X
সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫
২৩ আষাঢ় ১৪৩২

অর্ধলক্ষ পরিবারের বলিদানে 'আবাসিক সতীত্ব' রক্ষা

আরিফ জেবতিক
১৪ আগস্ট ২০১৬, ১২:১৬আপডেট : ১৪ আগস্ট ২০১৬, ১২:২৮

আরিফ জেবতিক ঢাকা শহরে হুট করে প্রায় অর্ধলক্ষ পরিবারের পথে বসার উপক্রম হয়েছে। সংখ্যাটা আরও বেশি হওয়ার কথা, এর চেয়ে বেশি বলতে আমার নিজের ভয়ভয় লাগছে। অর্ধলক্ষ পরিবারও কম বড় কথা নয়, আমাদের নগরে পঞ্চাশ-ষাট হাজার পরিবারের মানুষ একসঙ্গে বেকার হয়ে যাবেন, তারা বাসাভাড়া দিতে পারবেন না, সন্তানের স্কুলের বেতন দিতে পারবেন না, ধারের টাকা মেটাতে পারবেন না—এ যে কত বড় এক দুঃস্বপ্ন; সেটি কল্পনা করতেই আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মিলে কয়েক লাখ লোক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন—এটি আলোচনার জন্য খুবই বড় একটা বিষয়।
এরকম বড় একটা নাগরিক বিপর্যয়ে পুরো হইচই পড়ে যাওয়ার কথা। পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক, আলোচনা শুরু হওয়ার কথা। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম এ রকম কিছুই হচ্ছে না। আমরা এতটাই  নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত যে ওই অর্ধলক্ষ পরিবারের একজন সদস্য না হলে আমরা একে ধর্তব্যের মধ্যেই আনছি না।
ব্যাপারটা শুরু হয়েছে কয়েক সপ্তাহ হলো। পত্রিকায় পড়লাম যে ঢাকা শহরে প্রায় ১৮ হাজার ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। 'আবাসিক' হিসেবে চিহ্নিত  এলাকাগুলো থেকে সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে  উঠিয়ে দিতে সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এসব এলাকায় অনেক বাড়ির সামনে ছোট ছোট মুদি দোকান হয়েছে, মোবাইল ফোনের দোকান, লন্ড্রি, ফার্মেসি, স্ন্যাকবার, বুটিক শপ, দর্জির দোকান এসব ছোটখাটো দোকান ভাড়া নিয়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা নিজেদের মতো করে বেঁচে আছেন। তারা সৎ ব্যবসায়ী এবং এতদিন সরকারি ট্রেডলাইসেন্স নিয়ে সব ট্যাক্স-কর দিয়ে ব্যবসা করছেন। এখন সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের এখানে ব্যবসা করতে দেওয়া যাবে না।
এখন হুট করে তাদের উঠে যেতে বললে তারা পথে বসবেন। তাদের দোকানের ডেকোরেশন এবং পণ্যের টাকা মার যাবে, এডভান্সের টাকাটাও ফেরত পাবেন কি না সন্দেহ। একেকটা দোকানে প্রত্যক্ষভাবে গড়ে ৩ জন লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে ধরলেও সরাসরি ৫৪ হাজার পরিবারের পেটে লাথি পড়ছে। বিকল্প কর্মসংস্থানের কোনও সুযোগ তৈরি না করে এবং বর্তমান সময়ের বাস্তবতা না হিসাব করে এভাবে অর্ধ লক্ষেরও বেশি পরিবারেকে পথে বসিয়ে দেওয়া একটি বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয়।
আবাসিক এলাকাকে আবাসিক এলাকা হিসেবে থাকতে দিতে হবে—শুনতে বিষয়টি বেশ ভালোই শোনায়। কিন্তু গোটা বিষয়টি বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। আজ থেকে ৫০/৬০ বছর আগে যেসব এলাকা আবাসিক হিসেবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, বর্তমান অবস্থা সে রকম নেই। যখন এসব এলাকাকে আবাসিক হিসেবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তখন ৫০ বছর পরে এই এলাকার জনসংখ্যা কত হতে পারে, সে ব্যাপারে তখনকার পরিকল্পনাবিদদের কোনও ধারণাই ছিল না। সেই অদূরদর্শিতার মূল্য এখন  আমাদের চুকাতে হচ্ছে।

