X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

রাজউক থেকে কেন নথি হারিয়ে যায়?

হারুন উর রশীদ
০১ এপ্রিল ২০১৯, ১৫:২০আপডেট : ০১ এপ্রিল ২০১৯, ১৫:৫৫

হারুন উর রশীদ বনানীর এফ আর টাওয়ারের নথি নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সংবাদ মাধ্যমকে রাজউক চেয়ারম্যান নিজেই এ কথা বলেছেন। কিন্তু ওই ভবনের মালিকপক্ষ বলছে তারা অনুমোদন নিয়েই ভবনটি তৈরি করেছেন। তাই বিষয়টি প্রমাণে নথি প্রয়োজন। এই অবস্থায় মনে প্রশ্ন জাগে, এত প্রয়োজনীয় নথি রাজউক থেকে কেন হারিয়ে যায়?
আগুনে ২৬ জনের মৃত্যুর সব ক্ষোভ এবং রাগ এখন বনানীর ওই ভবনের ওপর। কিন্তু ভবনটি তো মাটি ফুঁড়ে নিজে জন্ম নেয়নি। সেটা যদি হতো তাহলে আমরা সহজেই এফ আর টাওয়ারের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করতে পারতাম। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয়। তার জন্মের পেছনে আছে মানুষ। এই যারা আছেন তাদের মধ্যে আবার কয়েকটি ভাগ আছে।
১.জমির মালিক ও ভবনের মালিক;
২. ডেভেলপার;
৩. রাজউক।
এর বাইরেও আছে ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ ১৬ ধরনের প্রতিষ্ঠান যাদের অনুমোদন বা অনাপত্তি নিতে হয়। আরো আছেন স্থপতি, প্রকৌশলী।
তাই এটা নিশ্চিত, ওই ভবনটি গোপনে বা রাতের আঁধারে তৈরি হয়নি। সেটা করাও সম্ভব নয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, একমাত্র ভবনই হচ্ছে এমন স্থাপনা যা গোপনে তৈরি সম্ভব নয়। এমনকি মাটির এক কিলোমিটার নিচে তৈরি হলেও তা স্যাটেলাইটে ধরা পড়ে।
ঢাকা শহরে ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়ার মূল কর্তৃপক্ষ হল রাজউক বা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। এফ আর টাওয়ার নিয়ে এখন নানা রকম তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হল ভবনটির ১৯ থেকে ২৩ এই ৫টি তলা নির্মাণে রাজউকের কোনো অনুমোদন নেই। এই তথ্য যদি আমরা বিশ্বাস করি তাহলে বলতে হবে এই ৫টি ফ্লোর গোপনে নির্মাণ করা হয়েছে রাতের আঁধারে অথবা লোকচক্ষুর অন্তরালে। বনানীর মত অভিজাত জনবহুল এলাকায় এটা সম্ভব? এটা কেউ বিশ্বাস করবেন?
চোখের সামনে ৫টি ফ্লোর নির্মাণ হল। তারপরও সেখানে নানা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ব্যবসা শুরু করল। রাজউকের চোখে পড়ল না। তাহলে তো বলতে হয় অন্ধ রাজউক!
এখন কেউ বলতে পারেন, মালিকপক্ষ প্রভাব খাটিয়ে ওই অনুমোদন নিয়েছে। সেটা হতে পারে। কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে নেওয়া হোক বা যেকোনো উপায়ে নেওয়া হোক অনুমোদন তো নেওয়া হয়েছে। রাজউক কোনো দিনও কিন্তু সেটা আগুনে মানুষ মারা যাওয়ার আগে বলেনি। আর প্রভাবশালীদের প্রভাব কমার পরও কিন্তু তারা অনুমোদন বাতিল বা অনিয়মের কথা বলেনি।
আসলে রাজউকের কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়া ওই ভবন বা ভবনের বর্ধিত ৫টি ফ্লোর নির্মাণ সম্ভব হয়নি। এটাই বাস্তবতা। এটাই সত্য।
