X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিবন্ধীদের প্রতি সদয় হওয়ার প্রয়োজন নেই

জেসমিন চৌধুরী
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৯:৩৬আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ২৩:৪৩

জেসমিন চৌধুরী কয়েক সপ্তাহ আগে ষোলো বছর বয়সের মানসিক প্রতিবন্ধী একটা মেয়ের মা-বাবার জন্য দোভাষীর কাজ করতে গিয়েছিলাম একটি স্কুলে। কাউন্সিলের বড় অফিসার, শ্রেণি-শিক্ষক আর ডেপুটি হেডমাস্টারকে নিয়ে রিভিউ মিটিং হচ্ছে মেয়েটির ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্য। তাকে কি কলেজে পাঠানো হবে, নাকি স্কুলের সিক্সথ ফর্মে আরও তিনবছর রেখে পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যবহারিক শিক্ষার মাধ্যমে চাকরির জন্য যোগ্য করে তোলার চেষ্টা করা হবে? সেই সিদ্ধান্তের চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে।


আমি মনপ্রাণ ঢেলে দু'দিকের কথা দু'দিকে হুবহু পাচার করার চেষ্টা করছি। যেন কোথাও  বিন্দুমাত্র কোনও ভুল না হয়, মেয়েটির সমস্ত অধিকার এবং সম্ভাবনার ঠিক বাস্তবায়ন এবং মূল্যায়নে যেন কোথাও কোনও কমতি না থাকে। মনোযোগের সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করছি কিন্তু আমার মন কাঁদছে আমার নিজের প্রতিবন্ধী বড় বোনের জন্য যাকে নিয়ে কেউ কোনও দিন এমন করে ভাবেনি।
আমার কয়েক বছরের বড় বোনটি একই ধরনের সমস্যা নিয়ে জন্মেছিলেন, কিন্তু আমার পোড়ার দেশে তার অধিকার বা সম্ভাবনার যত্ন নেওয়ার জন্য কোনও ব্যবস্থা ছিল না। ছোট থেকে তাকে দেখেছি প্রচণ্ড মানসিক নির্যাতন ভোগ করতে। তিনি জানতেন তিনি আর দশজনের মতো স্বাভাবিক নন। এ নিয়ে অনেক কষ্ট পেতেন, আশেপাশের লোকজনও যে তার প্রতি খুব সদয় ছিল তা নয়। ফলে বেশির ভাগ সময়ই তার মেজাজ খিঁচে থাকত, তার আচার আচরণও ছিল খুব এগ্রেসিভ। ছোটবেলা তার হাতে অনেক অহেতুক পিটুনিও খেয়েছি।
যাই হোক, আমার ক্লায়েন্টের মেয়েটির জন্য স্কুল ও লোকাল অথরিটি নানা ধরনের সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করেছে। সে আর সব বাচ্চার মতো স্কুলে যায়, নিজে একা চলাফেরা করতে পারে না বলে স্কুল থেকে প্রতিদিন এস্কটসহ বাসায় গাড়ি পাঠানো হয়। সারাদিন স্কুলে তাকে সাহায্য করার জন্য একজন সহযোগী শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে। তার সামাজিক আচার আচরণের উন্নতির জন্য একজন বিশেষজ্ঞ বাসায় গিয়ে নিয়মিত তার সঙ্গে কাজ করেন। স্কুলে তার আচার আচরণ ভালো হলেও মেয়েটি তার একমাত্র ছোট ভাইটিকে সহ্যই করতে পারে না, ভাইটি তার দৃষ্টি সীমানায় এলেই সে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে এবং ভাইয়ের দিকে হাতের কাছে যা পায় তা’ই ছুড়ে মারে। তার মা-বাবাকে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে সাহায্য করার জন্য দশ সপ্তাহের একটা বিশেষ কোর্স করানো হচ্ছে।

