X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

গাজীপুরের পাঁচ আসনে কী হচ্ছে?

আমীন আল রশীদ
২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৫:১২আপডেট : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৫:১২

আগামী ৭ জানুয়ারি হতে যাওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটু পেছনে ফেরা যাক। গত ২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে জয়ী হন আলোচিত রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন—এই নির্বাচনের আগে যার নামের সঙ্গে দেশের মানুষ তো বটেই, গাজীপুরের সাধারণ মানুষেরও খুব একটা পরিচয় ছিল না।

মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময়ই সম্ভবত জাহাঙ্গীর আলম ধারণা করেছিলেন যে তার মনোনয়নপত্রটি বাতিল হতে পারে। সে কারণে তিনি একইসঙ্গে তার মায়ের পক্ষেও মনোনয়নপত্র জমা দেন। অর্থাৎ জায়েদা খাতুন ছিলেন জাহাঙ্গীর আলমের ‘ডামি প্রার্থী’। পুরো নির্বাচনটি হয়েছে মূলত আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খান বনাম জাহাঙ্গীর আলমের মধ্যে।

গাজীপুরের রাজনীতিতে জাহাঙ্গীর আলম বরাবরই বড় ফ্যাক্টর। সাবেক এই সিটি মেয়র এবারের নির্বাচনে গাজীপুর-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু পাননি। এই আসনে নৌকার মাঝি ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল। তবে নিজে প্রার্থী না হলেও ভোটের মাঠে সক্রিয় জাহাঙ্গীর আলম। বলা হচ্ছে, এবার গাজীপুরের পাঁচটি আসনের মধ্যে চারটি আসনের নৌকা প্রার্থীর জন্যই বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা—যাদের পেছনে আছেন জাহাঙ্গীর আলম। কিন্তু কেন?

রাজধানী ঢাকার খুব কাছে শিল্পাঞ্চলখ্যাত গাজীপুর নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সারা দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর এক সপ্তাহ আগে ১৯ মার্চ গাজীপুরেই শুরু হয়েছিল প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ। সুতরাং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন তথা মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গাজীপুরের নাম।

বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহচর; পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকালীন বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ৯ মাস যার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে—সেই তাজউদ্দীন আহমদের জন্মভূমি এই গাজীপুর। তাজউদ্দীনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির সদস্য; সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশের প্রথম অ্যাটর্নি জেনারেল ফকির সাহাবউদ্দিন আহমদের জন্মও এই জেলায়। ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে নানাভাবেই জড়িয়ে আছে গাজীপুরের নাম।

এবারের নির্বাচনে গাজীপুরের পাঁচটি আসনের মধ্যে তিনটিতেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী নারী। গাজীপুর-৩ আসনের প্রার্থী আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা, খ্যাতিমান পার্লামেন্টারিয়ান রহমত আলীর মেয়ে রুমানা আলি টুসি। তিনি বর্তমানে সংরক্ষিত আসনেরও এমপি। গাজীপুর-৪ আসনের প্রার্থী তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে সিমিন হোসেন রিমি এবং গাজীপুর-৫ আসনের প্রার্থী মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং বর্তমান এমপি মেহের আফরোজ চুমকি। একটি জেলার পাঁচটি আসনের মধ্যে তিনটিতেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা নারী—এটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পারিবারিক লিগ্যাসি থাকলেও সামগ্রিকভাবে রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়নের আলোচনায় এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় কেসস্টাডি।

গাজীপুরের বাকি দুটি আসনের একটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এবং অন্যটিতে ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল। কিন্তু এবার ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি না থাকলেও নৌকার প্রার্থীরা নির্ভার নন। তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তাদের সতীর্থরাই। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েও পাননি এমন নেতারাই এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে চারটি আসনে নৌকার প্রার্থীদের ঘুম হারাম করে দিয়েছেন।  

