X
সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫
২৩ আষাঢ় ১৪৩২

নুসরাত হত্যার রায় একটি ‘ভয়ঙ্কর’ দৃষ্টান্ত

ডা. জাহেদ উর রহমান
৩০ অক্টোবর ২০১৯, ১৭:৫৪আপডেট : ৩০ অক্টোবর ২০১৯, ১৭:৫৮

ডা. জাহেদ উর রহমান পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে গত ২৫ অক্টোবর একটি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে বগুড়ায়। কোনও মানুষকে যে এভাবে হত্যা করা যায়, সেটি এই দেশের মানুষ জেনেছিল ২০১৫ সালে। ওই বছরের জুলাই মাসে সামিউল আলম রাজন নামের একটি শিশুকে পিটিয়ে মেরে ফেলার ভিডিও দেখে বিপর্যস্ত আমরা যখন সামান্য ধাতস্থ হতে শুরু করেছিলাম, ঠিক তার পরের মাসেই রাকিব নামের একটি শিশুর পায়ুপথ বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়।  
সিলেটে ১৩ বছরের রাজনকে পিটিয়ে হত্যার জন্যে চারজনের মৃত্যুদণ্ড আর খুলনায় ১৩ বছরের রাকিব হাওলাদারকে হত্যার দায়ে দু’জনকে ফাঁসির দণ্ড দেওয়া হয়েছিল।‌ এই দু’টো মামলার বিচারের জন্যে আদালতের সময় লেগেছে মাত্র তিন চার মাস, যথাক্রমে ১৯ ও ১১টি কার্যদিবস।
এত দ্রুত বিচার আসলেই কি সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে? পায়ুপথে কম্প্রেসড বাতাস ঢুকিয়ে রাকিবকে হত্যার পর সাম্প্রতিকতম ঘটনার আগে একই পন্থায় আরও অন্তত পাঁচটি হত্যাকাণ্ডের কথা আমি নিজে পত্রিকায় পড়েছি। ‘দৃষ্টান্তমূলক’ শাস্তি আসলেই কি অপরাধ কমায়? ‘দৃষ্টান্তমূলক’ শাস্তিতে যদি কাজই হবে, তাহলে রাকিব হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কেন সে অপরাধ কমালো না?

নুসরাত রাফি হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার নিয়ে আমাদের অনেকেই ভীষণ উচ্ছ্বসিত। তারা বলছেন, এই বিচার একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে, যেটি ভবিষ্যতে এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে কাজ করবে। দুঃখিত আমি এই ব্যাপারে মোটেও আশাবাদী নই। তবে আমি এই বিচারের রায়কে একটা দৃষ্টান্ত বলে সত্যিই মনে করি, তবে সেটা একটা ‘ভয়ঙ্কর’ দৃষ্টান্ত। আমার এই ধরনের মন্তব্যের পেছনে কারণগুলো দেখে নেওয়া যাক।

১. যে কেউ গুগলে ‘গায়ে আগুন দিয়ে/পুড়িয়ে হত্যা’ সার্চ করলে এই রকম বহু ঘটনার সন্ধান পাবেন। মামলা করার পর মামলা তুলে নেওয়ার জন্য আসামিদের চাপ অগ্রাহ্য করে হত্যার শিকার হয়েছে, এমন ঘটনাও আমাদের দেশের অনেক, খুঁজে যে কেউ দেখে নিতে পারেন। সেগুলোর ক্ষেত্রে আমাদের বিচার ব্যবস্থা নুসরাতের মতো করিৎকর্মা হয়ে ওঠেনি। কারণ ওই ঘটনাগুলো এই ঘটনাটির মতো ভাইরাল হয়ে ওঠেনি। এটা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ব্যাপার, এই দেশে কোনও কিছু এখন সামাজিক মাধ্যমে প্রচণ্ড আলোচিত বা ভাইরাল না হলে সেটার ব্যাপারে আমাদের দেশের বিচারিক ব্যবস্থা একেবারেই অকার্যকর। ভয়ঙ্কর এক দৃষ্টান্ত।

