X
সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫
২৩ আষাঢ় ১৪৩২

ছাত্রলীগ চাঁদ, তার নিজের কোনও আলো নেই

ডা. জাহেদ উর রহমান
২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৭:০৬আপডেট : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৭:১০

ডা. জাহেদ উর রহমান শোভন-রাব্বানীকে বলি দেওয়া হয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই, তবে তারা কোনোভাবেই বলির পাঁঠা নন, যদিও মিডিয়ার কাছে সেরকমই দাবি করেছেন জনাব রাব্বানী। একটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘আমরা অপরাধী নই, আমাদের বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে, আমরা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি।’
বলির পাঁঠা ধারণাটি এসেছে ওল্ড টেস্টামেন্টের লেভিটিকাসের ষোড়শ অধ্যায় থেকে। পুরো ইসরায়েল জাতির পাপ মোচনের জন্য দুটো ছাগল-ভেড়াকে বলি দেওয়ার কথা উল্লেখ আছে সেখানে। দু’টির মধ্যে একটি ছিল ‘গোট ফর আজাজেল’, যেটিকে ইংরেজিতে ‘স্কেইপগোট’ নামকরণ করা হয়।  নেহায়েত নিরীহ একটা প্রাণী, নিরপরাধ তো বটেই, বলি হয়েছিল পুরো একটি জাতিকে পাপমুক্ত করার জন্য।  শোভন-রাব্বানীর সঙ্গে বলির পাঁঠার মূল পার্থক্য হলো—বলির পাঁঠা নিষ্পাপ ছিল, কিন্তু তারা তা নন।
আরও খুব বড় একটা পার্থক্য আছে। বলির সেই ভেড়াকে জবাই করে বা গায়ে আগুন ধরিয়ে বলি দেওয়া হয়নি।  সেই ভেড়াকে শিংয়ে একটা লাল সুতো বেঁধে চিহ্নিত করে মরুভূমিতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।  সুতো বাঁধা হয়েছিল এই কারণে যে, সে যেন খাবার বা পানির আশায় লোকালয়ের দিকে আসার সময় মানুষ তাকে চিনতে পারে। তখন মানুষ তাকে পাথর ছুঁড়ে দূরে সরিয়ে রাখবে। এভাবে পানি না পেয়ে এবং অনাহারে ভেড়াটি মৃত্যুবরণ করবে। এর তুলনায় শোভন-রাব্বানীকে তো কিছুই করা হয়নি; তাদের দলীয় পদ থেকে পদত্যাগ করানো হয়েছে মাত্র।

তাদের বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় তাদের পদচ্যুটি হয়েছে মানে এটা যেনতেন হালকা অভিযোগ নয়।  এটি অবশ্যই একটা ক্রিমিনাল অফেন্স, কিন্তু এর জন্য তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি।  ছাত্রনেতা হয়েও এই দুই জনের বিলাসবহুল জীবনযাপনের বিস্তারিত বর্ণনা পত্রিকায় এসেছে।  সেগুলোর বিরুদ্ধেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ‌এই দুই জন আসলেই অনেক সৌভাগ্যবান। তবে এটি মানতে কোনও দ্বিধা নেই যে, এই সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের বহু মানুষের তুলনায় তারা চুনোপুঁটিও নয়। কিন্তু তাদের বলি দেওয়া হলো।

আমরা অনেকেই মনে করতে পারবো, এর আগে ছাত্রলীগের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী সংগঠনটির সাংগঠনিক প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। অর্থাৎ বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগকে বলি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু দলের পাপমোচন কি হলো? পাপ মোচন এভাবে হয় না, বোধ করি আওয়ামী লীগও সেটা মানে, তবু ছাত্রলীগকে বলি দেওয়া হয়। এর পেছনে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ চাতুর্য আছে সরকারি দলের।  সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি।

সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর পরে বাংলা ট্রিবিউনসহ অন্যান্য জাতীয় দৈনিকে অনেককেই লিখতে দেখছি ছাত্রলীগ কেন এমন হয়েছে, কিংবা ছাত্র রাজনীতির সংকট নিয়ে কথা বলছেন অনেকে। কেউ কেউ আবার যুবলীগ ও ছাত্রলীগকে এক পাল্লায় রেখে তারাই যাবতীয় অশুভর মূল, সেটা প্রমাণের চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ ছাত্রলীগকে প্রসঙ্গে এনে পুরো ছাত্র রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করছেন, আফসোস করছেন ছাত্র রাজনীতির সোনালি সময়ের কথা ভেবে।

শোভন-রাব্বানী ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর দীর্ঘদিন ছাত্র লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেননি।  এরপর যখন সেটা দেন তারা, তখন তাদের বিরুদ্ধে বিরাট একটা প্রতিপক্ষ গ্রুপের আন্দোলন হয়েছিল। তারা মিছিল করেছিলো, মাথা ফাটাফাটি করেছিলো, রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অনশন করেছিল দিনের পর দিন; এমনকী ঈদের দিনেও তাদের অনশনের খবর পত্রিকায় এসেছিল। আপাতদৃষ্টিতে কেউ বলতেই পারেন এই দেশের তরুণরা দেশ সেবার জন্য এতটাই উদগ্রীব, উন্মুখ হয়ে আছে যে কমিটিতে স্থান না পেয়ে তারা ভয়ঙ্করভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু দেশটা বাংলাদেশ এবং এই দেশে আমরা বাস করি বলেই জানি এই রকম উন্মুখ হয়ে থাকার কারণ হচ্ছে এখানে প্রতিটি পদে যাওয়া মানেই অকল্পনীয় পরিমাণ টাকা উপার্জন করার চাবি হাতে পেয়ে যাওয়া।

ছাত্রলীগ করা প্রতিটা ছেলেমেয়ে যখন ওপরের দিকে তাকায় তখন দেখে মূল সংগঠনটি এই দেশে কী বীভৎস পরিমাণ লুটপাট করে নিজের আখের গোছাচ্ছে। তারা দেখে এই দেশে পৃথিবীর যে কোনও দেশের তুলনায় চার-পাঁচ গুণ (ক্ষেত্রবিশেষে দশগুণ) বেশি ব্যয়ে রাস্তা, সেতু ফ্লাইওভার, রেলপথ বানানো হয়, সে দেখে এই দেশের ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে মেরে দেয় তার দলের সঙ্গে যুক্ত কিছু মানুষ, তারা দেখে এই দেশের শেয়ারবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দেওয়া মানুষ সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসে থাকেন।  ওপরের এই আচরণ অনিবার্যভাবেই নিচের মানুষগুলোকে এই সাহস দেয় যে এটা করা তাদের জন্য ‘জায়েজ’ আছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা মনে করে যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নকাজে তাদের ‘ন্যায্য পাওনা’ থাকবে। তাই জনাব রাব্বানী এটা বুক ফুলিয়ে মিডিয়ায় বলতেও পেরেছেন।

আজ যারা ছাত্র রাজনীতির অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস নিয়ে আফসোস করছেন, তারা কি দেখছেন না—ওই সময় এর মূল সংগঠন এর চরিত্র কেমন ছিল? শুধু একটা বিশেষ রাজনৈতিক দল না, মোটের ওপর সব রাজনৈতিক দলের অবস্থা কেমন ছিল? দলগুলো কি ক্ষমতাসীন দলটির মতো মাফিয়াতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক ছিল? যতদিন মূল রাজনীতি সঠিক ছিল, ততদিন ছাত্ররাজনীতিও ছিল ঠিক পথে।  যেদিন থেকে সেই রাজনীতিতে পচন শুরু হয়েছে, সেদিন থেকে সেই পচন সংক্রমিত হয়েছে ছাত্ররাজনীতিতে।  হওয়াটাই স্বাভাবিক।

বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের হয়ে ‘মাঠ দখলে’ রাখায় খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ছাত্রলীগ-যুবলীগ।  বিশেষ করে ম্যান্ডেটহীন একটা সরকার যখন ভয়ঙ্কর রকম কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠে তখন এই তথাকথিত মাঠ দখলে রাখা খুবই জরুরি হয়ে পড়ে। বিরোধী দলের ওপর চরমতম নিষ্পেষণ চালানোর ক্ষেত্রে এরাই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। পুলিশও এই ব্যাপারে খুবই অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করলেও এখন অন্তত পুলিশ কোনও ভার্সিটির হলের রুমে গিয়ে কাউকে যখন তখন পিটিয়ে আসতে পারে না। কিংবা এখনও ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের নবনির্বাচিত সভাপতি সাধারণ সম্পাদক গেলে তাদের ওপর হামলা করতে পারে না। এই কাজগুলো ছাত্রলীগকেই করতে হয়।

ছাত্রলীগের এই যাবতীয় কাজ করার মূল উদ্দেশ্য থাকে তার মূল দলের ক্ষমতায় থাকাকে প্রলম্বিত করা। কিন্তু মজার ব্যাপার, যখনই সরকারের বিরুদ্ধে কোনও বড় সমালোচনা শুরু হয়, তখনই সরকারের মূল দলেরই প্রায় সবাই ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে মন্তব্য করতে থাকেন। এই মন্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সরকারের সুবিধাভোগী একটি বুদ্ধিজীবী বাহিনী নেমে পড়ে, প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে ছাত্রলীগ যাবতীয় নষ্টের মূল। ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে ছাত্রলীগই (ক্ষেত্র বিশেষে যুবলীগও) খারাপ, আর সবাই ভালো। এভাবে বারবার ছাত্রলীগকে বলি দিয়ে দলের কুকর্ম আড়াল করে মূল দলের ইমেজ রক্ষার চেষ্টা দেখা যায়। এবারও ঠিক সেই চেষ্টাটাই হচ্ছে।

আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, শিরোনামের কথাটি।  ছাত্রলীগ চাঁদ, তার নিজের কোনও আলো নেই, সে আলোকিত হয় সূর্যের আলোর। তার সূর্য হচ্ছে তার মূল সংগঠন আওয়ামী লীগ। যে দুর্নীতি, অনিয়ম, সন্ত্রাস আজ আমরা ছাত্রলীগের মধ্যে দেখছি, সেটার উৎস মূল দল। তাই সূর্যের আলোকে বাদ দিয়ে চাঁদের আলোর আলোচনা হতে পারে না। এই চর্চা যারা করেন, তারা হয় ভুল বোঝেন, নয় তো করেন মতলববাজি।

একটা বৈজ্ঞানিক তথ্য দিয়ে লিখাটা শেষ করা যাক—সবচেয়ে উজ্জ্বল চাঁদের উজ্জ্বলতার তুলনায়ও সূর্যের উজ্জ্বলতা ৪ লাখ গুণ বেশি।

লেখক: সদস্য, স্টিয়ারিং কমিটি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, নাগরিক ঐক্য

/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (৭ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (৭ জুলাই, ২০২৫)
মধ্যরাতে সংবর্ধনায় বিশ্বকাপ স্বপ্নের কথা বললেন ঋতুপর্ণা ও আফঈদারা 
মধ্যরাতে সংবর্ধনায় বিশ্বকাপ স্বপ্নের কথা বললেন ঋতুপর্ণা ও আফঈদারা 
গণভবন জয় করেছি, এবার জাতীয় সংসদ জয় করবো: নাহিদ ইসলাম
গণভবন জয় করেছি, এবার জাতীয় সংসদ জয় করবো: নাহিদ ইসলাম
একটি দলের কারণে ঐকমত্য কমিশনে মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবনা আটকে যাচ্ছে: আখতার
একটি দলের কারণে ঐকমত্য কমিশনে মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবনা আটকে যাচ্ছে: আখতার
সর্বশেষসর্বাধিক