স্থানীয়ভাবে খোঁজ-খবর নিয়ে যতটুকু জানা যাচ্ছে তাতে শুধুমাত্র গাজীপুর-৪ আসনে সিমিন হোসেন রিমি তুলনামূলকভাবে কম চাপে আছেন। দুর্ঘটনা না ঘটলে তার বিজয় মোটামুটি নিশ্চিত। কিন্তু বাকি চারজনকেই চোখ রাঙাচ্ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা—যাদের নেপথ্যে আছে ‘জাহাঙ্গীর আলম ফ্যাক্টর’। সুতরাং গাজীপুর আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হলেও এবার সেখানে ভোট হচ্ছে নৌকা বনাম আওয়ামী লীগ।

এবার সরকার তথা ক্ষমতাসীন দলের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিগত দুটি নির্বাচনের মতো এবারের নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ হতে না দেওয়া। দেশের অভ্যন্তরে বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী দলের চাপকে সরকারি দল খুব একটা পাত্তা না দিলেও বিদেশি চাপ, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপ আমলে নিতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু বহুদিন ধরেই অবাধ-সুষ্ঠু-অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য ভোটের বিষয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করছে এবং তাদের এই অবস্থানের পেছনে কারণ যাই থাক না কেন—যেহেতু তারা বিরাট শক্তি এবং তারা সত্যি সত্যি কোনও দেশের বিরুদ্ধে চলে গেলে যেহেতু তাদের মিত্ররাও সেই দেশের বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে, সে কারণে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল প্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের যত সমালোচনাই করুক না কেন, এবার একটি অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ ভোট করার ব্যাপারে সচেষ্ট। যেহেতু বিএনপি মাঠে নেই, অতএব সংখ্যায় অনেক বেশি দল ও প্রার্থী দেখানো এবং একটি প্রত্যাশিত মাত্রায় ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় ক্ষমতাসীনরা।

ভোটারের উপস্থিতি বাড়ানোর প্রধান কৌশল হচ্ছে ভোটকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করা। ভোট প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয় একাধিক শক্তিশালী প্রার্থীর অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। যেহেতু বিএনপি মাঠে নেই এবং জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য শরিকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি হয়েছে, ফলে বাকি আসনগুলোয় আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন এবং এখন পর্যন্ত এই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিষয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় অবস্থান সহনশীল। অর্থাৎ তারা মনে করছে যে, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে যেহেতু অনেক প্রভাবশালী প্রার্থী আছেন, ফলে তারা যদি নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর বিরুদ্ধে জয়ী হয়েও যান, তাতেও সরকার গঠনে কোনও অসুবিধা হবে না। কারণ সরকার গঠনের মতো আসন আওয়ামী লীগ এমনিতেই পাবে। কিন্তু নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলে সব প্রার্থীর টার্গেট থাকবে তাদের ভোটারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা। তাছাড়া নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণাও জমজমাট হবে। সব মিলিয়ে ভোটকে অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং উৎসবমুখর দেখানোর জন্য এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনরা নমনীয়। আর এই কারণেই এবার অনেক আসনেই নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে খোদ আওয়ামী নেতারাই মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। কোথাও কোথাও নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারাও অবস্থান নিয়েছেন।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, রাজাপুর ও কাঠালিয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত ঝালকাঠি-১ আসন থেকে নৌকা প্রতীক পাওয়া সদ্য সাবেক বিএনপি নেতা শাহজাহান ওমর বীর উত্তমের পক্ষে কাজ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ। ১৮ ডিসেম্বর রাতে দলের সাধারণ সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়। উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অভিযোগ, শাহজাহান ওমর বিএনপির নেতা থাকার সময় যে ভবনে বসতেন, সেটিকে নির্বাচনি কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করছেন। স্বাধীনতাবিরোধী ও তাদের সন্তানদের নিয়ে তিনি গণসংযোগ করেছেন। বিএনপির নেতা হিসেবে সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী থাকার সময় তিনি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিভিন্নভাবে নির্যাতন করেছেন। তাই দলীয় সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. মনিরুজ্জামানের পক্ষে দলের সবাই কাজ করবেন। (প্রথম  আলো, ২০ ডিসেম্বর ২০২৩)। অতএব ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত স্থানীয় দলীয় নেতাকর্মীদের অবস্থান যদি এরকম থাকে, তাহলে এখানে নৌকার পরাজয় হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আবার এখানে নৌকা হেরে গেলেও সেটি আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষতিকর কিছু হবে না। কারণ নৌকা হেরে গেলেও জিতবেন তাদের দলেরই লোক। শুধু তার মার্কা ভিন্ন।

