X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

ইয়া নফসির যুগে কান্নার অধিকার চাই

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
১৮ অক্টোবর ২০১৯, ১৩:৪৬আপডেট : ১৮ অক্টোবর ২০১৯, ১৮:০৫

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার মক্কার মসজিদুল হারামের পাশে সংরক্ষিত খালি জায়গা আছে। ওই এলাকার জমির মূল্য বিবেচনায় এমন খালি জায়গা থাকা বিরল ঘটনা। কিন্তু আরবের লোকেরা জমির অর্থমূল্য বিবেচনার চেয়ে ঐতিহাসিক মূল্যকে গুরুত্ব দিয়ে আজও ওই জায়গাটি খালি রেখেছে। এক মক্কাবাসী বন্ধু বলছিলেন, প্রতিদিন আরবের স্থানীয় অধিবাসী, হজযাত্রী বা বিদেশি শ্রমিকসহ অন্যরা ওই খালি জায়গা একনজর দেখতে ভিড় করেন। আর নীরবে অশ্রু বিসর্জন দেন। আরবে প্রাক-ইসলাম যুগে কন্যাশিশুকে জীবন্ত কবর দেওয়ার প্রথাকে স্মরণ করতেই ওই জায়গা খালি রাখা হয়েছে। আর আগুন্তুকরা ওই জায়গায় এসে ওই ঐতিহাসিক ঘটনা স্মরণ করেই অশ্রুপাত করেন।

আল-কোরআন ও আল হাদিসে আইয়্যামে জাহেলিয়ার যুগের কন্যাশিশুকে জীবন্ত কবর দেওয়ার ঘটনার উল্লেখ আছে। আল কোরআনের সুরা নাহলের ৫৮ ও ৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর যখন তাদের কাউকে কন্যা জন্মগ্রহণের সুসংবাদ দেওয়া হয়, তখন তার চেহারা মলিন হয়ে যায় এবং অসহ্য অপমানে সে ক্লিষ্ট হতে থাকে। তাকে শোনানো সুসংবাদের দুঃখে সে লোকদের কাছ থেকে নিজের চেহারা লুকিয়ে রাখে। সে ভাবে, অপমান সহ্য করে তাকে (কন্যাশিশুকে) রাখবে, নাকি মাটির নিচে পুঁতে ফেলবে।’ সিয়া সিত্তার হাদিসগ্রন্থে উল্লেখ আছে, বনি তামিম গোত্রের প্রধান কায়েস বিন আসেম ইসলাম গ্রহণের পর তার প্রয়াত কন্যার কথা স্মরণ করে প্রায়শই অশ্রু বিসর্জন করতেন। একদিন ইসলামের নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) তার কাছে কেন তিনি অশ্রু বিসর্জন করেন, তা জানতে চান। তখন তিনি নবী মোহাম্মদের কাছে বর্ণনা করেন সেই ভয়াবহ কাহিনি, নিজ হাতে নিজের কন্যাসন্তানকে কবর দেওয়ার সেই মর্মান্তিক ঘটনা। নিজের কন্যাসন্তানকে তিনি আদর করে সাজিয়ে গুছিয়ে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে নির্জন মরুভূমিতে নিয়ে নিজ হাতে গর্ত খুঁড়ে জীবন্ত কবর দেন। এখনও তিনি সেই জীবন্ত কবর দেওয়া কন্যার মৃত্যুচিৎকার আর বাবা ডাক শুনতে পান। আর তার সেই অন্যায় কর্মের কথা স্মরণ করে অশ্রুপাত করেন। 

তৎকালীন আরবের সামাজিক প্রথা বিবেচনা করে কায়েস বিন আসেমের মতো হাজারও বাবাকে নিজ কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দেওয়া ছাড়া অবশ্য উপায় ছিল না। জাহেলিয়াতের আরবে কন্যাকে জীবন্ত কবর দেওয়ার ঘটনা ইতিহাসে বর্বর ঘটনা বলে চিহ্নিত হলেও প্রকৃতপক্ষে ওই সব বাবার উদ্দেশ্য ছিল অন্য। বাবারা কন্যাসন্তানের সম্ভ্রম রক্ষা করার চিন্তা থেকেই মূলত তাদের জীবন্ত কবর দিতেন। দারিদ্র্যপীড়িত আরবের বাবারা চিন্তা করতেন, তিনি কন্যাসন্তানকে বড় করে তুললেও হয়তো শেষ পর্যন্ত তার সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারবেন না। হয়তো দারিদ্র্যের কাছে পরাজিত হয়ে একসময় নিজের কন্যাসন্তানকে অন্যের কাছে বিক্রি করতে হবে অথবা দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে বাঁচতে তার কন্যারা অর্থের বিনিময়ে সম্ভ্রম বিক্রি করবে। অথবা প্রতিপক্ষের শক্তিশালী যোদ্ধারা তার গোত্রকে পরাজিত করে ওই কন্যাসন্তানের সম্ভ্রমহানি করবে। ক্রীতদাসে পরিণত করবে। তাই কন্যাসন্তানের সম্মান ও সম্ভ্রম রক্ষা করতেই তাদের ছোটবেলায় জীবন্ত কবর দিয়ে হত্যা করা হতো।