ধানমণ্ডি কিংবা গুলশান-বনানীর কথাই ধরা যাক। যখন এসব স্থানকে আবাসিক এলাকা হিসেবে তৈরি করা হয়, তখন একেকটা প্লট ছিল একবিঘা-দুই বিঘা এলাকার। প্রচলিত ট্রেন্ড ছিল সেই এক বিঘায় দোতলা বাড়িতে বড়জোর দুটো পরিবার বাস করবে।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে সেই হিসাব এত বেশি পাল্টেছে যে, সব হিসাব নিকাশ ভেঙে গেছে। এখন এক বিঘার একটি প্লটকে ৫ কাঠার ৪টি প্লটে পরিণত করা হয়েছে, প্রতি ৫ কাঠায় ৮ তলা ভবনে ১৬টি পরিবার বাস করে। সেই হিসাবে জনঘনত্ব বেড়েছে ৩২০০%! পৃথিবীর কোনও পরিকল্পনাবিদের পক্ষেই ৩২০০% বৃদ্ধির হিসাব মাথায় রেখে পরিকল্পনা করা সম্ভব নয়।

এর ফলে এসব এলাকায় নানান সংকট তৈরি হয়েছে, চাহিদাও তৈরি হয়েছে। সেই চাহিদার কারণে তৈরি হয়েছে আবাসিক এলাকায় মুদি দোকান, ফার্মেসি ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান।

সবচেয়ে বড় সংকট তৈরি হয়েছে স্কুলের। ৩২০০% বৃদ্ধি পাওয়া জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যাপ্ত স্কুলের পরিকল্পনা করা যায়নি। কিন্তু স্কুল-কলেজ আজকের মানুষের মৌলিক চাহিদা। একই অবস্থা হাসপাতালেরও। আর তাই আবাসিক এলাকায় সব নিয়মকানুন ভঙ্গ করে গড়ে উঠেছে স্কুল আর হাসপাতাল । এই স্কুল-হাসপাতালের সেবা গ্রহীতারা আমাদেরই নাগরিক, এসব তাদের জীবনযাত্রার জন্য অপরিহার্য বিষয়।

আমাদের সর্বোচ্চ আদালত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে ধানমণ্ডির 'আবাসিক' হিসেবে চিহ্নিত রাস্তাগুলোয় 'বাণিজ্যিক' কার্যক্রম চালানো যাবে না। আইনের দৃষ্টিতে আদালতের সিদ্ধান্ত খুবই সঠিক। কিন্তু ব্যবহারিক দিক থেকে খুব জরুরি প্রশ্ন হচ্ছে যে, যেসব রাস্তায় এই দোকানপাট, স্কুল-হাসপাতালগুলো তৈরি হয়েছে (সরকারি ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই তৈরি হয়েছে) সেই রাস্তাগুলোর প্রকৃতি কি আদৌ আবাসিক থাকবে নাকি সেগুলোর গঠন পরিবর্তন করা দরকার? এই রাস্তাগুলোকে তাদের 'আবাসিক' ফর্মে ফেরত আনা অবশ্যই সম্ভব, কিন্তু ওই যে বর্ধিত ৩২০০% জনগোষ্ঠীর চাহিদা, সেগুলোকে সরকার কিভাবে মোকাবিলা করবে? ধানমণ্ডি-গুলশান-বনানীর লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় বাণিজ্যিক স্পেস কি সেখানে আছে? হাজার হাজার স্কুলগামী বাচ্চাদের জন্য সরকার কোথায় স্কুল প্লট রেখেছেন? আমি নিজে বনানীতে বাস করি, সেখানকার ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলগুলো তুলে দিলে আমাদের বাচ্চাদের কোথায় ভর্তি করব সে ব্যাপারে আমি কোনও দিকনির্দেশনা পাচ্ছি না কেন? বনানীতে মাত্র দুটো কি ৩টি 'বৈধ স্পেস' সরকারি বা আধা সরকারি স্কুল আছে, তাদের পক্ষে কোনোভাবেই আর ৩০/৪০ টি স্কুলের বাচ্চাদের স্থান করে দেওয়া সম্ভব হবে না। তাহলে আমার বাচ্চা কি পড়াশোনা করবে না? স্কুলে যাবে না? সরকার কি বিকল্প চিন্তা করছে? ধানমণ্ডিতে যে এতগুলো পুরোনো ইংরেজি মাধ্যম স্কুল সপ্তাহের মধ্যে স্থানান্তর করতে আদেশ দেওয়া হলো, সেই স্কুলগুলো সপ্তাহান্তে স্থানান্তর তো বাস্তবতার নিরিখেই অসম্ভব, সেক্ষেত্রে এই ছাত্র-ছাত্রীর পড়াশোনা কি বন্ধ করে দিতে হবে? যে হাসপাতাল-ক্লিনিক সরিয়ে নিতে বলা হচ্ছে, সেগুলো বন্ধ হয়ে গেলে সব রোগীকে ঠাঁই দেওয়ার মতো সক্ষমতা কি আমাদের রোগীর ভিড়ে জর্জরিত সরকারি হাসপাতালগুলোর আছে?

