X
শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫
২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

পোশাক শ্রমিকরা আর কতকাল রাস্তা অবরোধ করবে?

দীপংকর গৌতম
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২১:৪৩আপডেট : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:৪৩

পোশাক খাত আমাদের দেশের লাভজনকই শুধু না, অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির কাঠামো শক্ত না হওয়া ও পুঁজির অসম বিকাশের মধ্য দিয়ে গ্রামের অজস্র পেশা হারিয়ে গেলে বেকার মানুষজন শহরে এসে পোশাক কারখানায় ঢুকে জীবন রক্ষা করেন।

পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বেতন কর্মঘণ্টা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কম বলে এখানে পোশাক ব্যবসায় লাভ বেশি। ফলে দেশের টঙ্গী, গাজীপুর, আশুলিয়া, জিরাবো, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে অজস্র পোশাক কারখানা। ভোর হতেই দেখা যায় লাঞ্চবক্স হাতে জোরপায়ে হেঁটে চলেছে গার্মেন্টস শ্রমিক সেলাই দিদিমনি ও ভাইয়েরা।

উদয়াস্ত পরিশ্রম তো করেই। তারপর ওভারটাইম করতে হয় বাধ্যতামূলক। এরপরে গার্মেন্টসে কাজের পরিবেশ কেমন সেটা বোধকরি গণমাধ্যমের সুবাদে সবার জানা। এ ক্ষেত্রে তাজরীন বা রানা প্লাজার কথা বললেই বোঝা যাবে যে সরু সিঁড়ি, কলাপসিবল গেট এমন করে তালা দেওয়া থাকে, এখান থেকে লাফিয়ে পড়ারও কায়দা নেই। অধিকাংশ গার্মেন্টসে কাজ করার উপযোগী পরিবেশ নেই। এর পরে বেতন তো আরেক বিড়ম্বনা। যে বেতন পায় তা ঢাকায় ভালোভাবে বসবাসের উপযোগী না। তারপরও সে বেতন নিয়মিত না। এ অবস্থা অধিকাংশ গার্মেন্টসে।

২০২৩ সালে বেশ কিছু দিন ধরেই গার্মেন্টস শিল্পে অস্থিরতা চলতে থাকলো। ওই বছরের নভেম্বরে ন্যূনতম মজুরি ইস্যুতে আন্দোলন চলাকালীন শতাধিক গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এই শিল্পের অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার বিষয়টি মোটাদাগে সামনে আসে। সেসময় পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা নির্ধারণ ও  গ্রেডের সংখ্যা সাত থেকে কমিয়ে পাঁচে কমিয়ে এনে গেজেট প্রকাশ করেছিল তৎকালীন সরকার। সরকার কর্তৃক ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত হওয়ার পর অসন্তোষ থাকলেও ধীরে ধীরে কাজে ফিরতে শুরু করেন শ্রমিকরা। কিন্তু ঘোষণা অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে (ডিসেম্বর মাসের বেতনে) ঘোষিত নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন করার কথা থাকলেও অনেক প্রতিষ্ঠান সেটি আমলে নেয়নি বলে সংবাদপত্রে প্রকাশ হয়েছিল।

কোনও কোনও মালিক জানিয়েছিল তারা নতুন কাঠামোতে বেতন দিতে পারবে না। ফলে নতুন করে শুরু হতে থাকে আন্দোলন। আন্দোলন চলতে থাকলে সেটা বন্ধের বড় ওষুধ হলো গার্মেন্টস বন্ধ রাখা। গার্মেন্টস কেন বন্ধ রাখা হয়? গার্মেন্টস মালিকরা টাকা পায় ডলারে। ১ ডলার সমান ১২০ টাকা। তাদের কারখানা ১ মাস বন্ধ রাখলে কিছু যায় আসে না। কিন্তু শ্রমিকরা এক মাস কাজ না করলে খাবে কি? এ অংশ সরল অঙ্ক।

তারপরও মালিকরা শ্রমিকদের সঙ্গে যে আচরণ করে সেটি নজিরবিহীন। অল্পদিনে অজস্র টাকার মালিক বনে যাওয়া গার্মেন্টস মালিকরা শ্রমিকদের শ্রম শোষণ ছাড়া চলতেই পারে না। এবারে বেশ কিছু দিন ধরে আন্দোলন চলছে। আন্দোলনের কারণে অনেক কারখানা বন্ধ ছিল, ধীরে ধীরে অনেক কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে। এখনও আন্দোলন চলছে। গাজীপুরে একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবিতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন। ওই মহাসড়কের উভয় পাশে পাঁচ কিলোমিটার যানজট সৃষ্টি হয়েছে। এতে যাত্রী, চালক ও স্থানীয়রা দুর্ভোগে পড়েছেন।

