X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষিতে অশনি সংকেত

মোস্তফা হোসেইন
১৬ জানুয়ারি ২০২৪, ২১:৩৬আপডেট : ১৬ জানুয়ারি ২০২৪, ২১:৩৬

কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবেন কৃষিমন্ত্রী উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহিদ। সচিবালয়ে কাজে যোগ দিয়ে প্রথম দিনই বলেছেন তিনি। জীবনভর কৃষক ও সাধারণ মানুষের পাশে থাকা এই প্রবীণ রাজনীতিবিদ কৃষকের সুখ-দুঃখ সম্পর্কে ভালো জানেন। তার এলাকায় গিয়ে তেমনটা দেখেছি বেশ কয়েক বছর আগে। তার জনপ্রিয়তা এবং অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটবে মন্ত্রিত্বে, এটুকু আশা করা যেতেই পারে।  

তবে কাজের সাফল্য নির্ভর করবে অগ্রাধিকার যাচাইয়ের ওপর। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদনের চাকাটা উন্নয়নের সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে। অন্তত বাজারে গেলে যেকোনও কৃষিপণ্যের সহজপ্রাপ্যতা তাই প্রমাণ করে। কিন্তু উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বাজারের কৃষিপণ্য ভোগ করা সবার জন্য হয়ে ওঠে না। এর সঙ্গে যুক্ত আছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বিষয়টি। বাজারে অঢেল পণ্য থাকলেও তাই সাধারণ মানুষের তেমন উপকারে আসে না। যদিও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কৃষি খাতের উন্নয়ন একটি পথ মাত্র।

কৃষিমন্ত্রীর আশাবাদের সঙ্গে যুক্ত করে কিছু বলার ইচ্ছায় এই নিবন্ধ লেখা। আশার কথা, আমাদের দেশের কৃষি বিভাগীয় সরকারি কর্মীদের আর আগের মতো বসে বসে বেতন নেওয়ার প্রবণতা তেমন নেই। তারা কৃষকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। উৎপাদনে নতুনত্ব আনার ব্যাপারে গ্রাম পর্যায়ে তাদের রুটিন যোগাযোগের প্রমাণ আমি ব্যক্তিগতভাবেও পেয়েছি। সেটা সম্ভব হয়েছে আমার গ্রামের বাড়ির সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কারণে।

উৎপাদন বৃদ্ধিই একমাত্র কৃষি উন্নয়ন নয়, সেই বিষয়টি তখন আমি প্রত্যক্ষ করেছি। কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায় আমার গ্রামের বাড়ি। ২০২০ সালের দিকে কৃষি বিভাগীয় কর্মীরা উদ্যোগী চাষি হিসেবে কয়েকজনকে জানালো, তাদের কাছে কচুর লতি চাষের বিষয়ে বেশ সুন্দর একটি অফার আছে। কয়েকজন অফারটি গ্রহণ করে। আসলেও নতুনত্ব আছে লতি চাষে। আমরা এর আগে জানতামও না কচুর লতির জন্য আলাদা কচুগাছ আছে। কৃষি বিভাগীয় সহযোগিতায় কুমিল্লা থেকে গ্রামের উদ্যোগী কৃষকরা লতির কচুর চারা সংগ্রহ করেন। সেখানে দেখা গেলো চারাগুলো নামমাত্র মূল্যে দেওয়া হচ্ছে। চারা লাগানোর পর নতুন কৃষিদ্রব্য হওয়ায় নিয়মিত কৃষি বিভাগের লোকজন তদারকি করতে থাকেন। কখন সার প্রয়োগ করতে হবে সবই তারা দেখিয়ে দিলেন।

ফলনকালে অবাক করে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটলো। আমি যার কথা বলছি, তিনি আনুমানিক ৪৫ শতাংশ জমিতে কচুর লতি চাষ করলেন। একসময় দেখা গেলো, প্রতি দুই দিনে তার উৎপাদন এক মণের বেশি হতে শুরু করে। তিনজন চাষির মধ্যে একজনের চাষের জমি প্রায় দেড় একর ছিল। তারা যখন বাজারে লতি নিতে শুরু করেন তখন দেখা যায় চাহিদার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি তারা সরবরাহ করছেন। আজকে অবিশ্বাস্য মনে হলেও মাত্র তিন বছর আগে এই লতির কেজি নেমে গেলো ১০ টাকা দরে।

