X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা সংকটে ব্যক্তিজীবনের চালচিত্র

সাদিক হাসান
০২ মে ২০২০, ১৪:২৫আপডেট : ১২ জুন ২০২০, ১২:৫৮

সাদিক হাসান ঘরবন্দি জীবন কাটিয়ে যাচ্ছি। এরমধ্যে ‘প্যারোল’ নিয়েছি সর্বসাকুল্যে তিনবার। তিনবারই হয় ওষুধ না হয় সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য। প্রতিবারই ১৫ মিনিট করে সর্বমোট ৪৫ মিনিট। এই জীবনে অন্য অনেকের মতো আমার অবশ্য জানালার শিক, বাথরুমের শাওয়ারের ছিদ্র, ফ্যানের গতিবেগ, এক মুঠ ডালের সংখ্যা ইত্যাদি ইত্যাদি গুণে বা মেপে সময় পার করতে হয়নি। যেদিন থেকে ঘরবন্দি, সেদিন থেকে সঙ্গীর ঠান্ডাজনিত কারণে তাকে নিয়েই ব্যস্ত সময় কেটেছে। আর এই ব্যস্ততার একটা বড় সময় কেটেছে করোনা আতঙ্কে। ঠান্ডার উপসর্গ আর করোনার উপসর্গ প্রায় কাছাকাছি হওয়ায় একটা ঠান্ডা আতঙ্ক পুরোটা সময় চেপে ধরে ছিল। দীর্ঘ ২১ দিন পর এই ক’দিন আগে তিনি পরিপূর্ণ সুস্থ।

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যে কোর্সটা পড়াই সেটার আর তিনটা ক্লাস বাকি ছিল। সেগুলো নেওয়ার আগেই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলো আর তারও আগে শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে বাসায় চলে গেলো। সব কাজই করি, শুধু ক্লাস নেওয়া ছাড়া। এরমধ্যে ফেসবুকে দু’একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীদের পোস্ট থেকে জানলাম তারা অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন। ভেবে দেখলাম সেই ১৯৯৭ থেকে অনলাইন জীবনযাপন করি। প্রথম কম্পিউটার স্পর্শ করি এবং শিখি ১৯৮৮ সালে যখন এর নাম বাংলাদেশে অনেকেই শোনেনি। ২০১২ থেকে ফেসবুককে ব্যবহার করি ক্লাস নেওয়ার সহায়ক হিসেবে। এর বড় সুবিধা এই, ডিজিটাল বাংলাদেশের কারণে সবার হাতে হাতে সেল ফোন এবং সবারই অন্তত একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। ২০১২ সাল থেকে যতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে যত ব্যাচকে পড়িয়েছি, তাদের সবার জন্য একটা করে ফেসবুক গ্রুপ তৈরি করা আছে। সেই গ্রুপে কোর্স সংক্রান্ত সব রিসোর্স, নোটিশ এবং ক্লাস উপস্থিতি ও কুইজের নম্বর শেয়ার করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা অনেকক্ষেত্রে এই গ্রুপে অনলাইন অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা তাদের বিভিন্ন জিজ্ঞাসাও এখানে পোস্ট করেছেন এবং উত্তর পেয়েছেন। এতে যোগাযোগ রক্ষা করাটা সবচেয়ে সহজ হয়েছে। কাউকে কোর্স সংক্রান্ত কোনও কিছু পেতে ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য বা অন্য কারও সময় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি। আমারও সুবিধা হয়েছে এই যে কেউ কখনও বলতে পারিনি যে জানি না। অ্যাডমিন হিসেবে আমি তো জানিই যে কে দেখেছে আর কে দেখেনি। আর সবচেয়ে বড় সুবিধাটা পাচ্ছি এখন—এই গ্রুপগুলো আমাদের মধ্যকার যোগাযোগটা এখনও রক্ষা করছে।

কিন্তু এই আকস্মিক বন্ধ অন্য সবকিছুর মতো প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়াকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। তাই ব্যক্তি উদ্যোগে ডিজিটাল লেখাপড়ার পরের ধাপে যাওয়ার চেষ্টাটা করলাম। ফেসবুকের গ্রুপে বর্তমান ব্যাচের (৪৮তম ব্যাচ, লোক প্রশাসন বিভাগ) শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ব্যাপারটা শেয়ার করতেই ব্যাপক সাড়া। অবশেষে গত মাসের শেষে জুম ব্যবহার করে প্রথম আমরা একসঙ্গে হলাম। ১১৪ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৯৫ জন যোগ দেন।