সিক্সথ ফর্ম অর্থাৎ উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে যেন মেয়েটি কাজ কর্ম করে খেতে পারে, স্বাধীনভাবে নিজের বাসায় একা থাকতে পারে, তার জন্য এখন থেকেই তোড়জোড় চলছে। জীবন নিয়ে সে কী ভাবে, ভবিষ্যৎ নিয়ে তার কী স্বপ্ন, কী ধরনের কাজ করার যোগ্যতা আছে তার এবং সেই যোগ্যতাকে কিভাবে ঠিকমতো কাজে লাগানো যেতে পারে, তা তলিয়ে দেখতে নিয়মিত আলাপ আলোচনা এবং বৈঠক চলছে। এত সমস্যার পরও  সে ইংরেজিতে লিখতে-পড়তে শিখেছে, হিসাব-নিকাশ করতে শিখেছে, তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করতে শিখেছে। কিছুদিনের মধ্যেই ব্যবহারিক শিক্ষার জন্য তাকে একটা ক্যাফেতে এবং হাসপাতালে নিয়মিতভাবে পাঠানো হবে। সেখানে তাকে দিয়ে বিভিন্ন ধরনের কাজ করানোর মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করা হবে, সে কোন কাজে দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম।

শারীরিক ও মানসিক অসম্পূর্ণতা যেন একজন মানুষের পরিপূর্ণভাবে জীবন বাঁচার পথে অন্তরায় হতে না পারে, তার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের এই আন্তরিক প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবি রাখে। দেখে মনটা ভরে গেল, সেইসঙ্গে চোখ দুটিও। সাত হাজার মাইল দূরের স্বদেশের কোনও এক শহরতলীতে আমার অহনা চুলে পাকধরা বোনটির পরাধীন অক্ষম জীবনের কথা ভেবে আনমনা হয়ে গেলাম। হয়তো তার ভাত কাপড়ের অভাব নেই, হয়তো তিনি আরামেই আছেন, কিন্তু তিনি কি মানুষের মর্যাদা পেয়েছেন কখনও? মানুষ হিসেবে মৌলিক অধিকার বলে কোনও বিষয় কি তার জীবনে কখনও ছিল?
আমার বোনটি জীবনে স্কুলের চৌকাঠ মাড়াননি, ঘরের বাইরেই যাননি খুব একটা। মায়ের সঙ্গে থেকে থেকে ঘরসংসারের কিছু কাজ শিখেছিলেন, কিন্তু তার নিজের একটা জীবন, জীবিকা, বা পরিবারের কথা ভাবাও ছিল বাতুলতা মাত্র।  তার বয়স যখন প্রায় চল্লিশ তখন হঠাৎ একবার ঈদের সময় আমার খেয়াল হলো তিনি জীবনে কখনও বাজার করতে যাননি। নিজের অজান্তেই আমরা তার সামাজিক অগ্রহণযোগ্যতাকে মেনে নিয়ে তাকে চিরদিন চার দেয়ালের ভেতরেই আবদ্ধ করে রেখেছি। সেবার প্রথম আমি তাকে আড়ংয়ে কেনাকাটা করতে নিয়ে গেলাম। ভেবেছিলাম যেতে রাজি হবেন না, কিন্তু আমাকে অনেকটা অবাক করে দিয়েই খুব খুশি হয়ে তিনি আমার সঙ্গে গেলেন। নিজের কিঞ্চিত অবোধ্য সুর, স্বর, আর শব্দমালা ব্যবহার করে সেলসগার্লদের সঙ্গে কথা বলারও চেষ্টা করলেন, দু'দুটি সেলোয়ার কামিজের সেট কিনে আনলেন নিজের পছন্দমতো। ছোটবেলা না বুঝে তাকে অনেক জ্বালিয়েছি, তার ঠিকমতো কানে না-শোনা অথবা চোখে না-দেখা নিয়ে অনেক ক্ষেপিয়েছি। সেদিন মনে হলো কিছুটা হলেও কৃত পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়েছে।

আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত না হয় হলো, কিন্তু এই সমাজ কবে তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবে? মানলাম আমাদের দেশটা গরিব, দেহেমনে সুস্থ মানুষের অধিকারের নিশ্চয়তাই যে জায়গায় দেশ দিতে পারেনা, সে জায়গায় প্রতিবন্ধীদের অধিকার নিয়ে চেঁচিয়ে লাভ নেই, কিন্তু তাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে তো টাকা লাগে না? তারাও আর সবার মতো মানুষ, এই কথাটা  মেনে নিতে পারলে তো এভাবে আড়ালে-আবডালে থেকে জীবন কাটাতে হয় না তাদের।

