X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুনাফার লোভে মানুষের মৃত্যু বন্ধ হোক

আমিনুল ইসলাম সুজন
০৪ মার্চ ২০২৪, ১৯:৩৪আপডেট : ০৪ মার্চ ২০২৪, ১৯:৩৪

বেইলি রোড তথা নাটক সরণির যে ভবনটিতে আগুন লাগে তা প্রথম জানতে পারি কামরুজ্জামান ভাইয়ের (আহমেদ কামরুজ্জামান, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক) ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে। তার পোস্টের পর গণমাধ্যমে বিষয়টি দেখতে পারি। স্বল্প সময়ের আগুনে বাণিজ্যিক ভবনটিতে ৪৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত ও মর্মান্তিক। যারা মারা গেছেন তারা সবাই সুস্থ মানুষ ছিলেন। শিশু-কিশোর-তরুণ-যুব বয়সীরাই বেশি মারা গেছেন বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে।

এছাড়া মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন স্বয়ং এ বিষয়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন।

মৃত্যুর হিসাব তো সংখ্যায় বলা যায়। কারও কারও কাছে এটা শুধুই সংখ্যা মাত্র। কিন্তু অনেক পরিবারের কাছে স্বপ্ন, বেঁচে থাকার অবলম্বন। এভাবে অনেক স্বপ্নের অকাল সমাপ্তি ঘটলো। একটি কৈশোরোত্তীর্ণ ছেলে নাঈম দরিদ্র পিতার কষ্ট লাঘব করা এবং নিজের লেখাপড়ার ব্যয় নির্বাহ করার জন্য দারোয়ান হিসাবে চাকরি নিয়েছিল। ছেলেটির স্বাপ্নিক জীবনের সলিল সমাধি ঘটলো। ইতালি প্রবাসী সৈয়দ মোবারক স্ত্রী, কন্যা ও পুত্রকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে গেছেন এবং পুরো পরিবারের সবাই মারা গেলেন।

মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া রিয়া তার দু’কাজিনের সঙ্গে খেতে গিয়েছিলেন। তিন জনই না ফেরার দেশে চলে গেলেন। নাজমুল ও তার তিন বন্ধু রাতে খেতে গেছেন, তাদের দুজন মারা গেছেন, ১ জন মারাত্মক আহত।

ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষিকা তার মেয়েকে নিয়ে খেতে গিয়ে দুজনই লাশ হয়ে ফিরেছেন। যারা অগ্নিকাণ্ডে মারা গেছেন, সবারই স্বপ্নময় বর্ণাঢ্য জীবন ছিল। কিন্তু তাৎক্ষণিক আগুনে এসব স্বপ্ন অসমাপ্ত অবস্থায় শেষ হলো।

এত তাজা প্রাণের করুণ মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? এসব ভবন কীভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে? একটি ভবনে জরুরি নির্গমন ব্যবস্থা ও সিঁড়ি, প্রতিটি ফ্লোরের নকশা, ভবনের প্রবেশ ও বাহির হওয়ার পথ, পার্কিং, বাতাস চলাচলের অবস্থা (ভেন্টিলেশন), উন্মুক্ত ছাদ- এসব বিষয় ডিজাইনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এসব নিশ্চিত না করে রাজউক অনুমোদন দিয়েছে কিনা, সেটা দেখা প্রয়োজন। তাছাড়া ভবনটি কি বাণিজ্যিক নাকি আবাসিক অনুমোদন নিয়েছে সেটাও দেখা প্রয়োজন।

এরকম বহুমুখী ব্যবহৃত ভবনে জরুরি নির্গমন ব্যবস্থা আবদ্ধ থাকে কীভাবে? এটি দেখার দায়িত্ব কাদের? বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা যথাযথ আছে কিনা সেটা কারা দেখবেন? যেকোনও রেস্টুরেন্ট বা ব্যবসা করার জন্য সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হয়। যেকোনও ভবনে ব্যবসার অনুমোদন দেওয়া যায় কিনা? কোন ধরনের ভবনে কোন ব্যবসা করতে পারবে– এমন বিষয় গাইডলাইন আছে কিনা? বিপণি বিতান ও রেস্টুরেন্টগুলোতে দাহ্য পদার্থের ঝুঁকি রয়েছে। এসব অনুমোদন দেওয়া অর্থাৎ ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার সময় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সঙ্গে সমন্বয় করা হয় কিনা? ধূমপান অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মতে, প্রায় ১৮ শতাংশ অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী ধূমপান। সুতরাং অনুমোদন দেওয়ার সময় রেস্টুরেন্টগুলো ধূমপানমুক্ত রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয় কিনা?

বাংলাদেশে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী রেস্টুরেন্ট ধূমপানমুক্ত। এ আইন অনুযায়ী রেস্টুরেন্টগুলো ধূমপানমুক্ত রাখার কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কিনা?

