X
সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫
২৩ আষাঢ় ১৪৩২

কিছু কোটা রাখতে হবে, কিছু কোটা থাকতে হবে

জোবাইদা নাসরীন
০১ অক্টোবর ২০১৮, ১৪:৪৪আপডেট : ০১ অক্টোবর ২০১৮, ১৫:২৭

জোবাইদা নাসরীন বাংলাদেশে সব প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোনও ধরনের কোটাই থাকবে না বলে সরকার ঘোষণা দিয়েছে এবং মন্ত্রী পরিষদ অনুমোদন দিয়েছে। বাংলাদেশে আট মাস ধরেই চলছে কোটা সংস্কার আন্দোলন। ঘটেছে নানা ধরনের ঘটনা। কয়েক দফা পুলিশের লাঠির বাড়ি, টিয়ার গ্যাস, জলকামান  এবং ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের দফায় দফায় হামলায় আক্রান্ত হয়েছেন আন্দোলনকারীরা। হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে ভেঙে দেওয়া হয়েছে এক শিক্ষার্থীর মেরুদণ্ড। আক্রান্ত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবন। আটক  হয়েছেন এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া কয়েকজন শিক্ষক। সাম্প্রতিক সময়ে এই আন্দোলনকে ঘিরে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে গ্রেফতার হয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। আন্দোলন বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়লেও মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই এই আন্দোলন এগিয়েছে।
কোটা আন্দোলনের পক্ষে-বিপক্ষে বাহাস চলেছে, খোদ ছাত্রলীগের অনেক হল পর্যায়ের নেতারাও জড়িয়েছিলেন এই আন্দোলনে। আবার কোটাবিরোধীরা কোটার সংস্কার চাইলো, কিন্তু সরকার এটাকে অনুবাদ করলো কোটা বাতিল হিসেবে। কোটা আন্দোলনকারীরা সরাসরি মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিরোধিতা না করলেও মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের জন্য কোটা রাখার বিপক্ষে তাদের জোর অবস্থান ছিল। কোটা আন্দোলনকারীদের মূল জায়গা কোটা সংস্কারের দাবির মুখে সরকার যখন কোটা বাতিলের পক্ষে অবস্থান নিলো তখন কোটা আন্দোলনকারীরা এর বিরুদ্ধে তেমন কোনও বড়সড় আন্দোলন দাঁড় করাতে পারেনি; বরং তারা সরকারকে চাপ দিয়েছে কোটা বাতিল বিষয়ে প্রজ্ঞাপন দ্রুত জারির।

শ্রেণি, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গীয় অসমতার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই দেশে কোটা সংস্কার একটি যুগের চাহিদা হলেও কোটা বাতিল সমাজের অসমতা এবং বৈষম্যকে যে আরও বাড়িয়ে তুলবে সেই বিষয়ে কারও সন্দেহ নেই। শুধু পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীই নয়, কোটা পদ্ধতি বাতিল হওয়ার কারণে বাংলাদেশের বেশ কিছু এলাকার মানুষ বঞ্চিত হবেন চাকরি থেকে। কিছুটা দেরিতে হলেও সমস্ত কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত এবং বিশেষ করে ‘আদিবাসী’দের জন্য নির্ধারিত ৫ শতাংশ কোটা বহাল রাখার জন্য আন্দোলন করছেন ‘আদিবাসী’ শিক্ষার্থীরা। 

এখনও আসলে আমাদের বোঝাপড়ায় খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো কোটা আসলে কী এবং কেন এটি প্রয়োজন? এই বিষয় নিয়ে আট মাস ধরেই চলমান আছে অনেক বিতর্ক। যখন কোনও দেশ বা সমাজে শ্রেণিস্পষ্ট থাকে, সমাজে বিদ্যমান অসমতার কারণে কোনও কোনও জাতি, লিঙ্গ, শ্রেণি বা বর্ণের মানুষ পিছিয়ে থাকে কিংবা অধিকার প্রাপ্তির জায়গায় সমভাবে দৌড়াতে পারে না, তাদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়। যাকে বলা হয়ে থাকে ‘ইতিবাচক বৈষম্য’ কিংবা ‘ইতিবাচক পদক্ষেপ’। আমাদের অনেকের মধ্যেই এ ধরনের ধারণা কাজ করে যে সমতা মানে সবাইকে সমান দেওয়া। কিন্তু যেখানে অসমতা বিরাজমান সেখানে সমতা মানে যার যতটুকু দরকার তা দিয়ে সবাইকে সমঅবস্থায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। তাই সমঅধিকার নিশ্চিত করার একটি বড় জায়গা হলো এই  ‘ইতিবাচক বৈষম্য’কে সামনে আনা।