ভবনের ৮ বা ৯তলায় আগুনের সূত্রপাত। তা ছড়িয়েছে ১২ তলা পর্যন্ত। আর এর প্রভাব পড়েছে ভবনের শেষ ফ্লোর পর্যন্ত। ফায়ার সার্ভিস বলেছে পুরো ভবনেই ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম নেই। আগুনের সময় কোনো ফায়ার অ্যালার্ম বাজেনি। নেই কোনো বিকল্প সিঁড়ি। তাহলে ২০০৫ সালে ১৮তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন কীভাবে দিল রাজউক?
এখন এই ভবনটির নথি নেই রাজউকের কাছে। তাহলে এই ভবন নির্মাণে কীভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল, কারা অনুমোদন দিয়েছিলেন তা আর জানা যাবে না! একইসঙ্গে বাড়তি ৫ তলার কাহিনীর সঙ্গে জড়িত রাজউকের কর্মকর্তারাও আড়ালে থেকে যাবেন। ধরা পড়বেন মালিক, ডেভেলপার।
কেন নথি হারায়?
এই ভবনটির নথি হারানোর বিষয়টি আমার কাছে কোনো দৈব বা দুর্ঘটনা বলে মনে হয় না। খোঁজ নিলে জানা যাবে এরকম আরো অনেক ভবনের নথি পাওয়া যাচ্ছে না। এর কারণ অনেক গভীরে। এর সঙ্গে জড়িত আছে চক্র। এই নথি গায়েবে কার লাভ হলো সেটা বিবেচনা করলেই বোঝা যাবে কেন নথি গায়েব হয়।
১.নথি গায়েবের ফলে রাজউকের যেসব কর্মকর্তা অনুমোদনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তা আর জানা যাবে না।
২.এই অনুমোদনে লেনদেন হয়েছিল কিনা তাও জানা যাবে না।
৩. প্রয়োজনীয় যেসব কাগজপত্র ছাড়াই অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল তাও জানা যাবে না।
তাহলে এটা স্পষ্ট, নথি গায়েব হয় রাজউকের যেসব কর্মকর্তা অবৈধ অনুমোদনের সঙ্গে জড়িত তাদের রক্ষা করার জন্য। এটা অন্য কেউ করেন না। যারা অবৈধ কাজ করেন তারাই নথি গায়েবের সঙ্গে জড়িত। তাইতো এবার এফ আর টাওয়ার নিয়ে যে মামলা হলো তাতে তিনজন আসামি। জমির মালিক, মূল ভবনের মালিক এবং বর্ধিত ৫টি ফ্লোরের মালিক। ধরে নিতে পারি তারা নানা কৌশলে ভবনটির অনুমোদন অবৈধভাবে নিয়েছেন। এটা নিশ্চয়ই অপরাধ। কিন্তু যে রাজউক কর্মকর্তারা অবৈধ অনুমোদন দিলেন তাদের অপরাধ তো আরো বড়। কিন্তু তাদের কেউ এই মামলায় আসামি হলেন না। এর কারণ নথি যেহেতু নেই জানাও যাচ্ছে না অনুমোদন প্রক্রিয়ায় কোন কোন কর্মকর্তার কী ভূমিকা ছিল। তারা কারা এবং কোথায় আছেন।
গণপূর্তমন্ত্রী অবশ্য দাবি করেছেন তদন্ত প্রক্রিয়ায় জড়িত রাজউক কর্মকর্তাদের নাম বেরিয়ে আসবে। তাহলে আমার প্রশ্ন মামলার এজাহারে কেন ওই তিনজনের নামসহ জড়িত অজ্ঞাত পরিচয় রাজউক কর্মকর্তারা শব্দগুলো রাখা হলো না? আমরা তো হাজার হাজার মামলায় অজ্ঞাত পরিচয় আসামি দেখতে পাই। এখানে তার ব্যতিক্রম কেন?
আসলে পুরো মামলায় রাজউককে বাঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোথাও বলা হয়নি রাজউকের অবৈধভাবে অনুমোদন দেওয়া ভবন। রাজউককে কোনোভাবেই দায়ী করা হয়নি। অথচ ভবন নির্মাণের অনুমোদনে রাজউকের শীর্ষ থেকে নিচ পর্যন্ত অনেক কর্মকর্তা জড়িত।
উদাহরণ বিজিএমইএ ভবন
