হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আব্দোল্লাহিয়ান। রবিবারের দুর্ঘটনায় তাদের নিহতের কথা সোমবার নিশ্চিত করেছে ইরানি কর্তৃপক্ষ। মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক স্থানে চলমান সংঘাতের মধ্যে এই দুই ইরানির নিহতের ঘটনাটি নাটকীয় অগ্রগতি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তবে এতে চলমান লড়াইগুলোতে খুব বড় প্রভাব ফেলবে না। কারণ দেশটির পররাষ্ট্রনীতি ও যুদ্ধবিষয়ক সিদ্ধান্তগুলোতে শেষ সিদ্ধান্ত আসে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির কাছ থেকে।
ইউনাইটেড অ্যাগেইনস্ট নিউক্লিয়ার ইরান-এর পলিসি ডিরেক্ট জ্যাসন ব্রডস্কি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ইরানের প্রেসিডেন্ট একজন নীতি বাস্তবায়নকারী, তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী নন। ফলে ইরানের মৌলিক নীতিগুলো আগের মতোই থাকবে।
রেইখমান ইউনিভার্সিটির ওরি গোল্ডবার্গ বলেছেন, সর্বোচ্চ নেতার হয়ে কাজ করতেন রাইসি। ইরানের সবচেয়ে কম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে তিনি জয়ী হয়েছেন।
কিন্তু একই সময়ে ইরানের প্রেসিডেন্টের আকস্মিক মৃত্যু ক্ষমতার কেন্দ্রে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি করেছে। সরকারে শীর্ষ পদে থাকা ব্যক্তিরা হয়তো এর সুযোগ নিতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করতে পারেন।
ইরানের সংবিধানের ১৩১ ধারা অনুসারে, প্রেসিডেন্টের মৃত্যু হলে প্রথম ডেপুটি অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করবেন। এই হিসেবে খামেনির অনুগত প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হবেন। কিন্তু তিনি দায়িত্ব নেওয়ার ৫০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এমন সুযোগের অপেক্ষায় থাকা প্রভাবশালী ইরানি কর্মকর্তাদের কোনও ঘাটতি নাই। তারা ক্ষমতা কাঠামোর আরও ওপরে উঠতে চান। আর রাইসির আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনাটি খোদ খামেনিকেই একটি পরীক্ষার মুখে ফেলে দিয়েছে।
গোল্ডবার্গ বলেছেন, খামেনিকে এই ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে নেতা হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালনে কতটা সক্ষম।
সম্ভাব্য উত্তরসূরি
গুরুত্বপূর্ণ হলো রাইসিকে খামেনির একজন সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তিনি ছিলেন অনেক অভিজ্ঞ, একজন মাওলানা, সাবেক প্রধান বিচারপতি ও একটি বড় প্রতিষ্ঠানের সাবেক প্রধান।
ব্রডস্কি বলছেন, তাকে মাঠ থেকে সরিয়ে দেওয়া বা অক্ষম কিংবা মৃত- যেভাবেই বলা হোক না কেন তা ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য একটি বড় ধাক্কা।
রাইসির কারণে আড়ালে থাকা পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আব্দোল্লাহিয়ানের মৃত্যুও তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে খুব সক্রিয় ছিলেন। সৌদি আরবের সঙ্গে সফলভাবে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের চুক্তিতে ভূমিকা রেখেছেন। প্রতিবেশী পাকিস্তানসহ বিভিন্ন কঠিন সংকট সফলভাবে সামলে নিয়েছেন।
এই প্রাণহানি ইরানের পররাষ্ট্রনীতিতে হয়তো কোনও পরিবর্তন আনবে না। তবে এই অপ্রত্যাশিত ঘটনা মোকাবিলায় ব্যস্ত থাকার ফলে একাধিক স্থানে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই থেকে তাদের মনোযোগ কিছুটা সরে যেতে পারে।
জুইশ ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অব আমেরিকার সিইও মাইকেল মাকোভস্কি বলেছেন, দেশটিকে এখন কিছু মাত্রায় হলেও নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে, মনোযোগ দিতে হবে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে। এ ছাড়া পরবর্তী প্রেসিডেন্টকে নির্বাচন করা লাগবে।
