X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

শফিক রেহমানকে গ্রেফতার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার ধুয়া

মাসুদা ভাট্টি
১৯ এপ্রিল ২০১৬, ১০:০৯আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০১৬, ১১:৩৫

মাসুদা ভাট্টি শফিক রেহমান একজন সাংবাদিক, সম্পাদক এবং উপস্থাপক। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে তার সকল পরিচয় ছাপিয়ে গিয়ে তিনি আসলে পরিচিত হয়েছেন একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে, বা বলা ভালো একজন রাজনৈতিক নেতার উপদেষ্টা হিসেবে। শফিক রেহমান নিজেই এই পরিচয়টি মেনে নিয়েছেন এবং কখনও তা নিয়ে কোনও প্রতিবাদ তিনি কোথাও করেছেন বলে জানা যায় না। কিন্তু সে কারণেই তাকে ক্ষমতাসীন সরকার গ্রেফতার করতে পারে কি? নাকি করা উচিত? আমরা এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবো এই লেখাতে।
শফিক রেহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে তার বাসভবন থেকে। এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে বিভিন্ন মত ও পথের মানুষজন তাদের নিজস্ব অবস্থান থেকে বক্তব্য রাখছেন। সোস্যাল মিডিয়া পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, শফিক রেহমানকে গ্রেফতারের পক্ষে এবং বিপক্ষে জোরালো মন্তব্য রেখে যাচ্ছেন অনেকে। এর মধ্যে গণজাগরণ মঞ্চের নেতা ডা. ইমরান এইচ সরকার যে মন্তব্যটি করেছেন এবং তার জবাবে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় যে কথা বলেছেন, তা নিয়েই আলোচনা-সমালোচনা চলছে সবচেয়ে বেশি। যাহোক, এ হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাভাবিক পরিস্থিতি, যে কোনও বিষয় নিয়েই আমরা কথা বলতে পছন্দ করি এবং এই কথা বলা কখনও কখনও শালীনতার সীমা অতিক্রম করে, কখনও বা ’কথা’ নিয়ে শুরু হয় বিবিধ রাজনীতি। এই প্রবণতা ভালো কি খারাপ সে প্রশ্নে না গিয়ে বলাই যায় যে, বাঙালি জাতিকে হয়তো এ কারণেই অন্যতম রাজনীতি সচেতন (?) বা রাজনীতি-প্রবণ জাতি বলা হয়ে থাকে।
প্রথমেই আসা যাক শফিক রেহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে সে প্রসঙ্গে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন যে, শফিক রেহমানকে গ্রেফতারের সময় ডিবি পুলিশ সাংবাদিক পরিচয়ে তার বাসায় প্রবেশ করেছিল কেন? এই প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয়ই ডিবি পুলিশ দেবে কিন্তু তাতে কি তার গ্রেফতারের বিষয়টি হাল্কা হয়ে যায়? না, যায় না। তিনি দেশের সম্মানিত নাগরিক, একটি রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাস করেন এবং তার সেই বিশ্বাসের কারণে যদিও বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা অনেকটাই এখন সঙ্কুচিত হয়েছে। সেটা কী করে?

আমরা জানি যে, গণজাগরণ মঞ্চের সেই সাড়াজাগানো দিনগুলিতে শফিক রেহমান এবং তার আরও সম্পাদক বন্ধুগণ মিলে শাহবাগে সমবেত তরুণ সম্প্রদায়কে নাস্তিক এবং নষ্ট ছেলেমেয়ে অভিধায় অভিযুক্ত করেছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, শাহবাগের সমবেত সেই তরুণদেরকে নাস্তিক আখ্যা দিয়ে ধর্মবাদী হেফাজতকে তাদের ওপর লেলিয়ে দিতেও তারা পিছপা হননি। এই লেলিয়ে দেওয়ার পরিণাম দেশে কী হয়েছিল, সেটা আমরা সকলেই কমবেশি জানি। কিন্তু যেহেতু আমরা বিস্মৃতিপরায়ণ এবং একের পর এক ইস্যুতে ভারাক্রান্ত আমাদের স্মৃতি সেহেতু একটু মনে করিয়ে দিই যে, সেই লেলিয়ে দেওয়ার পরিণামে আমরা দেশে একের পর এক ব্লগারদের চাপাতির কোপে নিহত হতে দেখেছি; গোটা বিশ্বে আমরা একটি উগ্র ধর্মাশ্রয়ী জাতি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছি এবং সরকারের পক্ষে চাইলেও এই পরিচিতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভবপর হচ্ছে না, বরং দেশের ভেতরকার ধর্মীয় উগ্রতার পরিবেশকে শান্ত রাখতে প্রধানমন্ত্রীকে পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান যে কারণে গ্রেফতার হয়েছিলেন এবং এখনও কারাগারে রয়েছে, সেই একই কারণে কি শফিক রেহমানও গ্রেফতার হতে পারেন না? দেশের ভেতর ধর্মীয় অস্থিরতা সৃষ্টির কারণে? আজকে আমরা যারা শফিক রেহমানকে গ্রেফতারের কারণে দেশে “বিরোধী মত প্রকাশের স্বাধীনতা”, “রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা” ইত্যাদি অভিযোগে সরকারকে অভিযুক্ত করছি তারা কি মনে করেন, শাহবাগের তরুণদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে তাদের দিকে হেফাজতকে লেলিয়ে দেওয়াটা মত প্রকাশের স্বাধীনতার অংশ ছিল? যদি তাই মনে করেন, তাহলে আসলে বলার কিছু নেই, কিন্তু যদি সেটা না মনে করে থাকেন, তাহলে বলার কিছু কথা আছে; যা একটু পরে বলছি।

