X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

মোটরসাইকেল স্টাইলে পরিবহন যন্ত্রণা 

রেজানুর রহমান
০৪ নভেম্বর ২০২১, ১৭:৪৬আপডেট : ০৫ নভেম্বর ২০২১, ১০:৩০

রেজানুর রহমান

পড়ন্ত বিকাল। জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে নিকেতনে বাসার উদ্দেশে বের হয়েছি। মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজের ধাক্কায় প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তাটা এখন চেনাই যায় না। দিনের প্রথম ভাগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের মিছিল-মিটিং কিংবা বিক্ষোভ কার্যক্রম লেগেই থাকে। দিনের দ্বিতীয় ভাগ অর্থাৎ বিকালে মিছিল, সভা-সমাবেশ তেমন একটা থাকে না। তবে যানজট কখনোই কমে না। প্রেসক্লাব থেকে বেরিয়ে যানজট ঠেলে বেশ কায়দা করে রাস্তা পার হলাম। নিকেতনে যেতে অটোরিকশা না হয় মোটরসাইকেল অথবা উবারই ভরসা। উবার খুঁজলাম। মিললো না। ধারেকাছে কয়েকটা অটোরিকশা দেখলাম। কিন্তু যানজটের কথা ভেবে অটোরিকশায় ওঠার পরিকল্পনা বাতিল করে ভাড়ায় মোটরসাইকেলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

প্রেসক্লাবের সামনে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি অভিমুখী রাস্তার মুখে বেশ কয়েকটা মোটরসাইকেল দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই সদরঘাটের লঞ্চে যাত্রী টানাটানি করার স্টাইলে একসঙ্গে তিন চালক জিজ্ঞেস করলো– ‘কোথায় যাবেন?’ গন্তব্যের কথা জানালাম। তিন জনের একজন ভাড়া চাইলো ১৬০ টাকা। দুই জন বললো ১৫০ টাকা। ভাবলাম একটু এগোই। নিশ্চয়ই ভাড়া কম হবে।

হেঁটেই শিল্পকলা একাডেমি পর্যন্ত গেলাম। বেশ কয়েকটি অটোরিকশার পাশেই তিনটি মোটরসাইকেল দাঁড়িয়ে আছে। অটোরিকশা ভাড়া চাইলো ২০০ টাকা। আর মোটরসাইকেল ভাড়া চাইলো ১৬০ টাকা। এবার ভাবলাম, আরেকটু এগোই। হেঁটেই হাজির হলাম কাকরাইল মোড়ে। চার-পাঁচটি মোটরসাইকেল দাঁড়িয়ে আছে। একজনকে আমার গন্তব্যের কথা বললাম। চালক ভাড়া হাঁকলো ১৭০ টাকা। আমার অবাক হওয়ার পালা। প্রেসক্লাব থেকে কাকরাইল মোড়; অনেকটা পথ হেঁটে এসেছি। কাজেই এবার তো ভাড়া কম হওয়ার কথা। কিন্তু ঘটছে উল্টোটা। মোটরসাইকেল চালককে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা কি উবারের মতো অ্যাপ ব্যবহার করেন না? আমার কথা শুনে মোটরসাইকেল চালক অনেকটা তুচ্ছতাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললো– ‘অ্যাপে বিশ্বাস নাই।’ তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, তাই বলে ইচ্ছামতো ভাড়া হাঁকবেন? কোনও নিয়মকানুনই মানবেন না? মোটরসাইকেল চালক এবার উদ্ধত ভঙ্গিতে বললো– ‘নিয়ম কোথায় আছে বলেন তো? সিএনজিওয়ালারা কি নিয়ম মানে? উবারওয়ালারা কি নিয়ম মানে? বাসওয়ালারা কি নিয়ম মানে? নিয়ম শুধু আমাদের বেলায়? ভাড়া পোষাইলে যাবেন, না পোষাইলে যাবেন না। এত কিসের কথা?’ মোটরসাইকেল চালকের কথা শুনে রাগ হচ্ছে আমার। ‘রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন’ কথাটা ভেবে অনেক কষ্টে রাগ দমন করলাম। আবারও ভাবলাম, আরেকটু এগোলে নিশ্চয়ই ভাড়া কম হবে।

