে আপনার বাড়তি আয় চলে আসে, আপনি কাউকে ধার দিয়েছিলেন সেই টাকা যদি ফেরত পান, তাহলে এই টাকাগুলো আপনি খরচের খাতায় লিখবেন না। এটি সরাসরি ব্যাংকে রেখে দিন। একটি গাছ যেমন একটি বীজ থেকে অসংখ্য ফল দেয়, একটি মাছ যেমন অনেক পোনা দেয়, ছোট ছোট সেভিংসও ঠিক তেমনই আপনার টাকাকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়।

কম্পাউন্ড ইফেক্ট কিন্তু দুর্দান্ত। একটা সময় দেখবেন টাকা জমা হতে হতে অনেক টাকা হয়ে গেছে। তখন সেই টাকা আপনি প্রয়োজন মতো ব্যবহার করতে পারবেন। আজ থেকে সঞ্চয় শুরু করবেন, যদি রিটায়ারমেন্টের আগে আপনি যে জীবন নির্বাহ করছেন, ঠিক একই মতো জীবন নির্বাহ করতে চান।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জন্ম আর মৃত্যুর সুরেলা মেলবন্ধনের প্রতিধ্বনি
৩৫তম জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত উৎসবজন্ম আর মৃত্যুর সুরেলা মেলবন্ধনের প্রতিধ্বনি
দারুণ সেঞ্চুরিতেও রাব্বির কাছে ম্লান সাকিব
দারুণ সেঞ্চুরিতেও রাব্বির কাছে ম্লান সাকিব
গাজীপুরে ট্রেন দুর্ঘটনা: স্টেশন মাস্টারসহ ৩ জন বরখাস্ত
গাজীপুরে ট্রেন দুর্ঘটনা: স্টেশন মাস্টারসহ ৩ জন বরখাস্ত
খিলগাঁওয়ে ছাদ থেকে পড়ে যুবকের মৃত্যু
খিলগাঁওয়ে ছাদ থেকে পড়ে যুবকের মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