জনপ্রিয় সিরিয়াল আদালতের ডিফেন্স ল’য়ার কেডি পাঠক প্রায় তার যুক্তি তুলে ধরতে বলেন: ‘হরহামেশা আমরা সাদাচোখে যা দেখি তা সত্য নয়। সত্য অনেক সময় অন্তরাল থেকে খুঁজে নিতে হয়।’ কেডি পাঠকের ওই বক্তব্য এবার টিভি সিরিয়ালে নয়, বাস্তবে প্রমাণিত হলো। বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের জন্য শুরু হলেও তার যে একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল তা এই আন্দোলনের শেষধাপে এসে স্পষ্ট হয়েছে। অহিংস আন্দোলন বলা হলেও আন্দোলনের নেতারা তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য যে সহিংস হতেও রাজি ছিল তাও বেশ পরিষ্কার।
মহাত্মা গান্ধীর অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পৃথিবী বিখ্যাত। মহাত্মা গান্ধী যে অহিংস আন্দোলন পরিচালনা করেন সেই আন্দোলনে তিনি বহুরূপ ধারণ করেননি। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ব্রিটিশ সরকার বিরোধী অসহযোগ আন্দোলন চলার সময়ে ১৯২২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ইউপি গ্রামের পুলিশ স্টেশনে একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। ওই পুলিশ স্টেশনে রাজনৈতিক কর্মীদের তাড়া খেয়ে কিছু সংখ্যক পুলিশ আশ্রয় গ্রহণ করে। পুলিশের অত্যাচারে উত্তেজিত কতিপয় জনতা পুলিশ স্টেশনে আগুন ধরিয়ে দেয়। ওই ঘটনায় ২২ জন পুলিশ অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়। এতে মহাত্মা গান্ধী বিচলিত হয়ে পড়েন। পন্ডিত মদনমোহন মালব্যের পরামর্শে মহাত্মা গান্ধী সন্ত্রাস ও সহিংসতা এড়াতে, মানুষের প্রাণ রক্ষা করতে ১৯২২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বারদৌলি গিয়ে তুঙ্গে চড়া অসহযোগ আন্দোলন সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু একের পর এক মানুষ নিহত হলেও কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। যদিও তারা মহাত্মা গান্ধীর অহিংস অসহযোগ আন্দোলন থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারতেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারাও মহাত্মা গান্ধীর পথ অনুসরণ করতে পারতেন। তাদের অহিংস আন্দোলন যখন সহিংস হয়ে উঠেছে তখন তারা আন্দোলন সাময়িক বন্ধ করতে পারতেন। সরকারি একটি চাকরির থেকে মানুষের জীবনের মূল্য অনেক বেশি। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত কোনও কোনও নেতার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল তা এখন স্পষ্ট হয়েছে। ওই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই তারা সহিংসতা ও প্রাণহানিকে উপেক্ষা করে আন্দোলন চালিয়ে গেছেন তা এখন বোঝা যাচ্ছে।
মহাত্মা গান্ধী রক্তের সাগরে ডুবে ক্ষমতা না চাইলেও কোটা সংস্কারে যুক্ত নেতারা চেয়েছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত দুই জন সমন্বয়ক উপদেষ্টার ‘দায়িত্বে’র ভাগ পেয়েছেন। এক্ষেত্রে তারা মহাত্মা গান্ধীর মতো নির্লোভ হতে পারেননি। তাদের এই দায়িত্বের অংশ হওয়া কতটা সঠিক হয়েছে তা সময় বলে দেবে।
কোটা সংস্কারের প্রাণহানির ঘটনাকে যদি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে এর তিনিটি ধাপ রয়েছে। কোটা সংস্কারের গেজেট প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে এর প্রথম ধাপের সমাপ্তি ঘটেছে। দ্বিতীয় ধাপের শেষ হয়েছে সরকার পতনের মধ্য দিয়ে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাসিত হওয়ার পরও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। লুটতরাজ হয়েছে। দেশ জুড়ে ডাকাত নেমেছে। মানুষের রাতের ঘুম হারাম হয়েছে। সংঘর্ষ-সহিংসতায় কয়েকশ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। সংখ্যালঘুদের বাড়িতে মন্দিরে হামলা হয়েছে। প্রাণহানি ঘটেছে। ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারের অনুপস্থিতিতে অমনটি যে ঘটবে তা স্বাভাবিক। আমার প্রশ্ন বিপ্লবে যুক্ত নেতা ও তাদের চিন্তকরা কেন এই বিষয়টি বুঝলেন না? এই যে বিপ্লবোত্তর সময়ে কয়েকশ মানুষ প্রাণ হারালো তা কি রোধ করা যেত না?