যাহোক, শফিক রেহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে অন্য একটি কারণে, তাহলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই-এর গোপন দলিল চুরি করা এবং সেই দলিল অনুযায়ী বাংলাদেশের একজন প্রধান রাজনৈতিক নেতার ছেলেকে অপহরণের চেষ্টা - যা আসলে ফৌজদারী অপরাধ। আমরা ইতোমধ্যেই প্রকাশিত কিছু কিছু সংবাদথেকে জানি যে, এই প্রধান রাজনৈতিক নেতার পুত্র আসলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র এবং তার তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শফিক রেহমানকে গ্রেফতারের পর জানিয়েছে যে, তারা প্রাপ্ত তথ্যে ভিত্তিতে এই অপহরণ-চেষ্টা বা পরিকল্পনার সঙ্গে শফিকরহমানের জড়িত থাকার সন্দেহ করছেন এবং সে জন্যই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের আইনে এরকম গ্রেফতার কি নিষিদ্ধ কি না? আমার আইনবিদ বন্ধুরা নিশ্চয়ই বিষয়টি ভালো বলতে পারবেন তবে দু’একজনের কাছে জিজ্ঞেস করে জেনেছি যে, না, বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে এরকম সন্দেহভাজন কাউকেগ্রেফতারে কোনও আইনী নিষেধাজ্ঞা নেই।

 কিন্তু শফিক রেহমান একজন সাংবাদিক, একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি, একজন রাজনীতিবিদ, একজন সম্পাদক? তার বয়স ৮১ বছর? এসব প্রশ্নকে যদি সামনে রাখি, তাতেও কি তাকে গ্রেফতারে কোনও আইনী বাঁধা আছে? আইনবিদ বন্ধুরা বলেছেন, না নেই। তবে বিচারক চাইলে তাকে এসব কারণে জামিন দিতে পারেন। আমরা সংবাদমাধ্যমথেকেই জেনেছি যে, শফিক রেহমানকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। কিন্তু এদিকে তাকে নিয়ে বাইরে যারা কথা বলছেন, তারা কিন্তু বলছেন যে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক ভিন্নমত সহ্য করা হচ্ছে না, সরকার বিরোধীদের দমনে নেমেছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ, মত প্রকাশের স্বাধীনতার সম্পূর্ণ সুযোগ নিয়েইএইসব মতামত আমরা প্রকাশ করে চলেছি। যেমন ইমরান এইচ সরকার বলেছেন, একটি “বায়বীয়” অভিযোগের ভিত্তিতে ৮১ বছর বয়স্ক শফিক রেহমানকে গ্রেফতার করা আসলে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার বহিঃপ্রকাশ। ইমরান এইচ সরকারের এই “উদার” অবস্থান আমাকে মুগ্ধ করেছে, কারণ যে ব্যক্তি তাকে এবং তার সহযোদ্ধাদের“নাস্তিক” এবং “নষ্ট ছেলে” বলেছিলেন, তার মুক্তির জন্যই তিনি কথা বলছেন, এটা নিঃসন্দেহে ভালো রাজনৈতিক সংস্কৃতি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তিনি কি ভালো রাজনৈতিক সংস্কৃতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই কথাটি বলেছেন কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। কারণ, তাহলে তাকে মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতারেরও প্রতিবাদ করতে হয় এবং একইসঙ্গে তার মুক্তির জন্যও তাকে কর্মসূচি দিতে হবে। তিনি কি সেটা দিতে প্রস্তুত আছেন? যদি না থাকেন, তাহলে শফিক রেহমানকে গ্রেফতার কেন অসহিষ্ণু রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকাশ হবে, সেটা তাকে ব্যাখ্যা করতেই হবে।