একদিন দেখা গেলো জমি থেকে লতিগুলো উঠিয়ে জমির পাশে গর্তে ফেলে দিচ্ছে। মোবাইলে সেই ছবি দেখে খুশি ও এবং কষ্ট পেলাম। আমরা ঢাকায় তখন ৫০ টাকা কেজি লতি কিনে খাই। আর গ্রামে সেগুলো গর্তে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। কারণ জিজ্ঞেস করলাম, কৃষকের জবাব- একজন কৃষি শ্রমিকের রোজ ৫০০ টাকা। একদিনে একজন কৃষি  শ্রমিক ১ মণের বেশি লতি তুলতে পারে না। এই এক মণ লতি বাজারে নিতে লাগে ১০০ টাকা ভ্যান ভাড়া। অর্থাৎ জমি থেকে বাজারে নিয়ে যেতেই মণপ্রতি খরচ হয় ৬০০ টাকা। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা। জমি চাষ থেকে শুরু করে পরিচর্যা করতে গিয়ে প্রতি মণে আরও অন্তত ১০০ টাকা বেশি খরচ হয়েছে। বাজার দর অনুযায়ী প্রতি মণ লতিতে ওই কৃষকের প্রত্যক্ষ লোকসান ৩০০ টাকা।

ওই সময় আমি কৃষি বিভাগে যোগাযোগ করে জানতে পারি, সরকারের কৃষি বিপণন বিভাগ নামে একটি দফতর আছে। তাদের অবস্থান জেলা শহরে। আর তাদের লোকবল বলতে দুই তিন জন। তাও কাজ নেই।

কচুর লতি চাষ করে বাজারজাতকরণের এই দুরবস্থার কারণে ওই চাষিরা অধিক উৎপাদনের এই কৃষিতে সম্পূর্ণ বিরক্তবোধ করতে থাকলেন। এরপর আর তারা লতি চাষের কথা মুখেও আনতে চাইছেন না। আর এটাই স্বাভাবিক। শুধু উৎপাদন বৃদ্ধি করে কৃষক লাভবান হতে পারে না, যদি উৎপাদিত দ্রব্যের বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক না থাকে। বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে কৃষি বিপণন ব্যবস্থাপনা বলতে কিছু আছে বলে মনে হয় না। তাই উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিপণন ব্যবস্থার দিকটিও অগ্রাধিকার প্রাপ্য বলে মনে করি।

’হুজুগে বাঙাল’ বলে একটা কথা আছে। বাংলাদেশের কৃষি ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য।

যদি কোনও বছর কোনও পণ্যের দাম বাড়ে কিংবা চাহিদা বেড়ে যায়, তখন কৃষকরা ওই পণ্য উৎপাদনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশে ধান উৎপাদনে অবিস্মরণীয় উন্নয়নের কথা বলা যায়। আমার এলাকার কথাই বলি। একসময় আমাদের এলাকায় রবিশষ্য উৎপাদন হতো। সরিষা, আলু,পেঁয়াজ,রসুন,মরিচ ইত্যাদি চাষ হতো। তখনও বড় একটি অংশের জমিতে ধান চাষ হতো। কিন্তু যে মুহূর্তে চালের চাহিদা বেড়ে গেলো এবং চালের দাম বেড়ে গেলো। মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়লো ধান চাষে। আমাদের এলাকায় তারপর একটি ফসল উৎপদনে সবাই মনোযোগী হলো। বছরে তিনবার তারা ধান উৎপাদন করছে। বিজ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদ কিছুটা বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদনেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হলো। কিন্তু তারা উৎপাদন ব্যয় তুলতে হিমশিম খাচ্ছে এখন। অন্যদিকে ধান বিক্রি করে তেল নুনের মতো পেঁয়াজ মরিচ রসুন ইত্যাদি কিনতে গিয়ে চোখে মুখে সরিষা ফুল দেখছে।

এখানে স্পষ্টত কৃষি ব্যবস্থাপনার ত্রুটি চোখে পড়ে। আমার মনে হয়, আমাদের এখানে কৃষি ব্যবস্থাপনা বলতে কিছু নেই যদি থাকতো তাহলে কৃষককে পরামর্শ দেওয়া হতো চাষাবাদে ভিন্নতা আনার জন্য। এই মুহূর্তে উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে যেমন নজর দিতে হবে তেমনি গোটা কৃষি ব্যবস্থাপনায়ও সরকারকে আন্তরিক হতে হবে।