কিন্তু বর্তমান সময়ের কথিত সভ্য সমাজে জন্মগ্রহণকারী শিশুদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, তাদের পিতা-মাতারা তাদের কল্যাণ চিন্তা করে তাদের হত্যা করে না। বাবা-মায়েরা তাদের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের ফলে জন্ম নেওয়া শিশুকে হত্যা করে সমাজে নিজের সম্মান রক্ষা করতে চায়। তাই প্রায়শই গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয় ডাস্টবিনে শিশুর মৃতদেহ পাওয়া গেছে। অথবা উঁচু ভবন থেকে নিচে ছুড়ে ফেলে হত্যা করা হয়েছে সদ্য জন্ম নেওয়া কোনও হতভাগ্য মানব সন্তানকে। মৃত শিশুর নরম তুল তুলে খণ্ডিত-বিখণ্ডিত দেহ ভবনের নিচের ফুটপাতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এই সভ্য সময়ে  জন্ম নেওয়া শিশুদের তাই কবরের ভাগ্যও জোটে না। ময়লা আর্বজনার ভাগাড়ে তারা মিশে যায় নীরবে। 

সম্প্রতি পাঁচ বছরের এক শিশু হত্যার শিকার হয়েছে সুনামগঞ্জে। সংবাদ পড়তে গিয়ে শিউরে উঠেছি। বাবা, চাচা আর চাচাতো ভাই মিলে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে শিশু তুহিনকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। যেভাবে কান ও লিঙ্গ কেটে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তা জাহেলিয়া যুগকেও হার মানিয়েছে। জাহেলিয়া যুগের কোনও আরব বাবা তার সন্তানকে এমন বর্বরভাবে হত্যার চিন্তা করেছেন কি? 

জাহেলিয়া যুগের সব বাবাই কায়েস বিন আসেমের মতো তার কন্যাকে হত্যা করতো এমন নয়। সাধারণত দুর্বল গোত্রের এবং দারিদ্র্যপীড়িত বাবারাই তার কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দিতো।  তুহিনকে অথবা ওই রকম অন্যায়ভাবে হত্যার শিকার মানুষদের রক্ষায় এখন আর কেউ এগিয়ে আসে না। কিন্তু জাহেলিয়া যুগে জায়েদ ইবনুল নুফায়েলের মতো অনেক উদার ও মহান ব্যক্তি ছিলেন, যারা কন্যাশিশুদের জীবন্ত কবর দেওয়া থেকে রক্ষা করতেন। সহি বুখারি শরিফ হাদিসে উল্লেখ আছে, যখন কোনও বাবা তার কন্যাশিশুকে জীবন্ত কবর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেন, আর সেই কথা জায়েদের কানে পৌঁছাতো, তিনি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসে ওই বাবার কাছ থেকে তার কন্যাকে নিজের জিম্মায় নিতেন। তিনি বলতেন, হত্যা করো না তোমার কন্যাকে জীবিকার ভয়ে, আমি তার ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব নিচ্ছি। বড় হলে ওই সব কন্যাকে তিনি তার বাবার কাছে ফেরত দিতেন। আর কোনও বাবা তার কন্যাকে ফেরত না নিতে চাইলে জায়েদ আমৃত্যু ওই কন্যার বাবার দায়িত্ব পালন করতেন। বর্তমান সমাজে জায়েদের মতো মানুষের বড় অভাব! আজকের মানুষরা নিজের স্বার্থ নিয়ে সদাব্যস্ত। যেন তারা হাশরের ময়দানে আছে। অদৃশ্য কোনও ভয়ে অথবা বেহশত দোজখের চিন্তায় ‘ইয়া নফসি’, ‘ইয়া নফসি’ করতে সদাব্যস্ত। অন্য কারও দিকে ফিরে তাকানোর ফুসরত নেই তাদের। ন্যায়-অন্যায়ের বাছ-বিচারের বোধশক্তি লোপ পেয়েছে অধিকাংশ মানুষের। তাই দীর্ঘ ছয়ঘণ্টা ধরে নির্যাতন করে বুয়েটের হলে আবরারকে হত্যা করা হলেও কেউ তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি কোনও এক অদৃশ্য কারণে।