হেঁটেই গেলাম শান্তিনগর মোড় পর্যন্ত। এবারের অভিজ্ঞতা আরও ভয়াবহ। বেশ কয়েকটা মোটরসাইকেল ভাড়ায় যাবে বলে দাঁড়িয়ে আছে। একজন চালক এগিয়ে এলো। গন্তব্যের কথা জানালাম। সে ভাড়া চাইলো ১৭০ টাকা। হিসাব মিলাতে পারছি না। জাতীয় প্রেসক্লাব অর্থাৎ তোপখানা এলাকা থেকে শান্তিনগর অনেকটা দূরের পথ। প্রেসক্লাবের সামনে থেকে নিকেতন যাওয়ার জন্য মোটরসাইকেলের ভাড়া চেয়েছিল ১৬০ টাকা। প্রেসক্লাব থেকে নিকেতন যেতে হলে মাঝামাঝি জায়গায় শান্তিনগরের অবস্থান। অর্থাৎ অর্ধেকটা পথ কমে গেছে। হিসাব অনুযায়ী ভাড়া অর্ধেক কমে যাওয়ার কথা। ১৬০-এর অর্ধেক ৮০ টাকা ভাড়া হওয়া স্বাভাবিক। বড়জোর ১০০ টাকা হতে পারে। অথচ মাঝপথেই ভাড়া হাঁকা হলো ১৭০ টাকা। হিসাব কোনোভাবেই মেলাতে পারছি না। 

এবার রিকশায় গেলাম মগবাজার পর্যন্ত। ধারণা করেছিলাম, মোটরসাইকেলে মগবাজার মোড় থেকে নিকেতনের ভাড়া কত আর হবে? ১০০ টাকার বেশি তো না। একজন মোটরসাইকেল চালক ভাড়া হাঁকলো ১৫০ টাকা। এবার লজ্জায়, অপমানে নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করলো। মোটরসাইকেল চালককে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা কি কোনও নিয়মই মানবেন না? ইচ্ছামতো ভাড়া হাঁকছেন যে? মোটরসাইকেল চালক আমার কথায় কোনও গুরুত্বই দিলো না। বরং বিরক্ত হয়ে বললো– ‘এত জ্ঞান দেবেন নাতো ভাই। পোষাইলে চলেন, না পোষালে নাই।’ অপমান বোধ হলো। তবুও তর্কে গেলাম না। এজন্য অবশ্য অন্য একজন মোটরসাইকেল চালকের ভূমিকা আছে। একটু দূরে সে মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এগিয়ে এসে বিনীত কণ্ঠে বললো– ‘স্যার কোথায় যাবেন? আমার মোটরসাইকেলে ওঠেন। আপনার পছন্দমতো ভাড়া দিলেই হবে। ওঠেন স্যার। নিশ্চয়ই আপনি আমাকে ঠকাবেন না।’

চালকের নাম মাসুদ। তার কথায় মনটা ভালো হয়ে গেলো। মাসুদের মোটরসাইকেলে উঠলাম। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পড়ালেখার খরচ মেটাতে একবেলা মোটরসাইকেল চালায়। যেতে যেতে সে অনেক কথা বললো। যার সারাংশ করলে দাঁড়ায় এরকম– দেশের পরিবহন খাতে বিভিন্ন নিয়ম থাকলেও সেসব মেনে চলার ক্ষেত্রে আইনের সঠিক প্রয়োগ হয় না। তাই মালিক, চালকেরা সর্বদাই বেপরোয়া আচরণ করে। আবার তুচ্ছ কারণে মোটরসাইকেল চালকেরা প্রায়ই মামলার গ্যাড়াকলে পড়ে। পুলিশ মামলা দেয়। তাই বিরক্ত হয়ে অনেকে ইচ্ছামতো মোটরসাইকেলের ভাড়া হাঁকে। এ কারণে পরিবহনের নতুন এই খাতে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়েছে।