আমার বিবেচনায় প্রাণহানি, সংঘাত-সংঘর্ষ, ধংসযজ্ঞ রোধ করা যেত। এক্ষেত্রে বিপ্লবীদের সতর্ক হতে হতো। বিপ্লবের পর কি কি ঘটতে পারে তার পূর্ব প্রস্তুতি থাকলে এমনটি ঘটতো না। বিপ্লবীরা সরকারের অনুপস্থিতির সময়ে ঘরে ফিরে না গিয়ে ধারাবাহিকভাবে অলিতে গলিতে মোড়ে মোড়ে পাহারা বসাতে পারতেন। থানা আক্রমণ, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে হামলা না করে বরং তাদের নিরাপত্তায় পাহারা বসাতে পারতেন। কিন্তু তারা সেটি করেননি। কেন করেননি? এর জন্য তাদের রাজনৈতিক অপরিপক্কতা ও ঐতিহাসিক জ্ঞানের অভাবের দায় রয়েছে নাকি তারা সুকৌশলে এমনটি করেননি তা এখনও স্পষ্ট নয়। এই বিষয়ে ভবিষ্যতে অনুসন্ধান হলে প্রকৃত সত্য জানা যাবে।
সদ্য বিদায়ী সরকার নির্বাসিত হওয়ার পর ইসলামপন্থীদের উত্থান বেশ চোখে পড়ে। সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ও ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলোসহ সেক্যুলার-কালচারাল প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙ্গে গুড়িয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি বিজড়িত জাদুঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। একজন ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে জানি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এই জাদুঘরের মূল্য অসামান্য। এই জ্বালিয়ে দেওয়া যে রাজনৈতিক কারণে ঘটেছে তা মোটেও নয় বরং এর মাধ্যমে ইতিহাসকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিকট দাবি থাকবে অনতিবিলম্বে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত জাদুঘরটি সংস্কার করে আবার চালু করা হোক।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে কট্টর ইসলামপন্থীদের প্রভাবের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে। মুসলিমদের পাশাপাশি বাংলাদেশে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টানসহ নানা জাত-পাত-ধর্ম মতের মানুষের বসবাস রয়েছে। কিন্তু আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে রাষ্ট্রীয় সব নিয়ম-নীতি ভেঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে কেবল কোরআন তেলোয়াত করা হলো। গিতা-বাইবেল-ত্রিপিটক পাঠ বাদ দেওয়া হয়েছে। সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের এক যাত্রা শুরু হলো যা আমরা ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর ইসলামিকরণের যে যুগ শুরু হয়েছিল সেখানে দেখেছিলাম। তবে কি মোস্তাক সরকারের সেই ইসলামি রাষ্ট্রের ধারণা আবারও ফিরে আসছে গঠিত নতুন এই সরকারের মাধ্যমে? জনমতে ওঠা এই প্রশ্নের উত্তর সরকারের নিকট দাবি করছি।
১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতাগ্রহণ করলেও বাংলাদেশের জনগণ কখনও গণতন্ত্রের স্বাদ পায়নি। গণতন্ত্রের নামে একনায়কতান্ত্রিক শাসন সব সময় চালু ছিল। আর ওই একনায়কতান্ত্রিক শাসনের শেষ পরিণতি হচ্ছে কর্তৃত্ববাদ। একনায়তান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী শাসনে রাষ্ট্রের কোনও প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। ক্ষমতাসীনরা তাদের শাসন ক্ষমতাকে নিজেদের মতো পরিচালনা করার স্বার্থে কখনও তা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে গড়ে তোলেননি। মেরুদণ্ডযুক্ত ব্যক্তিদের বদলে মোসাহেব তেলবাজদের বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়োগ দিয়েছে। ফলে নির্বাচন কমিশনসহ সব প্রতিষ্ঠান স্বমহিমায় বিকশিত হতে পারেনি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ওই