কোটা সংস্কার হয়তো এতো তাড়াতাড়ি সমাধানযোগ্য কোনও বিষয় নয়। কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এ পর্যন্ত কোটার সুফল কতটুকু হয়েছে, যাদের জন্য কোটা প্রযোজ্য তারা গত পঁয়তাল্লিশ বছরে কতটুকু এগিয়েছে সেটির একটি পরিষ্কার চিত্র হাতে থাকা এবং সেই সঙ্গে দরকার ছিল কাদের জন্য এখন কোটা নতুন করে প্রয়োজন সেটির একটি তালিকা তৈরি করা। যেমন, এখন বাংলাদেশে দলিত এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য চাকরিক্ষেত্রে কোটা খুবই প্রয়োজন।

এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্মই হয়েছিল বঞ্চনা এবং বৈষম্যের অভিজ্ঞতার ক্রোধ থেকে। সেই অভিজ্ঞতাই বাংলাদেশকে নিয়ে গিয়েছিল সমতার মতাদর্শে, যার কারণে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কোটা চালু করা হয়েছিল নতুন স্বীকৃতি পাওয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রে। বয়সে হয়তো এখন আর তত নবীন নয় রাষ্ট্রটি, তবে গণতান্ত্রিক এবং সমতার প্রশ্নে এখনও ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে নিজেকে সরাতে পারেনি। তাই সব কোটা বাতিল হওয়া আসলে দেশের জন্য কোনোভাবেই মঙ্গল হবে না। ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী, দলিত, প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র পেশাজীবী, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা বহাল রাখতে হবে। কারণ, এটা তাদের ন্যায্য অধিকার ও দাবি। দেশে আদিবাসীসহ দলিত, প্রতিবন্ধী, চা শ্রমিক, ক্ষুদ্র পেশাজীবী জনগোষ্ঠীর মানুষ নানা দুর্গম অঞ্চলে বসবাস করছেন। তাদের অনেকেই শিক্ষা, চাকরি, এবং তথ্যের দিক থেকে অনগ্রসর ও পিছিয়ে রয়েছে। দেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এই পিছিয়ে পড়া অংশকে যুক্ত করতে হবে এবং তা করতে তাদের জন্য কোটা রাখা প্রয়োজন। তাই পিছিয়ে পড়া এ জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকারি সব চাকরিতে বিদ্যমান পাঁচ শতাংশ কোটা ব্যবস্থা বহাল রাখতে হবে। কোটা জারি রাখার সঙ্গে কিছু বিষয়ের ওপর অবশ্যই নজর রাখা প্রয়োজন।

প্রতি পাঁচ বছর অন্তর একটি মূল্যায়ন প্রয়োজন। এর পাশাপাশি সকলে যেন এই কোটার সুবিধাটি পায় সেই বিষয়েও নজর রাখতে হবে। প্রত্যেকেই যেন জীবনে কোনও একবার কোটার সুবিধা পায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। দেখা যায় যে একই ব্যক্তি শিক্ষায়, চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে বারবার কোটার সুবিধা কাজে লাগাচ্ছেন, কিন্তু অন্যরা সুযোগটা পাচ্ছন না। এক্ষেত্রে সকলের জন্য কোটার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। যিনি শিক্ষাক্ষেত্রে, যেমন- বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবহার করবেন তিনি যেন আর চাকরির ক্ষেত্রে সেটি ব্যবহার করতে না পারেন। এবং প্রার্থীদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি কোটার সুযোগটি কোথায় ব্যবহার করবেন। কারণ, আপনার কোটার অধিক ব্যবহারে আরেকজন বঞ্চিত হতে পারে। কারণ, দেখা গিয়েছে যে পিছিয়ে থাকা জাতি, গোষ্ঠীর মধ্যে যারা তুলনামূলক এগিয়ে আছে তারাই কোটার সুযোগ গ্রহণ করছেন এবং কোটাও তাদের মধ্যেই সীমিত হয়ে আছে। অন্য আরও যারা পিছিয়ে আছেন তারা পাচ্ছেন না। তাই কোটা রাখার পাশাপাশি কোটার ব্যবহার ঠিকমতো হচ্ছে কিনা সেই বিষয়ও নজরে রাখতে হবে।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (৭ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (৭ জুলাই, ২০২৫)
মধ্যরাতে সংবর্ধনায় বিশ্বকাপ স্বপ্নের কথা বললেন ঋতুপর্ণা ও আফঈদারা 
মধ্যরাতে সংবর্ধনায় বিশ্বকাপ স্বপ্নের কথা বললেন ঋতুপর্ণা ও আফঈদারা 
গণভবন জয় করেছি, এবার জাতীয় সংসদ জয় করবো: নাহিদ ইসলাম
গণভবন জয় করেছি, এবার জাতীয় সংসদ জয় করবো: নাহিদ ইসলাম
একটি দলের কারণে ঐকমত্য কমিশনে মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবনা আটকে যাচ্ছে: আখতার
একটি দলের কারণে ঐকমত্য কমিশনে মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবনা আটকে যাচ্ছে: আখতার
সর্বশেষসর্বাধিক