২. ভাইরাল হলেও কি এই দেশে ন্যায়বিচার হয়? এই যে সবার চোখের সামনে কুপিয়ে বিশ্বজিৎকে খুন করে ফেলা হলো, ভীষণ ভাইরাল সেই ঘটনার কি বিচার হলো? চূড়ান্ত রায়ে প্রায় সব অভিযুক্ত মৃত্যুদণ্ড থেকে মুক্তি পেয়েছে, আবার অনেকেই খালাস পেয়েছে। নারায়ণগঞ্জের ত্বকী হত্যাও তো ভীষণ ভাইরাল হয়েছিল, কিন্তু বিচার কি হয়েছে?

নুসরাত হত্যার রায় যেদিন ঘোষণা করা হয়েছে, সেদিনই খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পত্রিকার খবর করেছিল ‘মিতু হত্যার তদন্ত তিন বছরেও শেষ হয়নি’। মিতু হত্যা ভাইরাল হয়েছিল। আরেক ভীষণ চাঞ্চল্যকর হত্যা তনু হত্যার কি বিচার হয়েছে? ন্যূনতম তদন্ত কি শেষ হয়েছে? আর সাগর-রুনিকে তো আমরা ভুলেই গেছি। এই তালিকা অনেক দীর্ঘ করা যায়, বাড়াচ্ছি না আর।

আমাদের অভিজ্ঞতা বলে হত্যার বিচারের ক্ষেত্রে ভাইরাল হওয়ার সঙ্গে আরও কিছু ভ্যারিয়েবল খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ওপরের উদাহরণগুলো থেকে আমরা জানলাম ভাইরাল হওয়া ঘটনার সঙ্গেও যদি রাজনৈতিক কিংবা প্রশাসনিকভাবে ক্ষমতাধর কেউ জড়িত থাকে তাহলেও বিচার এই দেশে হয় না। নুসরাত হত্যা এই বাজে দৃষ্টান্তটি স্থাপন করলো আমাদের সামনে।

৩. নুসরাত হত্যায় স্থানীয় থানার ভীষণ রকম দায় আছে। থানা বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিলে নুসরাতের হত্যা প্রতিরোধ করা যেতো। এছাড়া, একজন পুলিশ অফিসার নুসরাতের বক্তব্য রেকর্ড করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়েছেন। পুলিশের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থার বাইরে আর কোনও ব্যবস্থা আমরা দেখলাম না। এর আগেও ঢাকায় একের পর এক ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি যখন ধরা পড়লো তখনও ‘আই-ওয়াশ’ এর জন্য হলেও কিছু রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, কিন্তু যাদের প্রত্যক্ষ ছত্রচ্ছায়ায় এইসব কাণ্ড দিনের-পর-দিন ঘটতে পেরেছে, যার হয়েছে এই সব অবৈধ কাজের মোটা হিস্যা, সেই প্রশাসন এবং পুলিশের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই রায়ে এই দৃষ্টান্ত আবার স্থাপিত হলো– ‘অনির্বাচিত’ সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যাচ্ছেতাইভাবে প্রশাসন এবং পুলিশকে ব্যবহার করার কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনও আইনি ব্যবস্থা নিতে ভয় পায়।

৪. নুসরাত হত্যার প্রাথমিক রায়ের পর আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘নুসরাত হত্যা মামলার আসামিদের ডেথ রেফারেন্স দ্রুত শুনানির নির্দেশ দেওয়া হবে’। ডেথ রেফারেন্সের শুনানি হয় দেশের সর্বোচ্চ আদালতে। আমরা কাগজে-কলমে অন্তত জানি যে, উচ্চ আদালত স্বাধীনভাবে কাজ করেন। তাহলে আইনমন্ত্রী কীভাবে বলেন, এই শুনানি তিনি দ্রুত করতে? তার বক্তব্যে তিনি বলেছেন অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসকে ডেথ রেফারেন্সের শুনানি দ্রুত করতে বলবেন। এই শুনানি কখন হবে, সেটা নির্ধারণের এখতিয়ার কি অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের, না সর্বোচ্চ আদালতের? আইনমন্ত্রীর বক্তব্যে সর্বোচ্চ আদালতের স্বাধীনতার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলে মনে করি।