উবারের পাশাপাশি ভাড়ায় যখন মোটরসাইকেল পথে নামলো তখন আশ্বস্ত হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এবার পথের আইনে যাত্রীরাই গুরুত্ব পাবে। কম সময়ে উবার বেশ জনপ্রিয়তা পায়। ভাড়ার মোটরসাইকেলও যাত্রীদের ভরসার জায়গা তৈরি করেছিল। অথচ এখন উবার এবং মোটরসাইকেল দুটোই যাত্রীদের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

উবার ভাড়া বাড়িয়েছে। আগে কল দেওয়া মাত্রই উবার পাওয়া যেতো। এখন কল দিলে চালক আগে গন্তব্যের কথা জানতে চায়। গন্তব্য পছন্দ না হলে নিজেই বলে দেয় যাবে না। অথচ এটা উবারের নিয়মের মধ্যে পড়ে না। ভাড়ায় মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে অ্যাপ ব্যবহারে সরকারি নির্দেশনা রয়েছে। অথচ কোনো মোটরসাইকেল চালকই অ্যাপ ব্যবহার করে না। প্রতিদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনে প্রকাশ্যেই অ্যাপবিহীন মোটরসাইকেল ভাড়ায় চলাচল করছে।

একথা সত্যি, ভাড়ায় মোটরসাইকেল চলাচল শুরু হওয়ার প্রথম দিকে সাধারণ যাত্রীরা বেশ খুশি হয়েছিল। পাশাপাশি এই উদ্যোগের ফলে সারাদেশে হাজার হাজার বেকার তরুণের আয়-রোজগারের পথও খুলে গেছে। অটোরিকশার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে মোটরসাইকেলের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায় সবার। সেই সুযোগই নিয়েছে একশ্রেণির মোটরসাইকেল চালক। ইচ্ছামতো ভাড়া হাঁকায় তারা, যা পরিবহন নিয়মের মধ্যে পড়ে না। সাম্প্রতিক সময়ে উবার যা করছে তাও নিয়মবহির্ভূত। অথচ দেখার কেউ নাই।

একটি দেশ কতটা সভ্য তা বোঝা যায় সেই দেশের পরিবহন সৌন্দর্য, পরিবহন খাতের নীতি-নৈতিকতা দেখে। আমাদের দেশে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলেও পরিবহন খাত আজও চলছে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে। রাজধানীর রাস্তায় এখনও ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারায় যানবাহন চলাচল করে। দেশে পরিবহন সৌন্দর্য বলতে কিছুই নাই। বরং পরিবহন ক্ষেত্রে শুধুই বিশৃঙ্খলা। এই বিশৃঙ্খলায় প্রতিদিন চ্যাপ্টা হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ। এর কী কোনও প্রতিকার নাই? এই দেশে পরিবহন খাত কি কোনোদিনই সভ্য হবে না? কোনাদিনই নিয়ম মানবে না?

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, আনন্দ আলো সম্পাদক

/এসএএস/জেএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এনসিসি ব্যাংক ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মধ্যে চুক্তি সই
এনসিসি ব্যাংক ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মধ্যে চুক্তি সই
ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট কাল
ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট কাল
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ইইউ দেশগুলোকে ইউক্রেনে ক্ষেপণাস্ত্র-বিধ্বংসী অস্ত্র পাঠাতে হবে: বোরেল
ইইউ দেশগুলোকে ইউক্রেনে ক্ষেপণাস্ত্র-বিধ্বংসী অস্ত্র পাঠাতে হবে: বোরেল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