প্রথমে অবশ্য পরিকল্পনা ছিল গুগল ক্লাসরুম ব্যবহার করার। সেইজন্য গুগল ক্লাসরুমে একটা গ্রুপও তৈরি করেছিলাম। কিন্তু ক্লাস নিতে গিয়ে দেখলাম ক্লাসরুমের সঙ্গে গুগল মিট ব্যবহার করা যাচ্ছে না। সেটার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জি-স্যুইট ব্যবহার করার অনুমতি লাগে। শেষ পর্যন্ত জুম ব্যবহার করেই পরীক্ষামূলক অনলাইন ক্লাস নেওয়া। জুমের একটাই সীমাবদ্ধতা—ক্লাস বা মিটিং সময় ৪০ মিনিট। এরপর আবার অপেক্ষা করতে হয় নতুন করে সিডিউল দিয়ে আবার ক্লাস বা মিটিং করা। সেদিন আমরা অবশ্য অপেক্ষা করেই দু’দফায় প্রায় ৮০ মিনিট ক্লাস নিতে পেরেছি।

তবে ক্লাস নিতে গিয়ে কয়েকটা জিনিস চোখে পড়লো। প্রথমত অনেকে গ্রাম থেকে যোগ দিয়েছেন। কোনও কোনও গ্রামে সংযোগ অনেক ধীর। তাদের সংযোগ পেতে বেশ সময় নিয়েছে। দ্বিতীয়ত যদি কেউ মাঝপথে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তারও ফের সংযোগ পাওয়াটা বেশ সময়ের ব্যাপার। তৃতীয়ত একসঙ্গে এক-দেড় ঘণ্টা ভিডিও কনফারেন্সিংয়ে যে পরিমাণ ডাটা লাগে তার খরচ তো অনেক। সেই বাড়তি খরচটা অনেক শিক্ষার্থীর জন্য একটা বড় চাপ। কেননা, গ্রাম থেকে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী মোবাইল ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগ দেন। বাংলাদেশ সরকার স্বল্পমূল্যে জনগণের জন্য ইন্টারনেট সুবিধা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে গত কয়েক বছরে ১ এমবিপিএস ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের দাম ২৭ হাজার টাকা থেকে ১৮০ টাকায় নামিয়ে নিয়ে এলেও এর তেমন কোনও সুবিধা ভোক্তাপর্যায়ে পাওয়া যায়নি। টেলকো কোম্পানিগুলো এখনও প্রবল প্রতাপে তাদের নিজেদের মতো করে ব্যবসা করে চলছে।

সে কারণে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করা হলো যে—ক) পরের ক্লাসের আগে ফেসবুক গ্রুপে স্লাইডটা দেওয়া হবে; খ) গুগল ক্লাসরুমে একটা অডিও লেকচার আপলোড করা হবে; এবং গ) এরমধ্যে শিক্ষার্থীরা স্লাইড পড়ে আর লেকচার শুনে রেডি হয়ে থাকবে। তারপর এই ফেসবুক গ্রুপের লাইভ অপশন ব্যবহার করে অনলাইনে এসে যার যা সমস্যা আছে সেগুলো নিয়ে আলোচনা হবে। তবে যাদের ইন্টারনেট ব্যবহার করতে সমস্যা, তাদের এই অনলাইন আলোচনায় যোগ না দিয়ে গ্রুপে প্রশ্ন করতে বলা হয়। সেভাবে গত সপ্তাহে আমরা ফেসবুক লাইভ ব্যবহার করে আবার একসঙ্গে হয়েছিলাম।

তবে নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা হচ্ছে তারা গুগল ক্লাসরুম আর গুগল মিট ব্যবহার করেই ক্লাসের ব্যবস্থা করেছে। সেটার আপাতদৃষ্টিতে কোনও সীমাবদ্ধতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে গুগল ক্লাসরুম আর মিট ব্যবহারকারী সবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ডোমেইনের ইমেইল ঠিকানা লাগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের সবার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ডোমেইনের ইমেইল ঠিকানা আছে। শুধু শিক্ষার্থীদের এই ইমেইল ঠিকানা থাকলেই আর কর্তৃপক্ষ জি-স্যুইট ব্যবহার করার অনুমতি, যেটা কিনা আবার বিনামূল্যে পাওয়া যায়, পেলেই অনলাইনে এই বন্ধটা কাজে লাগানো যেতো। শুনতে পেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে। আমার অভিজ্ঞতা থেকে শুধু এটুকু বলতে পারি, যতদূর সম্ভব বিভিন্ন অপশন ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে এই অনলাইন ক্লাসটা নেওয়া যেতে পারে যাতে, এই নতুন সুযোগটা শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন একটা চাপ বা বিড়ম্বনার কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য দরকার হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন টেলকো কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলতে পারে অথবা সরকারের আইসিটি ডিভিশন, এটুআই এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহায়তাও নিতে পারে।