গাজীপুরের হিসাব অবশ্য আলাদা। এখানে নৌকা বনাম আওয়ামী লীগের চেয়ে মূল ইস্যু জাহাঙ্গীর আলম—যিনি আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পরে ক্ষমা পেয়ে পুনরায় দলে ফিরেছেন। কিন্তু গাজীপুরের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যার দূরত্ব অনেক। শোনা যাচ্ছে, তিনি নিজে আওয়ামী লীগ নেতা হওয়া সত্ত্বেও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন মূলত ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এবং ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তার অবস্থানের কথা মোটামুটি ওপেন সিক্রেট। তার এই ক্ষোভের কারণ গাজীপুর সিটি নির্বাচন; যে নির্বাচনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ জাহাঙ্গীরের বিরোধিতা করেছে। সেই বিরোধিতার প্রতিশোধ নিতেই তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষে লড়াই করছেন। তাদের নির্বাচনি জনসভায় বক্তৃতা দিচ্ছেন।

১৮ ডিসেম্বর বিকেলেও তিনি গাজীপুর-৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আখতারউজ্জামানকে সঙ্গে নিয়ে একটি আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘‌‌জনগণকে যারা সম্মান করবে তাদের জনপ্রতিনিধি হওয়া দরকার। আমাদের আদর্শের ভাই আখতারউজ্জামান। তার আদর্শ ও নীতির সঙ্গে আমরা আছি।’

এদিন দুপুরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে রাজবাড়ী মাঠে গাজীপুর-১ আসনের (কালিয়াকৈর) স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. রেজাউল করিম, গাজীপুর-২ (সদর আসন) স্বতন্ত্র প্রার্থী কাজী আলিমুদ্দিন এবং গাজীপুর-৫ (কালিগঞ্জ) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আখতারউজ্জামানকে সঙ্গে নিয়ে  এক মঞ্চে বসেন জাহাঙ্গীর আলম। বলেন, ‘গাজীপুরে ২৪ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিয়ে আমি কাজ করছি। গার্মেন্টস শ্রমিকদের একটা বিশেষ ভূমিকা থাকবে এ নির্বাচনে।’

অতীতেও দেখা গেছে গাজীপুরের নির্বাচনে এই পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বড় ভূমিকা রাখেন। কখনো-সখনো তারাই ভোটের ফলাফল নির্ধারণ করেন। কর্মীবান্ধব কারখানা মালিক হিসেবে জাহাঙ্গীর আলমের পরিচিতি আছে। ফলে লাখ লাখ পোশাক শ্রমিক যে জাহাঙ্গীরের কথায় ভোটের সিদ্ধান্ত নেবেন—সেটি অসম্ভব কিছু নয়।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৩ সালের গাজীপুর সিটি নির্বাচনে যখন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খান বিএনপির প্রার্থী এম এ মান্নানের কাছে হেরে গিয়েছিলেন, সেখানেও জাহাঙ্গীর আলম ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছেন। ওই নির্বাচনে জাহাঙ্গীর আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নেন এবং ভোটগ্রহণের বেশ কয়েকদিন আগে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর পরেও প্রায় ৩০ হাজার ভোট পান। তার মানে ভোঠের মাঠে থাকলে হয়তো তিনি ওই নির্বাচনেও জয়ী হতেন। এরপর ২০১৮ সালের সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে গাজীপুরের মেয়র নির্বাচিত হন জাহাঙ্গীর। কিন্তু বেশিদিন থাকতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করায় ২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর তিনি দল থেকে বহিষ্কৃত হন। পরে মেয়র পদও খোয়ান। পরে অবশ্য দল তাকে ক্ষমা করে দেয়। কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তার বিরোধ ঘোচেনি। এবার জাতীয় নির্বাচনে তার প্রভাব কতটুকু পড়বে—সেটিই দেখার বিষয়।