সব প্রতিষ্ঠান সংস্কারের যে উদ্যোগের কথা বলেছেন তা আমরা সাধুবাদ জানাই। রহস্যময় আয়না ঘরসহ বিগত সময়ে ঘটে যাওয়া সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও বিনাবিচারে আটকের ঘটনার বিচারের দাবিকেও সমর্থন করি। দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে চিরুনি অভিযানকে স্বাগত জানাই। রাষ্ট্রের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারেরও দাবি করি। কিন্তু উপর্যুক্ত সংস্কার প্রকল্পগুলো যেন কোনও ভূ-রাজনৈতিক খেলার অংশ না হয় তা নিশ্চিত করা দরকার সবার আগে। বাইরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট যেন না হয়।
ভূ-রাজনৈতিক খেলায় বাংলাদেশ পড়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ওই খেলায় কতটা দক্ষতার পরিচয় দিতে পারবে তার ওপর তাদের স্থায়িত্ব নির্ভর করছে। বাংলাদেশের সব উন্নয়ন সহযোগী ও প্রতিবেশী স্টেক হোল্ডারদের নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। কোনও পক্ষকে বাদ রেখে শুধুমাত্র একটি পক্ষের হাত ধরে চললে তা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করবে।
বাংলাদেশের স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক তৈরি করতে হবে এখনই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ওই বিষয়টি বুঝতে পারছে বলে মনে হয়নি। তারা অনেকটা “দাবড়ানি” দেবার ফর্মুলায় চলছে। কিছু হলেই আন্দোলন করার হুমকি দিচ্ছে এবং তার সমর্থকদের জড়ো করছে। কিন্তু এই দাবড়ানি ফর্মুলা বেশিদিন কাজ করবে না। কারণ কোটা সংস্কার আন্দোলনের স্টেক হোল্ডাদের মধ্যে বিরোধ শুরু হলে দাবড়ানি দেবার লোকের সংখ্যা কমে যাবে। সেনাবাহিনীর সমর্থন থাকলে হয়তো তারা ক্ষমতা চালিয়ে যেতে পারবে কিন্তু তা কখনও রক্তপাত মুক্ত হবে বলে মনে হয় না। ইতিহাসের শিক্ষা এমনই বলে। ১৯৭৫ সালের পর প্রায় কয়েক ডজন সামরিক অভ্যূত্থান ঘটেছে। বহু মানুষের প্রাণ ঝরে গেছে। ইতিহাসের ওই শিক্ষা থেকে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শিক্ষা নেবে কি?
রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে স্থিতিশীল রাষ্ট্র ব্যবস্থাই কেবল ভঙ্গুর অর্থনীতিকে মেরামত করতে পারে। ওই স্থিতিশীলতা কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হবে তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ভূ-রাজনৈতিক ফাঁদে পড়লে দুর্ভিক্ষের মুখেও পড়তে পারে। উন্নয়নের অগ্রযাত্রা থেমে যাবে। তবে দুর্নীতি মুক্ত করা গেলে সম্পদের অভাব নেই এই দেশে। কিন্তু সুপার পাওয়ারদের পাশাপাশি সুপার বিজনেস ম্যানদের কতটা ম্যানেজ করা যাবে তা এখনই বলা কঠিন।
রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ একটি বড় রাজনৈতিক দল। তৃণমূলে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এমন ধারণা ঠিক নয়। বরং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যত ভুল করবে আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতা তত বাড়বে। রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ এখনও মাঠে নামেনি। তারা সম্মিলিতভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামলে এবং নিয়মিত রাজনৈতিক কর্মসূচিতে গেলে সরকার কতটা তা সামলাতে পারবে তার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করছে। তবে পরিস্থিতি যাইহোক না কেন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ যে ভূ-রাজনৈতিক স্টেক হোল্ডারদের হাতে সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়