X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

৭ মার্চ-বাঙালির নবজাগরণের দিন

আবদুল মান্নান
০৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০১আপডেট : ০৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০১

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তখন রমনা রেসকোর্স) জাতির পিতা ১৯ মিনিটের কম সময়ের একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, যা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় সেই ভাষণ নিয়ে তেমন একটা চর্চার প্রয়োজন হয়নি, কারণ যিনি এই ভাষণটি দিয়েছিলেন, সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন জীবিত। ৭ মার্চের সেই পড়ন্ত বিকালে যাদের সেই ভাষণটি শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল আর যারা পরদিন পত্রিকা পড়ে জেনেছেন অথবা রেডিও-টেলিভিশন মারফত শুনেছেন, তাদের এই ভাষণের তাৎপর্য সম্পর্কে জানানোর তেমন একটা কিছু ছিল না। আমার নিজের সৌভাগ্য হয়েছিল সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হওয়ার।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর জেনারেল জিয়া ক্ষমতা দখল করে প্রথমে যে দুটি কাজ করেন তা হচ্ছে, বাংলাদেশে জাতির পিতার নাম উচ্চারণ নিষিদ্ধ করা আর ১৯৭১ সালে বাঙালি যে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা এনেছিল সেই সত্যটাকে চাপা দেওয়ার জন্য ‘পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী’র পরিবর্তে শুধু ‘দখলদার বাহিনী’ শব্দ দুটি আমদানি করা।

তাঁর শাসনামলে যে স্থানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণটি দিয়েছিলেন এবং যেখানে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল সেই স্থানটির গুরুত্ব খাটো করার জন্য সেখানে শিশুপার্ক নির্মাণ করেছিলেন।

প্রয়াত সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী, যিনি বিএনপি ঘেঁষা একজন সাংবাদিক ছিলেন, তিনি প্রেস ক্লাবের এক সেমিনারে এই সত্যটা উদ্ঘাটন করেছিলেন। বলেছিলেন, জিয়া চাননি কোনও মুসলিম জেনারেল অমুসলিমের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন, তার কোনও স্মারক বাংলাদেশে থাকুক। জেনারেল জিয়া পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনীর প্রিয়পাত্র ছিলেন। কারণ তিনি কর্মরত অবস্থায় পাকিস্তান সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের একজন সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন ঠিক, কিন্তু সেটি তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নয়, বরং নিজের জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়ে করেছিলেন। জিয়া ক্ষমতা দখল করে ১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দীর ঠিক একই স্থানে সিরাতুন্নবীর নামে রাজাকার আলবদরদের এক সমাবেশ আয়োজন করেছিলেন । সেই সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন জিয়া উপ-সেনা শাসক বিমানবাহিনী প্রধান এমএজি তোয়াব। পাকিস্তানি নাগরিক জার্মানিতে অবস্থানরত তার বন্ধু তোয়াবকে বাংলাদেশে এনে জিয়া বিমানবাহিনী প্রধান বানিয়েছিলেন। সেই সমাবেশে প্রধান বক্তা ছিলেন যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী। তার নেতৃত্বে সমবেত রাজাকার আলবদররা স্লোগান তুলেছিল ‘তোয়াব ভাই তোয়াব ভাই চাঁদ তারা মার্কা পতাকা চাই’ ।

মনে রাখতে হবে, বাঙালি যখন একাত্তরের উত্তাল মার্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি শুরু করেছে, তখন জিয়া চট্টগ্রামে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ডে দায়িত্ব পালনরত এবং ২৫-২৬ মার্চের রাত পর্যন্ত পাকিস্তানের কার্গো জাহাজ সোয়াত থেকে বাঙালি হত্যার জন্য আনীত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অস্ত্র আর গোলাবারুদ খালাসের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর অভিমুখে রওনা দিয়েছিলেন। পথে মুক্তিকামী বাঙালিদের কাছ থেকে বাধা পেয়ে ফিরে এসেছিলেন। জিয়ার ক্ষমতা দখল থেকে শুরু করে পরবর্তী ২১ বছর রাষ্ট্রীয়ভাবে ৭ মার্চের এই ঐতিহাসিক দিনটি পালন তো হয়ইনি, বরং এই দিনটি সম্পর্কে কোনও কর্মসূচি নেওয়ার ওপর ছিল একটি অলিখিত নিষেধাজ্ঞা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরবর্তী  ২১ বছর শুধু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো এই ভাষণের ওপর কিছু সভা-সমাবেশ করেছে।

ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণটিকে বিশ্ব সংস্থা ইউনেসকো ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ‘ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে’ বিশ্ব ঐতিহ্য সম্পদ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই ভাষণটি এখন বাংলাদেশ বা আওয়ামী লীগের একক কোনও সম্পদ নয়, এটি এখন বিশ্বের ইতিহাস-মনস্ক সমাজ ও সভ্যতার অতীত নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তাদের সবার সম্পদ। কেউ ইচ্ছা করলে আর এই ভাষণকে অস্বীকার করতে পারবে না। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জ্যাকব এফ ফিল্ড ৪৩১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসে বিভিন্ন জাতীয় বীর ও সেনাপতিদের মধ্য থেকে ৪১ জনকে নির্বাচিত করে ‘Speeches that Inspired Histor’  শিরোনামের একটি মূল্যবান গ্রন্থ সংকলন করেন এবং সেই গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এটি এখন অনস্বীকার্য যে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটি শুধু ঐতিহাসিকই ছিল না, এটি ইতিহাস সৃষ্টির কারণ হয়েছে এবং যারা ১৯৭১ সালে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন, তাদের অনুপ্রাণিত করেছে। বর্তমান প্রজন্মের হয়তো জানা নেই একাত্তরের ৯ মাসে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন নিয়মিত বিরতি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের অংশবিশেষ ‘বজ্রকণ্ঠ’ শিরোনামে প্রচারিত হতো, যাতে মাঠে-ময়দানে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধারা আর দেশের ভেতরে অবরুদ্ধ বাঙালিরা অনুপ্রাণিত হতে পারে।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর একাত্তরের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধটা হয়ে যায় ‘গণ্ডগোলের বছর’। জিয়া ক্ষমতা দখল করে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে লিখিত বাহাত্তরের সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের’ অংশটির পরিবর্তে প্রতিস্থাপন করেন ‘জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের’।

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল যখন মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়, সে সময় স্বাধীনতার যে ঘোষণাপত্রটি গৃহীত ও পঠিত হয়েছিল, তার ভিত্তি ছিল এই প্রস্তাবনা। ১০ এপ্রিল সেই ঘোষণাপত্র পাঠ করেই ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার শপথগ্রহণ করেছিল। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও প্রস্তাবনা একই সূত্রে গাঁথা। জিয়া সজ্ঞানে এই অপকর্মটি করেছিলেন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বাঙালির ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসকে মুছে ফেলার জন্য। বাহাত্তরের সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ অংশবিশেষ নিজের স্বার্থে মুছে ফেলা শুধু চরম হঠকারিতাই ছিল না, এটি একটি রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কর্মও ছিল। ১৯৭৮ সালে জিয়ার উপদেষ্টা পরিষদে কোনও সংসদ সদস্য বা আইন বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন না। তিনি নিজেই এই দফতরের দায়িত্বে ছিলেন এবং পরিবর্তনগুলো রাষ্ট্রপতির (জেনারেল জিয়া) আদেশ বলে করা হয়েছিল। সুতরাং এই অমার্জনীয় অপরাধের দায়দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে।

সংবিধানের প্রস্তাবনার পরিবর্তনের ফলে বাঙালির দীর্ঘ ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসকে যেমন অস্বীকার করা হয়েছে, ঠিক একই কায়দায় বাঙালির একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চ আর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকেই অস্বীকার করা হয়েছে। অথচ একাত্তরের ৭ মার্চ বা ২৫-২৬ তারিখ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের কোনও ইতিহাস রচিত হতে পারে না।