আরেকটি প্রশ্ন উঠতে পারে, রাজউক যদি এফ আর টাওয়ারের যেকোনোভাবেই অনুমোদন দিয়ে থাকে তাহলে ভবনের মালিকপক্ষের দায় কী? এর জবাব সহজ একটি উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। হাতিরঝিলে বিজিএমইএ ভবনের সব ধরনের অনুমোদন দিয়েছে রাজউক। দেশের প্রধান নির্বাহীরা এই ভবনের একাধিকবার উদ্বোধন এবং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন। তারপরও দেশের সর্বোচ্চ আদালত বিজিএমইএ ভবন অবৈধ ঘোষণা করেছেন। সরিয়ে নিতে বলেছেন। এর কারণ হলো রাজউকের অনুমোদন প্রক্রিয়াটিই ছিল অবৈধ। তারা আইন মেনে অনুমোদন দেয়নি। তাই রাজউক অনুমোদন দিলেই সেটা যে সব সময় বৈধ হয়ে যাবে তা কিন্তু নয়।
আর এখানেও দেখুন বিজিএমইএ ভবন সরে যাচ্ছে, কিন্তু রাজউকের যারা এই অবৈধ অনুমোদন দিয়েছেন অথবা অন্যান্য কর্তৃপক্ষ যারা অবৈধভাবে ছাড়পত্র দিয়েছেন তাদের কোনো কর্মকর্তার কিন্তু শাস্তি হয়নি। আদালতও কিন্তু তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করেনি। যারা দেশের দুজন প্রধানমন্ত্রীকে বিভ্রান্ত করেছেন তাদের শাস্তি তো দূরের কথা চিহ্নিত করারই উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
নথি গায়েবের অপরাধে মামলা চাই
এফ আর টাওয়ারের আগুনের ঘটনায় দুজনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এজাহারভুক্ত আরেকজনকে এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি। তবে এখন আরো একটি কাজ জরুরি। আর তা হলো এফ আর টাওয়ারের নথি গায়েব নিয়ে আরেকটি মামলা করা। কার নথি গায়েব করেছে সেটা চিহ্নিত করা। সেটা করা হলে আমি মনে করি নথিও পাওয়া যাবে। আসল ক্রিমিনালদেরও পাওয়া যাবে।
রাজউক থেকে নথি হারালেও আমার ধারণা এফ আর টাওয়ারের ছায়া নথি ভবনের মালিকপক্ষের কাছে আছে। তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদেও তা পাওয়া যেতে পারে। পাওয়া যাবে। সুতরাং সদিচ্ছা থাকলে নথি গায়েব হলেও নথি আবার ফিরে আসবে।
প্রয়োজন সদিচ্ছা। প্রয়োজন প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তির ব্যাপারে আন্তরিক থাকা। কিন্তু যদি অপরাধীদের বাঁচানোর জন্য আন্তরিক হন তাহলে নথি আর পাওয়া যাবে না। ছায়ানথিও গায়েব হবে। আর ‘সরল বিশ্বাসে’ করেছি’ বাঁচানোর এমন সহজ ফর্মুলা তো আছেই।
পুনশ্চঃ গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি এফ আর টাওয়ারের নথি এবং নকশা ছাড়াই তদন্ত শুরু করেছে। রাজউক তাদের বলেছে, তারা নথি এবং নকশা হারিয়ে ফেলেছে।

লেখক: সাংবাদিক
ইমেইল:[email protected]

/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পানিতে ডুবে ভাইবোনসহ ৩ শিশুর মৃত্যু
পানিতে ডুবে ভাইবোনসহ ৩ শিশুর মৃত্যু
‘এমপি হতে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে, এটা তুলবো, এটুকু অন্যায় করবো-ই’
‘এমপি হতে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে, এটা তুলবো, এটুকু অন্যায় করবো-ই’
ইডি হেফাজতে আরও ৪ দিন কেজরিওয়াল
ইডি হেফাজতে আরও ৪ দিন কেজরিওয়াল
ভাইস চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নারী উন্নয়ন ফোরামের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
ভাইস চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নারী উন্নয়ন ফোরামের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