X
সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫
২৩ আষাঢ় ১৪৩২

এ কেমন উন্নয়ন?

বিধান রিবেরু
২০ আগস্ট ২০১৯, ১৩:৪১আপডেট : ২০ আগস্ট ২০১৯, ১৩:৪৩

বিধান রিবেরু রাজধানীতে অনেক বড় বড় উড়ালসেতু হচ্ছে, মেট্রোরেলের জন্য লাইন বসছে, নতুন নতুন কেনাকাটার দোকান হচ্ছে, বাহারি স্বাদের খাবারের পসরা সাজিয়ে নয়া নয়া রেস্তোরাঁ খোলা হচ্ছে, দামি দামি গাড়ি প্রতিদিন রাস্তায় নামছে, এসব দেখে আপনার মনে হতে পারে সত্যি বাংলাদেশ অনেক উন্নত হয়ে যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তো মার্চ মাসেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
দেশ বলতে আসলে আমরা কী বুঝি? দেশ মানে এক লোকের পাশে অন্য লোক। দেশের জনগণই আসলে দেশ। একটি জনগোষ্ঠীর মুষ্টিমেয় বড়লোক কখনও দেশের গোটা মানচিত্রকে তুলে ধরতে পারে না। মানচিত্রকে তুলে ধরতে হলে সামনে আনতে হয় গোটা মানুষচিত্রকে। এই মানুষচিত্র আদতে কেমন এখন বাংলাদেশের?
সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সামাজিক সুরক্ষা খাতে খরচের দিক থেকে বাংলাদেশ এশিয়ার নিচের দিককার পাঁচটি দেশের একটি। ‘দ্য সোশ্যাল প্রোটেকশন ইন্ডিকেটর ফর এশিয়া: অ্যাসেসিং প্রোগ্রেস’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, এশিয়ার ২৫টি দেশের ভেতর বাংলাদেশের অবস্থান ২১ নম্বরে। বাংলাদেশের পেছনে আছে মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ভুটান ও লাওস। এই তালিকার শীর্ষে রয়েছে জাপান।
জাপান নিজেদের জিডিপির ২১ শতাংশের বেশি খরচ করে সামাজিক সুরক্ষা খাতে। জাপানে সেই অর্থে দরিদ্র লোক নেই, তারপরও তারা এতটা খরচ করে। উল্টো দিকে বাংলাদেশ এই খাতে ব্যয় করে জিডিপির ১ দশমিক ২ শতাংশ পরিমাণ অর্থ। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, বাংলাদেশের ধনীরা গরিবদের চেয়ে সামাজিক সুরক্ষা পায় চারগুণ বেশি। আর নারীদের চেয়ে সুবিধা বেশি পায় পুরুষরা। দেশে বিধবা ভাতা, গরিব নারীদের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা ভাতা ইত্যাদি থাকলেও বাংলাদেশের সব নাগরিকের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাংলাদেশ সরকারের নেই।
এই প্রতিবেদন থেকেই পরিষ্কার, জিডিপি যতই বাড়ুক, যতই রাস্তাঘাটে মেট্রোরেল অথবা দামি গাড়ি ছুটোছুটি করুক, গরিবের ভাগ্যে তাতে শিকে ছিঁড়ছে না। জিডিপির অঙ্ক ধরে হয় তো আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে চিহ্নিত করবো বাংলাদেশকে, তবে এই সম্পদ সমাজের তলানিতে থাকা বিপুল সংখ্যক জনগণের কাছে পৌঁছুচ্ছে না, এটাই বাস্তবতা। এক স্বাস্থ্যখাত দেখলেই সেটা পরিষ্কার হয়ে যায়। বড়লোকেরা কী ধরনের স্বাস্থ্যসেবা পায়, আর গরিবেরা কেমন পায়?
চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই বৈষম্য দূর করার মধ্য দিয়ে, কথিত সোনার বাংলাদেশ গড়ার যে কথা আমরা শুনি, সেটা বাস্তবে প্রতিফলিত হবে বলে আমি মনে করি। দেশের বাইরে যেন যেতে না হয়, সেজন্য দেশেই মানসম্পন্ন চিকিৎসক ও হাসপাতাল নির্মাণের ‘যুদ্ধ’ শুরু করা প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, চিকিৎসা খাতে গবেষণার পরিমাণও বাড়াতে হবে। এতে করে ডেঙ্গু বলি বা কর্কট রোগ, এ ধরনের মরণব্যাধির মোকাবিলা করা যাবে যথাযথভাবে। তখন ‘গরিবের ঘোড়ারোগ’ প্রবাদটি ঘোচানো যাবে। আর এজন্য দরকার অর্থ বরাদ্দ। বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ যদি পুরোটার সদ্ব্যবহার হতো, তাহলেও হয়তো চিত্র অনেকখানি পাল্টে যেতো।