এই অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি অবশ্য সব বিল মেটাতে হয়েছে। সেখানেও বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাপ আর ইন্টারনেট-বেজড ব্যাংকিং ব্যবস্থা জীবন করেছে সহজ। বিলের পাশাপাশি আমাদের কাছে শিক্ষার্থীদের আবদারও তো কম না। বিভিন্ন জায়গায় সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে সহায়তা করার জন্য ওদের সহায়তা দরকার, আর কে না জানে নিঃসংকোচে নিজের শিক্ষকদের কাছেই সেটা চাওয়া যায়। বিভাগও এগিয়ে এসেছে এই সময়ে আর্থিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি শিক্ষার্থীদের সহায়তায়। সেই আবদারটুকু পূরণ আর সহায়তা করার সুযোগ করে দিয়েছে অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থা। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংক যে অ্যাপ তৈরি করেছে, সেটাতে বহুবারের চেষ্টায় রেজিস্ট্রেশন করতে পারলেও এখন পর্যন্ত লগ-ইন করতে পারিনি।

আর আরেকটা ব্যাপার তো উল্লেখ না করলেই নয়। আমার স্ত্রী যখন অসুস্থ ছিলেন তখন ডাক্তারের সঙ্গে কয়েকবার কনসালটেশন হয়েছে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে। আর ইন্টারনেট ব্যবহার করে গ্রোসারি শপিং আর ওষুধ কেনা তো অনেকটাই ডাল-ভাত এই করোনা বন্দি জীবনে। শুধু কী তাই? আমাদের বন্দি জীবনে একটা খোলা জানালার মতো আছে সোস্যাল মিডিয়া—ফেসবুক। সেখানে কীই না করছি আমরা?

বাসায় থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে এই তো ক’দিন আগে আমার তিন প্রাক্তন শিক্ষার্থী আমাকে তাদের ভিডিও আড্ডায় আমন্ত্রণ জানান। চারজন আমরা বাংলাদেশের চার জায়গা থেকে আড্ডা দিই অনেকক্ষণ। জানলাম তারা সবাই হোম অফিস করছেন এবং আমার মতোই ইন্টারনেটের সহায়তায় জীবনযাপন করছেন।

শুধু ব্যক্তিপর্যায়ে এই যে এত এত কাজের কথা বললাম, তার কোনোটাই বাসায় বসে করা হতো না যদি না বাংলাদেশে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নামের ধারণাটা বাস্তবায়িত হতো। শুধু কী ব্যক্তিপর্যায়? এই ডিজিটাল বাংলাদেশ সব খাতের ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই লকডাউনের সময়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে কাজগুলো হচ্ছেই তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে। কয়েকদিন পর পর প্রধানমন্ত্রী দেশের বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলছেন, খোঁজ নিচ্ছেন এবং দিক-নির্দেশনা দিচ্ছেন ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে।

অথচ ২০০৯ সালে নির্বাচনি প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে ডিজিটাল বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হলে এটা নিয়ে কম জল ঘোলা হয়নি। একটা সময় তো এই শব্দজোড়া ব্যবহৃত হতো বিদ্রূপ বা টিটকারি অর্থে। গত ১২ বছরে এটার ওপর কম গবেষণা প্রবন্ধও লেখা হয়নি। যেখানে চুলচেরা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে এই ডিজিটাল বাংলাদেশের উদ্দেশ্য, প্রত্যাশা আর ব্যর্থতা। আমি নিজেও কম লিখিনি। প্রায় ২২ বছর ধরে ই-গভর্ন্যান্স এবং এই ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণাকে অনুসরণ করে আজ আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি—এই করোনা সংকট আমাদের যে কয়টা খাতকে চ্যালেঞ্জ করেছে, তারমধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণাটাই ধাক্কাটা মোটামুটিভাবে সামাল দিতে পেরেছে। যদিও যেতে হবে বহুদূর, করতে হবে অনেক কিছু, তারপরও প্রমাণ করেছে, অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ একটা বাস্তবতা।

একদম সাধারণ মানুষের কথা না হয় বাদই দিই, সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন বিষয়ে তর্কে পটু আমাদের শিক্ষিত করপোরেট সমাজ অন্তত এই বাস্তবতাটা অন্যের কাছে না হোক নিশ্চিতভাবে নিজের কাছে নিজে স্বীকার করবেন।

পরম করুণাময় আমাদের সবাইকে সুস্থ রাখুন, নিরাপদে রাখুন।

লেখক: শিক্ষক, লোক প্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