১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে গণপরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে বাংলাদেশ ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে। এই নির্বাচনে পাকিস্তানের উভয় অংশের জনগণের সংখ্যা অনুপাতে পূর্ব বাংলার ভাগে পড়ে ১৬৯টি আসন। যে দুটি আসনে আওয়ামী লীগ জয়ী হতে পারেনি তার একটি ছিল ময়মনসিংহে নূরুল আমিনের আর পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজা ত্রিদিব রায়ের।

দেশ স্বাধীন হলে নূরুল আমিন ভগ্ন পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। নূরুল আমিনের মৃত্যু হলে জিন্নাহর কবরের পাশে তাঁকে কবর দেওয়া হয়েছে। রাজা ত্রিদিব রায়কে করা হয়েছিল পর্যটন বিষয়ক মন্ত্রী এবং ভুট্টো তাকে জাতিসংঘে পাঠিয়েছিলেন বাংলাদেশের সদস্যপদ ঠেকানোর জন্য প্রচারণা চালাতে। প্রথম দফায় এতে তিনি সফলও হয়েছিলেন।

একটি নির্বাচনে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়, গণতান্ত্রিক রীতি-রেওয়াজ অনুযায়ী সেই দলই সরকার গঠন করে।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর এটি স্বাভাবিক ছিল বঙ্গবন্ধুই সরকার গঠন করবেন। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলারা কখনও চাননি পাকিস্তানের শাসনভার বাঙালিদের হাতে যাক। পাকিস্তানের জন্ম থেকেই এই আমলারাই ষড়যন্ত্রকে পুঁজি করে পাকিস্তানে কখনও গণতন্ত্রকে বিকশিত হতে দেননি। সত্তরের নির্বাচনের পরও তা অব্যাহত ছিল। ঘোষণা করা হয়েছিল, ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকায় গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসবে।

এই গণপরিষদের দায়িত্ব হবে পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান রচনা করা। বঙ্গবন্ধু নির্বাচনের আগে নির্বাচনি ইশতেহারে ঘোষণা করেছিলেন, তার দল ক্ষমতায় গেলে পাকিস্তানের সংবিধান হবে ঐতিহাসিক ছয় দফাভিত্তিক।

পাকিস্তানের আমলাতন্ত্রের (বিশেষ করে পাঞ্জাবি আমলাতন্ত্র) জন্য এটাও ছিল বিপজ্জনক। কারণ ছয় দফার মূল বিষয়ই ছিল কেন্দ্রের হাতে শুধু দেশরক্ষা আর পররাষ্ট্র বিষয় থাকবে, বাকি সব কিছুর নিয়ন্ত্রক হবে প্রদেশগুলো। দেশটি অনেকটা ফেডারেল কাঠামোর ভিত্তিতে পরিচালিত হবে আর প্রদেশগুলো নিরঙ্কুশ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে। বলা বাহুল্য, পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র এমন একটা সংবিধান যে মেনে নেবে না তা স্বাভাবিক।

নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া পাকিস্তানের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো ১ মার্চ ঘোষণা করেন, ‘হয় আসন্ন জাতীয় সংসদ অধিবেশন পিছিয়ে দেওয়া হোক, না হয় এলএফও (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক) সংবিধান প্রণয়নের জন্য ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জারি করা হোক সামরিক ফরমান।

এই ফরমানের বাইরে গিয়ে সংবিধান প্রণয়ন করলে তা ইয়াহিয়া খান বাতিল করতে পারবেন। বঙ্গবন্ধু আগেই ঘোষণা করেছিলেন, নির্বাচনে তাঁর দল জয়ী হলে তিনি এই ফরমান টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবেন। ভুট্টোর এই ঘোষণা ইয়াহিয়া খানের নির্দেশেই হয়েছিল, কারণ এর আগে ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। এ প্রেক্ষাপটেই ক্ষমতা হস্তান্তর  না করার ষড়যন্ত্র এবং ১ মার্চ দুপুরের সংবাদে রেডিও পাকিস্তানে ঘোষণা করলো, ৩ তারিখে অনুষ্ঠেয় গণপরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকাসহ দেশের সব শহর হয়ে উঠলো মিছিলের নগরী।