ধরে নিলাম নুসরাত হত্যায় যে ১৬ জনের মৃত্যুদণ্ডের প্রাথমিক রায় হয়েছে, সেই রায় দেশের সর্বোচ্চ আদালতেও বহাল থাকলো, সব আইনি পদক্ষেপ শেষ হয়ে দ্রুত ১৬ জনের মৃত্যুদণ্ড একই দিনে কার্যকর হলো, তাতে কি দেশে এই ধরনের অপরাধ কমবে? দুঃখিত আমি সেটা কোনোভাবেই মনে করি না।

ট্রাফিক আইন ভাঙার মতো ছোটখাটো কিছু অপরাধ বাদ দিয়ে শাস্তি আদতে অপরাধ কমানোর  ক্ষেত্রে কোনও ভূমিকা রাখে কি না, অপরাধ বিজ্ঞানে সেটা খুবই সিরিয়াস বিতর্কের বিষয়। কিন্তু এই আলোচনার খাতিরে ধরে নেওয়া যাক, এটা প্রভাব রাখে। একটা অতি আলোচিত হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার করে রায় কার্যকর করে কোনোভাবেই দৃষ্টান্ত হতে পারে না। বরং সেটা  উল্লিখিত কারণগুলোর কারণেই একটা ভয়ঙ্কর খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। সমাজে যদি আমরা অপরাধ রোধকল্পে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাই, তাহলে সেটা হতে হবে যেকোনও অপরাধের নিয়মতান্ত্রিক, সুষ্ঠু ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার মাধ্যমে।

রাজন হত্যার বিচার নিয়ে যখন চারদিকে খুব তোড়জোড় পড়ে গিয়েছিল, তখন রাজনের মতোই বীভৎস পিটুনি খেয়ে মারা যাওয়া এক শিশুর বাবা দেশের প্রথম সারির এক দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিককে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমার পোলার তো ভিডিও নাই, আমরা কি হ্যার খুনের বিচার পামু?’ যতোদিন সাধারণ মানুষের মনের গভীরের এমন আক্ষেপ দূর করার মতো ব্যবস্থা আমরা নিশ্চিত করতে না পারবো, ততোদিন নুসরাত হত্যা বা এমন দু’একটি হত্যার দ্রুত বিচার করার মাধ্যমে তথাকথিত দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আসলে কোনও লাভ নেই। এতে বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে  ক্ষমতাসীনরা সাধারণ মানুষের আইওয়াশের সুযোগ নেয় মাত্র।

আর এর মাধ্যমে  স্বল্প মেয়াদে বাহবা পাওয়া বা নির্বাচনে জয়ী হওয়া যেতে পারে, একটা সত্যিকার মানবিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন তার তুলনায় অকল্পনীয় বড় সাধনার কাজ।

লেখক: শিক্ষক, অ্যাকটিভিস্ট

 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (৭ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (৭ জুলাই, ২০২৫)
মধ্যরাতে সংবর্ধনায় বিশ্বকাপ স্বপ্নের কথা বললেন ঋতুপর্ণা ও আফঈদারা 
মধ্যরাতে সংবর্ধনায় বিশ্বকাপ স্বপ্নের কথা বললেন ঋতুপর্ণা ও আফঈদারা 
গণভবন জয় করেছি, এবার জাতীয় সংসদ জয় করবো: নাহিদ ইসলাম
গণভবন জয় করেছি, এবার জাতীয় সংসদ জয় করবো: নাহিদ ইসলাম
একটি দলের কারণে ঐকমত্য কমিশনে মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবনা আটকে যাচ্ছে: আখতার
একটি দলের কারণে ঐকমত্য কমিশনে মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবনা আটকে যাচ্ছে: আখতার
সর্বশেষসর্বাধিক