X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

‘আদিবাসী’ ও আঞ্চলিক ভাষার বিপন্নতা কেন?

দীপংকর গৌতম
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২০:২০আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:২৫

ভাষা আসলে একটি অদ্ভুত প্রতীকী ব্যবস্থা, যেখানে সচেতনতার উপাদানগুলো- যেমন বহির্জগতের অভিজ্ঞতা, আমাদের চিন্তা, অনুভব ইত্যাদি সম্পর্কিত হয় মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর কতগুলো বিশেষ অঞ্চলের কাজের সঙ্গে। আমরা যখন কথা বলি তখন ক্রমাগত শরীরের প্রতিটি অঙ্গ চালিত হয়, সমন্বিত হয়। ভাষা ব্যবহারের সময় অসংখ্য প্রতীকী শব্দ যখন একই সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কে ব্যবহৃত হয়, তখন একটি জটিল ধারণা বা চিন্তার সমন্বিত প্রবাহ এর সঙ্গে সূত্রবদ্ধ হয়। ভাষা এমন এক অস্ত্র, একটি হাতিয়ার, যা আমাদের ভাবনা, কল্পনা, অভিজ্ঞতা, আকাঙ্ক্ষা, আবেগ বা যুক্তির সব ধরনের অভিব্যক্তিকে ধারণ ও সঞ্চালিত করতে পারে। আমাদের ভাষা চিন্তার সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের বিষয়টি সম্পর্কিত।

‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠীগুলোর (ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী) শিশুরা জন্মের পর থেকেই তাদের ভাষা ও বাংলা ভাষা দুটিই শেখে। তাদের বলা যায় দ্বিভাষিক। তাদের ভাষা বিকাশশীল নয়, বিলীয়মান ভাষারূপে তালিকাভুক্ত। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা বাদ দিয়ে শুধু তাদের গোষ্ঠীগত ভাষায় যদি শিক্ষার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়, তাহলে কি তাদের উন্নতির সুযোগ বাড়বে?

অধ্যাপক ডক্টর আহমদ শরীফ তাঁর লেখা প্রবন্ধ ‘জন্ম যদি তব বঙ্গে’-এ লিখেছেন, ‘বাঙলা করেছে শিক্ষার মাধ্যম, যদিও এখনো ইংরেজিই বাস্তবে চাকরি-বাকরি আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি-কূটনীতি ক্ষেত্রে আবশ্যিক ও অপরিহার্য ভাষা। কাজেই বড় চাকরি যেন ধনী-সামন্ত-বুর্জোয়া বেনেদের আয়ত্তে থাকে শাসন-প্রশাসন-অর্থ-সম্পদ প্রভৃতির মতো, সে ব্যবস্থাই রাখা হয়েছে।’ সত্যি, বাংলা বড় দুর্ভাগা থেকে গেলো আজ অবধি।  

আমাদের দেশে প্রায় ৭০টি (মতান্তরে ৪৫টি)  ‘আদিবাসী’দের (ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর) ২৫ লাখেরও বেশি মানুষ বাস করে। হাজার বছরের সংস্কৃতি পরম্পরা ও ভাষিক ঐতিহ্য রয়েছে তাদের। সেসব ভাষা ও বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক রীতি-নীতির রঙ ও রসে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, দেশে বাংলাসহ মোট ভাষা রয়েছে ৪১টি। যার মধ্যে ‘আদিবাসী’দের (ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর) ভাষা আছে ৩৩টি।

এর মধ্য থেকে ১৪টিকে বিপন্ন ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন গবেষকরা। একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেছে রাজবংশী, রাই, বাগদি, কোচ, হদি, কুঁড়ুখ, আদি মালতো ও ভালুর মতো আরও কয়েকটি ভাষা। বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে খাসিয়া, সাঁওতাল, মুন্ডা, মান্দি (গারো), ককবরক, লালেং (পাত্র), পালিয়া, মৈতেয়মণিপুরী, খুমি, বম, খেয়াং, পাংখো, লুসাই, ম্রো, চাক, ঠার বা থেক, মারমা, চাকমা, বিষষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, সাদরি ও হাজং। এ ছাড়া সিং, কর্মকার, গন্ড, বেদিয়া, বর্মণ ও লোহার ভাষা প্রায় বিলুপ্তির পথে।