এটা ঠিক যে, পোশাক কারখানার শ্রমিকদের ওপর জাহাঙ্গীর আলমের ভীষণ প্রভাব রয়েছে। উপরন্তু এবার গাজীপুরের চারটি আসনে (গাজীপুর-৪ বাদে) যারা নৌকার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছেন, তারাও স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা এবং তাদেরও প্রচুর ভোট আছে।

জাতীয় নির্বাচনে ব্যক্তির চেয়ে প্রতীক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলেও লড়াইটা যখন নৌকা বনাম আওয়ামী লীগ—তখন সেখানে মার্কার চেয়ে ব্যক্তিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেন। বিশেষ করে জাহাঙ্গীর আলমের মতো ব্যক্তি যেখানে সরাসরি স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, সেখানে ভোট যদি সত্যিই অবাধ-সুষ্ঠু- নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত হয়, তাহলে একাধিক নৌকার প্রার্থী এবার গাজীপুরে হেরে যেতে পারেন।

তবে শুধু গাজীপুর নয়, এবারের নির্বাচনে আরও বেশ কিছু আসনেই আওয়ামী লীগ নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে দলের প্রার্থীদের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন ‘হেভিওয়েট’ প্রার্থীও রয়েছেন। গণমাধ্যমের খবর বলছে, ভোটের মাঠে বিএনপি না থাকলেও এবার অন্তত ১৫ জন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর জয় পাওয়া কঠিন, কারো কারো ক্ষেত্রে অনিশ্চিত। তাদের মধ্যে গাজীপুরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এবং ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল ছাড়াও শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ হুমায়ূন, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ, খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান দুলাল, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীমও রয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের আসনেই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা শক্তিশালী। সুতরাং এসব আসনে নৌকার প্রার্থীরা এবার খুব সহজেই জয় পেয়ে যাবেন—এমনটি ভাবার কোনও কারণ নেই।

বিএনপি এবার নির্বাচনে কেন আসেনি বা আসতে পারেনি—সেটি অন্য তর্ক। কিন্তু তারা ভোটের  মাঠে থাকলে একরকম হিসাব হতো। তখন আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীদের স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনের সুযোগ দিতো না। বরং মনোনয়নবঞ্চিতদেরকে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার নির্দেশ দিতো এবং কেউ এর ব্যত্যয় ঘটালে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করতো। একইভাবে জাতীয় পার্টিকে ২৬টি আসন ছেড়ে দিলেও তারা নিজেদের দলীয় প্রতীকে নয়, বরং নৌকা প্রতীকেই ভোট করতো এবং দেনদরবার করে হয়তো আরও বেশ কয়েকটি আসন চাইতো। কিন্তু মাঠে যেহেতু বিএনপি নেই এবং এ কারণে দেশের অন্যতম প্রধান এই দলের বিপুল সংখ্যক ভোটার এবার ভোটকেন্দ্রে যাবেন কি না সেটিও অনিশ্চিত—ফলে এবার আওয়ামী লীগকে ভোটের অংক কষতে হচ্ছে একটু অন্যভাবে।

নির্বাচনের আমেজ ঠিক রাখা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক হওয়া নিশ্চিত করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু তারপরও যদি শেষমেষ তাদের মনে হয় যে, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা অনেক বেশি আসনে নৌকার প্রার্থীদের জন্য বিপদ ডেকে আনছেন; বিশেষ করে শরিক জাতীয় পার্টি, জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থীরাও যদি বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যান—তখন আওয়ামী লীগ কি স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত বদলাবে? অর্থাৎ দলীয় প্রার্থীর পক্ষে সবাইকে কাজ করার নির্দেশনা জারি করবে নাকি অনেকগুলো আসনে আওয়ামী লীগ এবং শরিক দলের প্রার্থীদের পরাজয়ের শঙ্কা থাকলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ব্যাপারে ক্ষমতাসীন দল নমনীয়ই থাকবে—যাতে করে শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠ গরম থাকে?

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মাটি কাটার সময় 'গরমে অসুস্থ হয়ে' নারী শ্রমিকের মৃত্যু
মাটি কাটার সময় 'গরমে অসুস্থ হয়ে' নারী শ্রমিকের মৃত্যু
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
কান উৎসব ২০২৪স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