চোখের সামনে অশনি সংকেত কৃষি খাতে। কিন্তু এই পর্যন্ত মোটেও সেদিকে কেউ তাকাচ্ছে না  উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে, আমিও বললাম কৃষি ব্যবস্থাপনার কথা এবং বিপনন ব্যবস্থাপনার কথা। সবই নির্ভর করে চাষাবাদের ওপর। কিন্তু চাষের জমিইতো নাই হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের এমন কোনও গ্রাম পাওয়া যাবে না, যেখানে কৃষি জমিতে ধাই ধাই করে বাড়ি নির্মাণ হচ্ছে না। অকল্পনীয়ভাবে কৃষিজমি কমছে। এদিকটিতে আজ পর্যন্ত কোনও সরকার নজর দিচ্ছে না। পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে গেলে কৃষি জমির এই ক্ষয় রোধ করা সম্ভব। গ্রামে দেখেছি, প্রবাসী শ্রমিকরা টাকা পাঠানোর সময়ই বাড়িতে থাকা বাপ-ভাইকে বলে- নতুন বাড়ি করার জন্য তারা যেন জমি কিনে। এভাবে আশেপাশে কৃষি জমিতে বাড়ি তৈরি হচ্ছে। জমি কমে যাচ্ছে। বিষয়টি এককভাবে কৃষি মন্ত্রণালয় কিংবা কৃষি বিভাগের নয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তথা সরকারকে অত্যন্ত গুরুত্বসহ ভাবতে হবে, কীভাবে কৃষি জমিকে রক্ষা করা যায়। যেহেতু কৃষি জমি কমে যাচ্ছে তাই তাদের ভূমিকা নিতে হবে ভুক্তভোগী হিসেবে।

পরবর্তী সমস্যা হচ্ছে কৃষি শ্রমিক। প্রচুর পরিমাণে কৃষি শ্রমিক এখন বিদেশে চলে গেছে বাড়তি আয়ের জন্য। তারা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। এটা আমাদের অর্থনীতির জন্য অবশ্যই উল্লেখযোগ্য দিক। ফলে কৃষিখাতে তৈরি হয়েছে শ্রমিক সংকট। কৃষি শ্রমিকের ঘাটতি পূরণের জন্য আমাদের যে হারে যান্ত্রিক চাষাবাদে যাওয়ার কথা, সেই হারে আমাদের কৃষি পৌঁছাতে পারেনি। ট্রাক্টর থেকে কমপোজিট হার্ভেস্টার আমাদের আশার আলো দেখালেও যান্ত্রিক চাষের প্রাথমিক ব্যয় নির্বাহ করা আমাদের কৃষকদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এদিকটিতেও নজর দিতে হবে।

নগরায়ন ও জনচাহিদা পূরণে জলাধারগুলো ভরাট হচ্ছে উদ্বেগজনক হারে। তার প্রভাব পড়ছে কৃষিতে-পরিবেশে। অথচ জলাধার রক্ষায় আইন রয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে চলে যাচ্ছে চাষাবাদে গভীর নলকূপ ব্যবহারের কারণে। বিকল্প কিছুই এই পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। এই বিষয়টিও ভাবা দরকার।

কৃষিমন্ত্রীর আশাবাদগুলো বাস্তবায়ন হোক, এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশে নতুন পথ হোক।

লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাশিয়ার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আকাশসীমার নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগ এস্তোনিয়ার
রাশিয়ার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আকাশসীমার নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগ এস্তোনিয়ার
কেএনএফ দমন অভিযান: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি
কেএনএফ দমন অভিযান: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি
জিএসটির ‘এ’ ইউনিটের ফল প্রকাশ, পাসের হার ৩৩.৯৮ শতাংশ
জিএসটির ‘এ’ ইউনিটের ফল প্রকাশ, পাসের হার ৩৩.৯৮ শতাংশ
নির্দেশনা না মেনে বিদ্যালয় খোলা রাখলে ব্যবস্থা: শিক্ষামন্ত্রী
নির্দেশনা না মেনে বিদ্যালয় খোলা রাখলে ব্যবস্থা: শিক্ষামন্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