ইউনেস্কোর সূত্রমতে, পৃথিবীতে কোনও ভাষায় কথা বলা মানুষের পরিমাণ যদি পাঁচ হাজারের কম হয় তাহলে সে ভাষাকে বিপন্ন ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সে হিসেবে বাংলাদেশে বিপন্ন ভাষার সংখ্যা ১৪টি। বাংলা-ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষার ক্রমাগত আগ্রাসনের কারণে সব আদিবাসী ভাষাই বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে।

ভাষা গবেষকরা সম্প্রতি বাংলাদেশে এমন ভাষাভাষী মানুষের খোঁজ পেয়েছেন, যারা সংখ্যায় হাতে গোনা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, কয়েক বছরের মধ্যে এসব ভাষার কোনও অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যাবে না। রাঙামাটির সাজেক অঞ্চলের শৌরা ভাষা তারই একটি, যে ভাষায় বর্তমানে কথা বলার মানুষ আছে মাত্র পাঁচ জন। একই এলাকার রেংমির্চা ভাষায় কথা বলেন ৩০-৪০ জন। এদের সবারই বয়স পঞ্চাশের বেশি।

জীবিত এই মানুষগুলোর মৃত্যুর পরপরই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে এই ভাষাগুলো। কারণ তাদের উত্তর প্রজন্ম এ ভাষায় কথা বলে না। দৈনন্দিন জীবন, কাজকর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য, লেখাপড়ায় ওই ভাষার কোনও প্রয়োজন পড়ে না। ফলে চিরতরে হারিয়ে যাবে এ ভাষা। পাহাড়ি এলাকার এসব ভাষার পাশাপাশি সমতলেও একই রকম বিলুপ্তপ্রায় অবস্থায় রয়েছে কয়েকটি ভাষা।

দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী এলাকায় মাত্র ১৯টি পরিবারের শ’খানেক মানুষ কথা বলে ‘কড়া’ ভাষায়। একই অবস্থায় রয়েছে কোদা, মেগাম, পাঙ্গুখুয়া, বম, চাক, আসোচিন, মরু, কুকুক্স, প্নার, সৌরিয়া, খেয়াং, খোজী, কন্দু, মুন্ডা ইত্যাদি ভাষা। বিপন্নতার ঝুঁকিতে থাকা ভাষাগুলোর সুরক্ষায় বড় দাগে সরকারি কোনও উদ্যোগ নেই। তার মধ্যেই চলছে ভাষার বিন্যাস, ভাষার গতিপ্রবাহ।

বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসামসহ সমগ্র পৃথিবীর প্রায় ২৬ কোটি মানুষ এই ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করে থাকেন। এরপরও বাংলা ভাষার যে অবস্থা তা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। বর্তমানে পুঁজিবাদের কদাকার রূপে বাজার অর্থনীতির মধ্য দিয়ে বিভিন্ন ভাষার মিশ্রণ বাড়ছে। এতকালে বাংলা ভাষারও কোনও ভাষা নীতিমালা তৈরি হয়নি। ফলে ভাষার যে পরিবর্তন ঘটছে তা ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে।  

আমরা যে অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করি ভূ-প্রকৃতিগত অবস্থান অনুযায়ী আমাদের কণ্ঠের সহজাত সুরটি ভূ-প্রকৃতিগত কারণে তৈরি হয়। এখানে আরেকটা কথা বলা জরুরি। ভাষা তৈরি হয় মেহনতি মানুষের কাজের প্রয়োজনে। মেহনতি মানুষ যেখানে বসে কাজ করে সেখানের অবস্থান অনুযায়ী ভাষার কাঠামো ও সুর তৈরি হয়।

এ কারণে আমরা বাচনভঙ্গি, ভাষার কাঠামো ও সুরের মধ্য দিয়ে বুঝতে পারি বিভিন্ন জেলার ভাষার পার্থক্য। আবার ভাষা শুনে বুঝতে পারি কোন এলাকার মানুষ। একই ভাষা শুধু উচ্চারণের মধ্য দিয়ে তার অঞ্চল প্রকাশ করতে পারে। এটাই আঞ্চলিকতা। এই ভাষার উচ্চারণ ও ব্যবহার রীতিতে কিছু তফাত আছে প্রমিতের থেকে।