বেশ কয়েকটি ব্যর্থতার পর দেশটির শাসকগোষ্ঠী দুর্বল হিসেবে হাজির হওয়ার ঝুঁকিতেও রয়েছে। বেশ কয়েকমাস ধরে দুর্বলতা চোখে পড়ছে। দেশটিতে ৩ জানুয়ারি ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিদের হামলায় অন্তত ৮৪ জন নিহত হয়েছেন। গত মাসে জয়েশ আল-আদল নামের একটি সুন্নি জঙ্গি গোষ্ঠী ১১ ইরানি পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যা করেছে।
শক্তি প্রদর্শনে মরিয়া ইরান পাকিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। তারা দাবি করেছিল, জয়েশ আল-আদল জঙ্গিদের অবস্থানে হামলা করা হয়েছে। কিন্তু পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তান পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র ও যুদ্ধবিমান পাঠায় ইরানে। ১৯৮০ এর দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর ইরানি মাটিতে এটিই ছিল প্রথম বিমান হামলা। পরে উত্তেজনা নিরসনে রাজি হয় ইরান।
ইসরায়েল সীমান্তে ইরানের গ্রহণযোগ্যতাও চাপে পড়েছে। তবে গাজায় হামাস নেতাদের অবস্থান শনাক্ত বা নিশানা করতে হিমশিম খেলেও সিরিয়ায় ইরানি কর্মকর্তাদের হত্যা করতে নিজের সক্ষমতা ও ইচ্ছার প্রমাণ দিয়েছে ইসরায়েল। এপ্রিলে সিরিয়ায় হামলা চালিয়ে ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর কমান্ডার মোহাম্মদ রেজা জাহেদি ও তার ডেপুটি মোহাম্মদ হাজ রাহিমিকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। ডিসেম্বরে একই বাহিনীর সিনিয়র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রাজি মৌসাভি দামেস্কে একটি সন্দেহভাজন ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন।
এমন পরিস্থিতিতে ইরানকে নিজেদের আঞ্চলিক প্রক্সি বাহিনী ও নাগরিকদের কাছে প্রমাণ করতে হতে হতো যে তারা ইসরায়েলের ক্ষতি সাধন করতে পারে। বিশেষ করে গত বছর ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের আকস্মিক হামলার পর এই চাপ বেড়েছে। কিন্তু সিরিয়ার হামলার ঘটনায় প্রতিশোধ নিতে ইরান যে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল তাতে ইহুদি রাষ্ট্রটির কোনও ক্ষতি হয়নি। বরং নিজেদের প্রতিরক্ষার পক্ষে পশ্চিমা ও কয়েকটি আরব দেশকে পাশে পেয়েছে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো দুই শীর্ষ কর্মকর্তাকে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় হারানোর ফলে দেশটির শাসক গোষ্ঠীকে দুর্বল ও অযোগ্য হিসেবে হাজির করছে। কিন্তু খামেনি যদি ক্ষমতা হস্তান্তর মসৃণ করতে পারেন তাহলে তা কঠিন সময়ে স্থিতিশীলতার পক্ষে একটি পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হবে।
পশ্চিমা নেতাদের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যত্র সন্ত্রাসবাদ ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির অভিযোগ ছিল সদ্য প্রয়াত ইরানি নেতার বিরুদ্ধে। ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধে মস্কোকে দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সহযোগিতা তো ছিলই। এ ছাড়া ১৯৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর হাজারো রাজনৈতিক বন্দির মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দায়িত্বে ছিলেন রাইসি।
রাইসির পরিণতি স্পষ্ট হলেও মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বিতাড়িত করা ও ইসরায়েলের ক্ষতিসাধন করার ইরানি উদ্যোগ চলমান থাকবে, এটি প্রায় নিশ্চিত।
সূত্র: টাইমস অব ইসরায়েল