অপরদিকে ইমরান এইচ সরকারের বক্তব্য সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সজীব ওয়াজদ জয়-এর মন্তব্য এ কারণেই যৌক্তিক যে, আসলে অপহরণ বা তথ্য চুরির চেষ্টার যে অভিযোগে শফিক রেহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে তার শিকার আসলে তিনি নিজে। তিনি নিজে জানেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে তাকে এ জন্য বিশেষ সতর্কতায়চলাফেরা করতে হয় এবং বাংলাদেশেও তার জীবন আসলে নিরাপদ নয়। ইমরান এইচ সরকার কোনওভাবেই এই আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ঘটনা যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের আদালত কর্তৃক শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে, তাকে “বায়বীয়” আখ্যা দিতে পারেন না। কিন্তু তিনি দিয়েছেন, হয়তো এটা তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার অভাবকিংবা একটি আলোচিত গ্রেফতারের পর মন্তব্য করতেই হবে এমন তাগিদ থেকে করা মন্তব্য। তিনি যদি ভেবেচিন্তে কথা বলতেন তাহলে এই “বায়বীয়” শব্দটি ব্যবহারের আগে একবার ভাবতেন যে, তাকে এবং তার সহযোদ্ধাকে যখন নাস্তিক বা নষ্ট ছেলে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। তখন তাদের আখ্যাদানের ঘটনাকে যদি হাল্কাভাবে দেখারজন্য তাকে “মামুলি মন্তব্য” হিসেবে দেখা হতো, তাহলে বিষয়টি কি তিনি গ্রহণ করতে পারতেন? কিংবা একের পর এক ব্লগার হত্যাকে যদি কেউ “সামান্য ঘটনা” হিসেবে দেখেন (কেউ কেউ যে দেখে না তা নয়) তাহলে তাও কি ইমরান এইচ সরকার মেনে নিতে পারবেন? সে বিচারে ইমরানের মন্তব্যটাই আসলে “বায়বীয়”।

সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ কিংবা তার সম্পর্কে তথ্য চুরির ঘটনার অভিযোগ, বিচার কিংবা বাংলাদেশে এই ঘটনায় জড়িতদের কাউকে গ্রেফতারের ঘটনা কোনওভাবেই “বায়বীয়” হতে পারে না, হওয়া উচিত নয়। কিন্তু ইমরানের এই মন্তব্যের কারণে, তাকে বন্ধু তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার আহ্বান জানানোটাও এক ধরনের হাস্যকরযুক্তি হয়ে যায়, কারণ, কেউ যদি ইমরান এইচ সরকারকে তার বন্ধু তালিকা থেকে বাদ দিতে চান, তাহলে তার কর্মকাণ্ডের বিচারেই বাদ দেবেন, তাই না?

শেষ করি মত প্রকাশের স্বাধীনতা কিংবা রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার বিষয়টি দিয়ে। শফিক রেহমানের গ্রেফতারকে আমরা দেখতে চাই একটি ফৌজদারী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া হিসেবে, কোনওভাবেই এটা মত প্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, নয় রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতাও, বরং শফিক রেহমান যদি সত্যি সত্যিই এই অপরাধেরসঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকেন তাহলে তিনিই বরং তার বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্বকে “এলিমিনেট” করার অভিযোগে দুষ্ট; আর বাংলাদেশে ১৫ই আগস্ট, ২১শে আগস্টের মতো কালো দিনগুলির যে তালিকা আমরা দেখি, যার সঙ্গে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক বিরুদ্ধমতকে থামিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে তারসঙ্গে সম্পর্কটা আওয়ামী লীগের নয়, বেশি শফিক রেহমান যে রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাস করেন, সেই জামায়াত-বিএনপি-গোষ্ঠীর, নয় কি? এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায় ও দায়িত্ব এই অভিযোগ প্রমাণ করা, নাহলে শফিক রেহমানকে সসম্মানে এই দায় থেকে মুক্তি দেওয়া।

লেখক: কলামিস্ট

ইমেইল: [email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
ঢাকায় পুনর্মিলন সেরে ক্যাঙ্গারুর দেশে...
ঢাকায় পুনর্মিলন সেরে ক্যাঙ্গারুর দেশে...
নিষ্পত্তির অপেক্ষায় হেফাজতের ২০৩ মামলা
নিষ্পত্তির অপেক্ষায় হেফাজতের ২০৩ মামলা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