ভাষাবিজ্ঞানীরা যদিও বলেছেন, ১৫-২০ কিলোমিটার পরপর ভাষার পরিবর্তন দেখা দেয়। কিন্তু প্রাকৃতিক অবস্থান ভেদে ৮ কিলোমিটার অন্তরও ভাষা বদলে যায়। বিশেষত চট্টগ্রামে ভাষার প্রকৃতি খুব দ্রুত বদলে যায়। তবু এই বদলের মধ্যে বৈচিত্র্য আছে। বৈচিত্র্য আছে ভাষায়-ব্যবহারে-সুরে। সারা দেশের অঞ্চল ভেদে ভাষার বৈচিত্র্য একদম আলাদা।

এই ভাষার মাধ্যমে আঞ্চলিকতার গভীর বন্ধন গড়ে ওঠে। আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে আত্মার একটা ভিন্ন সম্পর্ক বিরাজ করে। কারণ একই অঞ্চলের ভাষার ব্যবহার রীতি বহু মানুষের ভেতরে একটা ভিন্ন সম্পর্ক তৈরি করে। নিজ নিজ অঞ্চলের ভাষার সঙ্গে মানুষের আত্মার একটা মেলবন্ধন থাকে। মানুষ জন্মের পর মায়ের কাছে যে ভাষাটা শেখে, সেটা তার অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করে। আঞ্চলিক ভাষা মিশে থাকে মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে।

বিশেষত একই আঞ্চলিকতার মানুষের সঙ্গে কথার মধ্য দিয়ে যে প্রাণ-প্রাচুর্যের সঞ্চার হয় সেটাও আলাদা। কিন্তু গ্রামের ভেতর শহর যত ঢুকে যাচ্ছে মানুষ তত বেশি ভদ্রলোক হওয়ার চেষ্টা করছে। সাধারণ মানুষের স্বাচ্ছন্দ্য তার আঞ্চলিক ভাষায়, সেখানে এখন যে তার নিজস্বতা হারাচ্ছে সেটা সে বুঝতে পারছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে যখন মশকরা করা হয়, তখন নিঃসন্দেহে বোঝা যায় শিক্ষার মান এগিয়েছে না পিছিয়েছে।

আঞ্চলিক ভাষা ক্রমশ উপেক্ষিত হয়ে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে আঞ্চলিক ভাষাই নগরে গিয়ে নাগরিক ভাষা বা মান ভাষায় রূপ নেয়। আমাদের নদীমাতৃক দেশ। জালের মতো ছড়ানো সব নদী। নদীর পারের মানুষের ভাষা সুরের বৈচিত্র্য একরকম, পাহাড়ের একরকম আবার সমতল অঞ্চলের একরকম। কিন্তু পরিবেশ প্রকৃতি উজাড় করে পুঁজিবাদ প্রকৃতিকে যেমন ধ্বংস করছে, তেমনি প্রাকৃতিক পরিবেশে কাজ করা মানুষগুলোর পেশাও কেড়ে নিচ্ছে।

আঞ্চলিক ভাষাকে নির্বাসনে দিয়ে মান ভাষা টিকতে পারবে কিনা এটাও একটা বিষয়। মানুষের মতো ভাষারও সমাজ আছে, শ্রেণি আছে। সেদিক থেকে আঞ্চলিক ভাষা অচ্ছুত হলেও ভাষা তৈরির কারিগর। এটা না বুঝলে সংকটের মুখোমুখি হবে ভাষাই। তাই এখনই বিষয়টি চিন্তায় আনা দরকার।

লেখক: সহকারী সম্পাদক, দৈনিক মানবকণ্ঠ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
অভিষেকে আস্থার প্রতিদান দিয়ে রেকর্ডবুকে তামিম
অভিষেকে আস্থার প্রতিদান দিয়ে রেকর্ডবুকে তামিম
এখনও উদ্ধার হয়নি পুলিশের অস্ত্র, মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশ
২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশে সহিংসতাএখনও উদ্ধার হয়নি পুলিশের অস্ত্র, মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশ
রিকশাচালকদের ছাতা বিতরণ করলেন মেয়র আতিক
রিকশাচালকদের ছাতা বিতরণ করলেন মেয়র আতিক
রেল ও সড়ক বিটের রিপোর্টারদের সংগঠনের নতুন কমিটি
রেল ও সড়ক বিটের রিপোর্টারদের সংগঠনের নতুন কমিটি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