একবার এক বন্ধু আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আচ্ছা এদেশে (ইউকে) এত বেশি পঙ্গু মানুষ কেন বলো তো? পথে-ঘাটে, বাজারে, পার্কে—সর্বত্র প্রচুর প্রতিবন্ধী দেখা যায়। এদের ওপর আল্লাহর গজব আছে মনে হয়।’  শুনে আমি হেসেই ফেললাম। আমাদের দেশে প্রতিবন্ধীদের ঠিক মানুষ বলে ভাবা হয় না, তাদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা নেই, তাদের গৃহবন্দি করে রাখা হয় বলেই তাদের কোথাও দেখা যায় না। নিম্নবিত্ত শ্রেণির বিকলাঙ্গ মানুষরা অন্তত ভিক্ষা করে জীবিকা বৃত্তির চেষ্টায় বাইরে বেরোন, তাই তাদের পথে-ঘাটে দেখা যায়। কিন্তু উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্ত পরিবারের বিকলাঙ্গ বা মানসিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সাধারণত অন্যের কৃপার ওপর নির্ভর করেই জীবন কাটান, কিন্তু চার দেয়ালের ভেতরে আবদ্ধ থেকে। পার্থক্য শুধু এখানেই।

সেদিনের রিভিউ মিটিংয়ের আলোচনা থেকে বের হয়ে এলো  আমাদের আরও একটি বড় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যার কথা। মেয়েটির মা তার মেয়ের অর্বাচীনতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে গিয়ে ঠিক ঝেড়ে কাশতে পারছিলেন না। তিনি বলছিলেন তার দুশ্চিন্তা হচ্ছে, মেয়েটি নিজের ভালোমন্দ, নিরাপত্তার বিষয়টা ঠিক বোঝে না। সে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে না। আসলে তিনি বলতে চাচ্ছিলেন, কখনও যৌন নির্যাতনের শিকার হলে কী করতে হবে, তা সে জানে না। আমি বুঝতে পারছিলাম, তিনি কী বলতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু তিনি স্পষ্ট করে না বললে আইনত তার কথার মর্মার্থ আমি অনুবাদ করতে পারছিলাম না। অনেক ধ্বস্তাধ্বস্তির পরও তার মুখ থেকে তার উদ্বেগের কথাটি স্পষ্টভাবে বের করতে না পেরে আমি ডেপুটি হেডকে বললাম, ‘She’s not actually saying it, but implying that her daughter won’t know what to do if she falls victim to sexual abuse at any stage.’

শুনে ডেপুটি হেড বলল, ‘তাকে বলো, এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা ‘ইমপ্লিকেশনে’ বিশ্বাস করি না। আমরা স্পষ্টভাবে শরীরের সবগুলো অঙ্গ নিয়ে ক্লাসে আলাপ করি এবং দেহের কোন কোন অঙ্গে কেউ হাত দেওয়া উচিত নয়, তাও স্পষ্টভাবেই বাচ্চাদের শেখাই। কাজেই আমার বিশ্বাস সে রকম কিছু হলে কী করতে হবে, তা মিনারা (কল্পিত নাম) ঠিকই জানবে।‘

আবারও আমার বোনের কথা মনে পড়ে গেল। তাকে এসব কিছুই কখনও শেখানো হয়নি, বরং যেহেতু তার কখনও বিয়ে হবে না সেহেতু তাকে যৌনতার বিষয়টা সম্পর্কে পুরোপুরিই অজ্ঞ রাখা হয়েছিল, যার ফল তেমন একটা শুভ হয়নি। আমিও বিষয়টা ‘এক্সপ্লিসিটলি’ আলোচনা না করে ‘ইম্পলাই’ করেই গেলাম। হাজার হোক, আমিও আরেকজন বাঙালিই তো! আপনারা কষ্ট করে বুঝে নেবেন তার অশুভ পরিণাম ঠিক কী হয়ে থাকতে পারে।

আমাদের দেশে মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের মানবিক অধিকার পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিত করা হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু সংশ্লিষ্ট সবার কাছে অনুরোধ—তাদের সঙ্গে ‘সদয়’ হবেন না, কারও  দয়া তাদের প্রয়োজন নেই।  শুধু তাদের নিজের মতো মানুষ ভাবুন, আপাতত এটুকুতেই চলবে।

লেখক: অভিবাসী শিক্ষক ও অনুবাদক

 

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