গত রবিবার (২২ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টা থেকে জয়দেবপুর উপজেলার বাঘের বাজার এলাকায় মণ্ডল ইন্টিমেন্টস নামে কারখানার শ্রমিকেরা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন। এছাড়া গাজীপুর মহানগরীর খাইলকুর এলাকার এমএম ফ্যাশন অ্যান্ড কম্পোজিট লিমিটেড, টঙ্গী পশ্চিম থানার খাঁ পাড়া সড়কের সিজন্স ড্রেসেস লিমিটেড পোশাক কারখানা, সাতাইশ বাগানবাড়ি এলাকার প্রিন্স জ্যাকার্ড সোয়েটার লিমিটেড এবং বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবিতে কর্মবিরতি পালন করছেন। শ্রমিকদের দাবিগুলো হলো, হাজিরা বোনাস এক হাজার টাকা করতে হবে, নাইট বিল ১০০ টাকা, কারখানায়  মোবাইল নিয়ে প্রবেশের অনুমতি দিতে হবে, অর্ধবেলা ছুটি অথবা দুই ঘণ্টা গেট পাস নিলে হাজিরা বোনাস কাটা যাবে না, অসুস্থ হলে কারখানার মেডিক্যাল সেন্টারে বিশ্রামে না রেখে ছুটি দেওয়া।

মণ্ডল ইন্টিমেন্টস কারখানার আন্দোলনরত শ্রমিকরা বলেন, ‘আশপাশের বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলন করে তাদের দাবি পূরণ করে নিয়েছেন। আমরা কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের দাবি জানিয়ে এলেও তারা তা পূরণে উদাসীন। তাই আমরা দাবি আদায়ে আন্দোলন করছি।’

গত ২২ সেপ্টেম্বর শ্রমিকরা কারখানার সামনে বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। এতে সড়কে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায় এবং যাত্রী, সাধারণ মানুষ ও চালকরা ভোগান্তিতে পড়েন। খবর  পেয়ে শিল্প পুলিশ, জয়দেবপুর থানা পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে যান। গার্মেন্টস শ্রমিক  ট্রেড ইউনিয়ন  কেন্দ্র গাজীপুর জেলা সভাপতি জিয়াউল কবীর খোকন আন্দোলন প্রসঙ্গে জানান, ‘কারখানায় প্রবেশে যেসব শ্রমিক দেরি করেন না এবং নিয়মিত কাজ করেন, তাদের প্রতিমাসে ৭৫০ টাকা অতিরিক্ত হাজিরা  বোনাস দিচ্ছে বিভিন্ন পোশাক কারখানা। আমি মনে করি এটি শ্রমিকদের অধিকার এবং যৌক্তিক দাবি।’ গাজীপুর শিল্প পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার মোশাররফ হোসেন জানান, গত রবিবার সকাল ৮টা থেকে গাজীপুর মহানগরীর খাইলকুর এলাকার এমএম ফ্যাশন অ্যান্ড কম্পোজিট লিমিটেডের তিন শতাধিক শ্রমিক কারখানায় প্রবেশ করেন। আধঘণ্টা পর থেকে তারা আগস্ট মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতে উৎপাদন কাজ বন্ধ করে কারখানার অভ্যন্তরে কর্মবিরতি পালন করছেন।

মালিক পক্ষের সঙ্গে শ্রমিকদের আলোচনা চলছে। একই সময়ে গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গী পশ্চিম থানা খাঁপাড়া সড়কের সিজন্স ড্রেসেস লিমিটেড কারখানার ১৫০০ শ্রমিক জুলাই মাসের অর্ধেক বেতনের দাবিতে উৎপাদন বন্ধ করে কর্মবিরতি পালন করছেন। আন্দোলন এখনও চলছে।

সড়কে দীর্ঘ যানজটে জনগণের ভোগান্তির বিষয়ে গার্মেন্টকর্মী নিপা বলেন, ‘৪/৫ ঘণ্টা গাড়িতে বসলে আপনাগোর ভোগান্তি অয়। আর আমার বাচ্চা যখোন দিনভর রাতভর খাওনের জন্য কান্দে, হেইডারে ভোগান্তি মনে হয় না?’

গার্মেন্টস শ্রমিকদের এই আন্দোলন সারা বছরই চলে। ঈদের আগেও ওদের রাস্তা বন্ধ করে বসতে হয় বেতন- বোনাসের দাবিতে। কোনও গার্মেন্টস মালিকের এই টাকা দিতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। তারপরও মালিক বলে কথা। তাদের হিসাব আর আমাদের হিসাব মিলবে না। মালিক সবসময় মালিক। আর আমরা সবাই শ্রমিক। হিসাব তাই মেলে না। কিন্তু শ্রমিকদের রাস্তায় বসা বন্ধ করতে বোধকরি মালিকদের সদিচ্ছাই যথেষ্ট। সেই সদিচ্ছা কবে থেকে হবে?

শ্রমিকদের কারখানা, পরিবার-পরিজন রেখে আর কতকাল রাস্তা অবরোধ করে রাখতে হবে?

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দেশকাল পত্রিকা

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ত্বকের কালচে দাগ দূর করবে ঘরে তৈরি এই ৬ উপটান
ত্বকের কালচে দাগ দূর করবে ঘরে তৈরি এই ৬ উপটান
ফারাক্কা লংমার্চ শুধু মিছিল নয়, ছিল অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন: গোলাম মোস্তফা
ফারাক্কা লংমার্চ শুধু মিছিল নয়, ছিল অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন: গোলাম মোস্তফা
যাত্রাবাড়ীতে কাভার্ডভ্যানে উঠে চালককে কুপিয়ে টাকা ছিনতাই
যাত্রাবাড়ীতে কাভার্ডভ্যানে উঠে চালককে কুপিয়ে টাকা ছিনতাই
বনানীতে গাড়ির ধাক্কায় অজ্ঞাত নারী নিহত
বনানীতে গাড়ির ধাক্কায় অজ্ঞাত নারী নিহত
সর্বশেষসর্বাধিক