ফিরে আসি সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের দিকে। আমার মনে হয় এই বলয়ে শিশুদের ওপর অধিক মনোযোগ দেওয়া জরুরি। একটি দেশে শিশুরা কীভাবে বড় হচ্ছে সেটার দেখভাল করার দায়িত্বও সরকারের। এখন একক পরিবারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায়, চাকরিজীবী, বিশেষ করে পোশাকশিল্প কারখানায় কাজ করে এমন বাবা-মায়ের সংখ্যা অনেক, কিন্তু তাদের সন্তানদের দেখে রাখার মতো রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনও অবকাঠামো তৈরি করা হয়নি, যাতে শিশুদের দিনের বেলা দেখভাল ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার দেওয়া হবে। অথচ রাষ্ট্র বরাবরই বলে, আজকের শিশু আগামীদিনের ভবিষ্যৎ। তো কেমন ভবিষ্যৎ রচনা করছেন আপনারা? সমাজের যারা এলিট, তারা তো সন্তানদের আধা বিদেশি অথবা পুরো ভিনদেশি করে বড় করছে, তাদের দুই পা সর্বদাই বিদেশে থাকে, যারা মধ্যবিত্ত তারা সন্তানদের বড় করে এটা ভেবে, তাদের ছেলেমেয়েরাও একদিন দেশ ছেড়ে চলে যাবে। বাকি থাকে নিম্নবিত্ত মানুষের সন্তানরা। তাদের আসলে দেশে থাকা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। আর তাদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। তাদের কি সামাজিক সুরক্ষার ভেতর আনা যায় না? দরিদ্র শিশুদের যদি একটি সুন্দর শৈশব দেওয়া যায়, তাহলে তারা সমাজের জন্য অনেক বড় সম্পদ হয়ে উঠবে। তবে এসব কথা কে কাকে বলবে? আর কে এসব শুনে ঝাঁপিয়ে পড়বে? সবাই নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত।
দেশের কোটি কোটি মানুষ হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে অর্থনীতির চাকাকে বেগবান করছে, আর তার সুযোগ নিয়ে কিছু মানুষ অর্থ নিজের পকেটেই শুধু ভরছে না, পাচার করে দিচ্ছে বিদেশে, দেশে বিনিয়োগ করলেও একটা কথা ছিল, তারা সেটা করছে না। আমরা তো জানি শুধু ২০১৫ সালেই বাণিজ্যে নয়ছয় করে ৫০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। এমন হাজার হাজার কোটি টাকা প্রতিবছরই পাচার হয়ে যাচ্ছে, আর দেশের মানুষচিত্র হয়ে পড়ছে কঙ্কালসার। এমন উন্নয়ন তো মানুষ চায় না, যে উন্নয়নে শুধু ডান হাত বড় হতে থাকে, আর বাম হাত ছোট হতে থাকে। এমন উন্নয়ন তো বিকৃত, সুষম বিকাশ সেখানে বাধাগ্রস্ত হয়ে আছে। কেন আছে সেটার উত্তর এদেশে যারা রাজনীতি করেন, যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করে খান তারা ভালো দিতে পারবেন। আমরা শুধু দেখি বৈষম্যের বাংলাদেশে বড় ধরনের গহ্বর তৈরি হচ্ছে। এই গহ্বর কৃষ্ণগহ্বর।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (৭ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (৭ জুলাই, ২০২৫)
মধ্যরাতে সংবর্ধনায় বিশ্বকাপ স্বপ্নের কথা বললেন ঋতুপর্ণা ও আফঈদারা 
মধ্যরাতে সংবর্ধনায় বিশ্বকাপ স্বপ্নের কথা বললেন ঋতুপর্ণা ও আফঈদারা 
গণভবন জয় করেছি, এবার জাতীয় সংসদ জয় করবো: নাহিদ ইসলাম
গণভবন জয় করেছি, এবার জাতীয় সংসদ জয় করবো: নাহিদ ইসলাম
একটি দলের কারণে ঐকমত্য কমিশনে মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবনা আটকে যাচ্ছে: আখতার
একটি দলের কারণে ঐকমত্য কমিশনে মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবনা আটকে যাচ্ছে: আখতার
সর্বশেষসর্বাধিক