অবশ্যই এখনকার সভ্য সমাজের কথিত সভ্য-শিক্ষিত মানুষেরা অন্যায় কাজ করার জন্য সিন্ডিকেট করেন। বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার হত্যাকাণ্ড তার সাম্প্রতিক প্রমাণ। আবরারকে এক-দুই জন নয়, বিশ জন সভ্য-শিক্ষিত-মেধাবী জানোয়ার মিলে হত্যা করেছে। সংখ্যার বিচারে বিশ জন মানুষ অনেক। ভাবা যায়, বিশ জন মানুষের একত্রে বিনা অপরাধে অন্য একজন মানুষকে হত্যা করা অন্যায় মনে হয়নি। কোনও সমাজে বাস করছি আমরা? 

সবচেয়ে খারাপ লেগেছে হত্যাকারীদের হত্যার পর অপরাধবোধ না দেখে। টেলিভিশনে তাদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার ছবি দেখছিলাম। চেহারায় অপরোধবোধের কোনও ছাপ নেই। অন্যায় কাজের চেয়ে অন্যায়কারীর অন্যায়বোধ না থাকাটা ভয়ঙ্কর। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা সেই বোধহীন সমাজে বাস করছি। আবরার হত্যাকাণ্ডের অপরাধীদের দেখে তা-ই মনে হয়েছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখলাম, আবরারের হত্যাকারীরা আবরারকে নির্যাতন করার পুরো সময়টা তার মুখ চেপে ধরেছিল, যেন তার কান্নার আওয়াজ কেউ শুনতে না পায়। শিশু তুহিনের হত্যাকারী তার বাবা-চাচাও হয়তো একই কাজ করেছে নীরবে-নিভৃতে তাদের অপকর্ম সারতে। জাহেলিয়া যুগের জীবন্ত কবরপ্রাপ্ত কন্যারা কান্নার অধিকার পেতো। কায়েস বিন আসেমের বিবরণ থেকে তা আমরা আগেই জেনেছি। কিন্তু আজকের হত্যাকারীরা সেই অধিকারটুকুও কেড়ে নিয়েছে। আবরার ও তুহিনের মৃত্যুর সময় কান্নার অধিকারটুকুও দেওয়া হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যুর মিছিল দেখে এ দেশের মানুষ একসময় রাজপথে নেমেছিল নিরাপদ মৃত্যুর অধিকার চেয়ে। এখন অনিরাপদ মৃত্যু এ দেশে ডালভাত। তাই ‘ইয়া নফসি’র এই যুগে নিরাপদ মৃত্যুর অধিকার এখন দেবতুল্য ব্যাপার। একের পর এক অনিরাপদ মৃত্যুর মিছিল দেখে মনে হচ্ছে, নিরাপদ মৃত্যুর অধিকার প্রতিষ্ঠার আগে হয়তো মৃত্যুর সময় অন্তত কান্না করতে পারি, সেই অধিকারের আওয়াজ তুলতে হবে। ধর্মের নামে, আদর্শের নামে, রাজনীতির নামে, অর্থের লোভে যে সমাজে মানুষ মানুষকে তুচ্ছ কারণে নৃশংসভাবে হত্যা করছে, সেই সমাজের কাছে আমাদের কান্নার অধিকার চাওয়া ছাড়া আর কী-ই বা চাওয়ার থাকতে পারে!

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

 

 

/এমএনএইচ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কারিগরির সনদ জালিয়াতি: সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ডিবি কার্যালয়ে
কারিগরির সনদ জালিয়াতি: সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ডিবি কার্যালয়ে
পরোয়ানা জারির ৬ বছর পর উপজেলা চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার
পরোয়ানা জারির ৬ বছর পর উপজেলা চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার
পি কে হালদারের সহযোগী সুকুমার-অনিন্দিতার জামিন চেয়ে আবেদন
পি কে হালদারের সহযোগী সুকুমার-অনিন্দিতার জামিন চেয়ে আবেদন
বিএনপির ৭ আইনজীবীর আদালত অবমাননার বিষয়ে আদেশ বুধবার
বিএনপির ৭ আইনজীবীর আদালত অবমাননার বিষয়ে আদেশ বুধবার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