একটাই স্লোগান-‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’। অনেক  স্থানে যোগ হলো ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন, ২ মার্চ ঢাকায় আর ৩ মার্চ সারা বাংলাদেশে হরতাল পালিত হবে।

১ মার্চের আগে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আওয়ামী লীগ প্রধান আর পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের একজন নির্বাচিত সদস্য। ১ মার্চ থেকে সেই বঙ্গবন্ধু হয়ে গেলেন পূর্ব বাংলার অঘোষিত সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান। কারণ সেদিন থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত পূর্ব বাংলার বেসামরিক প্রশাসন সম্পূর্ণ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই চলেছে। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসুর নেতৃত্বে প্রথম ওড়ানো হলো স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে অনুষ্ঠিত হলো এক বিশাল জনসভা। সেই জনসভায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের সময় প্রস্তাবিত জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়া হয় এবং বঙ্গবন্ধুকে ছাত্রদের দ্বারা গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। সেই দৃশ্য ছিল অভাবনীয়। সেই সভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, তিনি পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে ঘোষণা দেবেন। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা ছিল অসাধারণ।

তিনি আসন্ন সময়ে দুর্যোগের আভাস পেয়েছিলেন। ৩ তারিখের জনসভায় বঙ্গবন্ধু তিনটি নির্দেশ দিয়েছিলেন। ক. পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত অফিস-আদালত বন্ধ থাকবে; খ. টিভি ও বেতারে আন্দোলনের খবরের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করলে তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে; আর গ. আন্দোলনে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ করে আন্দোলনকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করতে হবে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী যখনই বাঙালিরা কোনও আন্দোলনের সূত্রপাত করেছে তখনই ‘ইসলাম বিপন্ন’ এই ধুয়া তুলে পূর্ব বাংলায় হিন্দু-মুসলমান অথবা বাঙালি-অবাঙালি দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা করেছে। মার্চ মাসের শুরু  থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাঙালি-অবাঙালি দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছিল।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চের পড়ন্ত  বিকালে বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ, যা এক মহাকাব্য বলে এখন বিশ্বদরবারে স্বীকৃত। ১৯ মিনিটেরও কম সময়ে রাজনীতির কবি বাঙালির ২৩ বছরের শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস বলে গেলেন আনুমানিক ১০ লাখ মানুষের সামনে। দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ছাড়া পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে কোনও আলোচনা হতে পারে না। দৃপ্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ২৬ মার্চ রাতেই বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গ্রেফতার করেছিল। কিন্তু তাঁর অবর্তমানে ৭ মার্চ দেওয়া তাঁর নির্দেশেই বাঙালি দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে।

বন্দি মুজিব মুক্ত মুজিবের চেয়ে একাত্তরে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিলেন। ৭ মার্চের সেই ভাষণ শুধু ঐতিহাসিকই ছিল না, সেই ভাষণ ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। এটি একটি নতুন দেশের অভ্যুদয়ের চালিকাশক্তি ছিল। এই ভাষণ নিয়ে বিশ্বনেতৃত্ব ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম অনেক বক্তব্য দিয়েছে বা প্রচার করেছে। তবে কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর বক্তব্য ছিল অত্যন্ত  তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছিলেন, ‘৭ই মার্চের শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুধু ভাষণ নয়, একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল।’ 

বস্তুত ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ছিল বাঙালির নব জাগরণের দিন। এই দিনে বাঙালি নিজের শক্তি সম্পর্কে নতুনভাবে সচেতন হয়েছিলেন। সার্বিক বিচারেই ইউনেসকো এই ভাষণকে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে। এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