পাড়ার মোড়ের মুদি দোকান কি ফার্মেসি বন্ধ করে দিলে সবাই যদি শপিং মলে গিয়ে উঠতে চায়, তাহলে সেই পরিমাণ শপিং মলের তো জায়গা নেই। সেক্ষেত্রে একদিকে এই ক্ষুদ্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের কর্মসংস্থানের কী হবে? অথবা সেবাপ্রার্থীরা কিভাবে সেবা পাবেন?

আমার কেন যেন আশঙ্কা, যারা হুট করে ১৮ হাজার ট্রেডলাইসেন্স বাতিল করে দিতে চাচ্ছেন তারা এসবের কিছুই ভাবেননি। তারা পঞ্চাশ বছরের পুরনো খাতা বের করে সেই খাতার দাগ-খতিয়ান দেখে দেখে আবাসিক এলাকাগুলোর আবাসিক সতীত্ব উদ্ধারের একচোখা মিশনে নেমে পড়েছেন।

বাস্তবতা হচ্ছে সেই পুরনো মানচিত্রে অনেক ভুল ছিল। সেই ভুল রেখে দেওয়ার চেয়ে সংশোধন করা বেশি জরুরি।

বনানী গুলশান এলাকা যখন তৈরি করা হয়, তখন সেখানে পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা তৈরি করা হয়নি। সেই ভুল সংশোধন করার জন্য এখন বনানী-গুলশান এলাকার প্রতিটি রাস্তাকে কেটে ড্রেনেজ সিস্টেমকে যুগোপযোগী করা হচ্ছে। এটাই সঠিক পদ্ধতি, ড্রেনে নালা  নর্দমা যেহেতু পুরনো মানচিত্রে নেই, তাই সেগুলো তৈরি করা যাবে না, সব নোংরা পানি রাস্তায় ফেলতে হবে—এমনটা বলা হতো নির্বুদ্ধিতা।

আমাদের ঢাকা শহরের অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া জনসংখ্যার বাস্তবতাকে স্বীকার করে আবাসিক এলাকাগুলোর পুনর্বিন্যাস এবং সেখানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বাণিজ্যিক স্থান বের করে দেওয়াটাও তাই এই সময়ের জরুরি কাজ, সেটা নিয়ে কথা হতে পারে।

কিন্তু পঞ্চাশ বছরের পুরনো পরিকল্পনার দোহাই দিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জীবিকার বাইরে, রোগীদের হাসপাতালের বাইরে আর শিশুদের স্কুলের বাইরে ছুড়ে ফেলে দেওয়াটা হবে নির্বুদ্ধিতা। একুশ শতকে এসে নাগরিক কল্যাণে সরকারের কাছে আমরা  স্মার্টনেস আশা করব, নির্বুদ্ধিতা নয়।

লেখক: ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট

আরও খবর: বাংলাদেশই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি: ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (৭ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (৭ জুলাই, ২০২৫)
মধ্যরাতে সংবর্ধনায় বিশ্বকাপ স্বপ্নের কথা বললেন ঋতুপর্ণা ও আফঈদারা 
মধ্যরাতে সংবর্ধনায় বিশ্বকাপ স্বপ্নের কথা বললেন ঋতুপর্ণা ও আফঈদারা 
গণভবন জয় করেছি, এবার জাতীয় সংসদ জয় করবো: নাহিদ ইসলাম
গণভবন জয় করেছি, এবার জাতীয় সংসদ জয় করবো: নাহিদ ইসলাম
একটি দলের কারণে ঐকমত্য কমিশনে মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবনা আটকে যাচ্ছে: আখতার
একটি দলের কারণে ঐকমত্য কমিশনে মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবনা আটকে যাচ্ছে: আখতার
সর্বশেষসর্বাধিক