এসব প্রশ্নের উত্তর কখনও পাওয়া যাবে কিনা, এ বিষয়ে সন্দিহান। কারণ, প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাই ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফা ও সংশ্লিষ্টদের অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের কারণে সৃষ্ট। এমন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলে দায় এড়ানোর সুযোগ নাই। কারণ এখানে কারও না কারও গাফিলতি ছিল। কোনও কোনও ক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘনের ঘটনাও ঘটে থাকে। বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্ব প্রাপ্তদের দায় এড়ানোর ঘটনাও থাকতে পারে। তদন্তে সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে অগ্নিকাণ্ড ও বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর কারণগুলো চিহ্নিত করা প্রয়োজন। এসব বিষয় চিহ্নিত করা গেলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।

একইসঙ্গে, এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে অনুরূপ ঘটনা যেন আর কোথাও না ঘটে। ধানমন্ডি, গুলশান, উত্তরা, বারিধারা, বনানী, মোহাম্মদপুর, নাটক সরণি (বেইলি রোড)-সহ ঢাকার সর্বত্র যেসব ভবনে রেস্টুরেন্ট ও বাণিজ্যিক ব্যবহার রয়েছে, সেগুলো নিরীক্ষা করে অগ্নিনির্বাপণ প্রতিরোধে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ভবনসমূহ অনুমোদিত ডিজাইন অনুযায়ী নির্মাণ ও ব্যবহার হচ্ছে কিনা তা তদারকির মাধ্যমে নিশ্চিত করতে রাজউককে দায়িত্ব নিতে হবে। ভবন নির্মাণের সময় কতিপয় তথ্য প্রদর্শন করতে হয়। ভবন নির্মিত হওয়ার পর ভবনের ডিজাইন দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শনের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। ছাদ উন্মুক্ত (ছাদকৃষি ব্যতীত), সিঁড়ি ও জরুরি নির্গমন পথ (যদি থাকে) উন্মুক্ত রাখা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে, সব ভবনের জরুরি বহির্গমন পথ ও সব সিঁড়ি উন্মুক্ত ও বাধাহীন রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। সব বিপণি বিতান ও বাণিজ্যিক ভবন শতভাগ ধূমপানমুক্ত রাখতে হবে। সেজন্য আইন অনুযায়ী ধূমপানমুক্ত সাইনেজ প্রদর্শন নিশ্চিত করতে হবে। সিটি করপোরেশনের রেস্টুরেন্ট ও ব্যবসার অনুমোদন (ট্রেড লাইসেন্স) দেওয়ার পদ্ধতি সংস্কার করার প্রয়োজন।

কোনও অবাণিজ্যিক ভবনে ব্যবসার অনুমোদন দেওয়া যাবে না। যেকোনও ব্যবসার অনুমোদন দেওয়ার সময় উক্ত ভবনের অনুমোদিত নকশা ও ভবনের বাস্তব ব্যবহার সরেজমিন পরিদর্শন করে অনুমোদন দেওয়া নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে, রেস্টুরেন্ট ও বিপণি বিতান অনুমোদনের সময় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পৃথক অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন।  

প্রসঙ্গত, নাটক সরণি (বেইলি রোড) এখন ঢাকার অন্যতম ব্যবসায়িক এলাকা। অসংখ্য খাবার দোকানের পাশাপাশি একাধিক বিপণি বিতান গড়ে উঠেছে এখানে। ব্যবসার কেন্দ্র হয়ে ওঠায় এখানে হর্ন, গাড়ি ও মানুষের ভিড়ে সরগরম থাকে। তার ওপর দেশের অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুলসহ তিনটি বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ সড়কে হওয়ায় সারা দিনই যানজট লেগে থাকে।  

বেইলি রোড একসময় বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন ও সংস্কৃতি চর্চার সূতিকাগার ছিল। পাশাপাশি না হলেও কাছাকাছি দুটি মিলনায়তনে নিয়মিত মঞ্চনাটক প্রদর্শিত হতো। গাইড হাউজ মিলনায়তন ও মহিলা সমিতি মিলনায়তন (যা নীলিমা ইব্রাহীম মিলনায়তন নামেও পরিচিত) নাট্য ও সংস্কৃতি কর্মীদের পদচারণায় মুখর ছিল। এছাড়া নাটক প্রদর্শনীতে সাধারণ দর্শকদের আগমনে জমজমাট থাকতো নাটকপাড়া। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর যেন মেলা বসতো। অফিস সময়ের পর থেকে আড্ডা চলতো রাত ১১টা অবধি। নাট্য সংগঠক, নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনয়শিল্পী-কলাকুশলী এবং বিনোদন সাংবাদিকরা এসব আড্ডায় যোগ দিতেন।

নাট্য ও সংস্কৃতি কর্মীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অধুনা ঢাকা সিটি করপোরেশন এই সড়কটির নাম বেইলি রোডের পরিবর্তে নাটক সরণি নামকরণ করেন। নাটক চর্চার পাশাপাশি এখানে বেশ কিছু বইয়ের দোকান ছিল এবং এসব দোকানে বিদেশি বইয়ের সন্ধান পাওয়া যেত। সাগর পাবলিশার্স তার মধ্যে অন্যতম। আশি, নব্বই ও এই শতাব্দীর প্রথম দশকের পর নাটক সরণি তার জৌলুস হারিয়েছে। হয়ে উঠেছে বাণিজ্যিক কেন্দ্র।

এ বাণিজ্যিক কেন্দ্র অতিরিক্ত মুনাফার লোভে মৃত্যুপুরী হয়ে উঠলো। ঢাকার আর কোন ভবনে যেন এমন ঘটনা না ঘটে সেজন্য সংশ্লিষ্টদের এখনই সতর্ক হতে হবে।

লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও কোষাধ্যক্ষ, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)।
[email protected],

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মাহিন্দ্র উল্টে চালকসহ ২ জন নিহত
মাহিন্দ্র উল্টে চালকসহ ২ জন নিহত
শিক্ষাবিদ প্রণব কুমার বড়ুয়ার মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর শোক
শিক্ষাবিদ প্রণব কুমার বড়ুয়ার মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর শোক
প্রধানমন্ত্রী দেশের পথে
প্রধানমন্ত্রী দেশের পথে
সুঁই-সুতোয় ‘স্বপ্ন বুনছেন’ ভোলার আমেনা খানম
সুঁই-সুতোয় ‘স্বপ্ন বুনছেন’ ভোলার আমেনা খানম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