X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

জাতীয় সংগীত নিয়ে যে কাণ্ড চলছে

তসলিমা নাসরিন
০৪ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৭:৫১আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৭:৫২

তসলিমা নাসরিন ভারতের সর্বোচ্চ আদালত এখন ভারতীয়দের সাচ্চা দেশপ্রেমিক না বানিয়ে ছাড়ছেন না। দেশের জাতীয় সংগীত আর জাতীয় পতাকাকে সম্মান করার নির্দেশ জারি হয়ে গেছে। এখন থেকে ছবিঘরে শুধু ছবি প্রদর্শন করলেই চলবে না, ছবি শুরুর আগে বাজাতে হবে জনগণমন। জনগণমন যখন বাজবে, তখন ছবিঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ থাকবে, যেন চাইলেই কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে, অথবা ছবিঘর থেকে বেরিয়ে যেতে না পারে।  আসা যাওয়ার শব্দ জাতীয় সংগীতে দর্শকদের নিবিষ্টতা নষ্ট করতে পারে, বা তাদের আচ্ছন্নতায় বিঘ্ন ঘটাতে পারে – এই আশঙ্কা। জাতীয় সংগীত বাজার সময় পর্দায় দেখাতে হবে জাতীয় পতাকা, সেসময় ছবিঘরের আবালবৃদ্ধবনিতা প্রত্যেককে ৫২ সেকেন্ড দাঁড়িয়ে জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। এই হলো কথা।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের ভুলো মন। ওঁরা ভুলে গেছেন যে এই আইনের কারণে ১৯৯৭ সালে দিল্লির উপহার সিনেমা হলে খুব বড় একটি দুর্ঘটনা ঘটেছিল। ‘বর্ডার’ নামের একটি সিনেমা চলার সময় হলের ভেতর আগুন ধরে যায়, দরজা বন্ধ থাকার কারণে দর্শকদের কেউ বাইরে বেরিয়ে যেতে পারেনি। সেদিনের সেই আগুনে ৫৯ জন মানুষ মারা যায়, শতাধিক আহত হয়। ঘটনার পর সুপ্রিম কোর্ট থেকে বলা হয়েছিল এখন থেকে হলের দরজা খোলা থাকবে। দরজা এরপর থেকে খোলা। এখন যে দরজা আবার বন্ধ করা হল, আগুন ধরলে মানুষ কী করে বাঁচবে, তা অবশ্য বলে দেওয়া হয়নি।
ছোটবেলায় দেখেছি সিনেমা হলে জাতীয় সংগীত বাজতো, আমি উঠে দাঁড়াতাম। অনেকেই দাঁড়াতো। কেউ কেউ আবার দাঁড়াতো না। হয়তো পঙ্গু, হয়তো জাতীয় সংগীতকে সম্মান জানাতে গেলে যে দাঁড়াতে হয় এই নিয়মটা মানতো না, মনে করতো বসেও সম্মান জানানো যায়, আবার কেউ হয়তো মনে করতো সম্মান জানানোর আদৌ কোনও প্রয়োজন নেই। মানুষ তো একেকজন একেক রকম। যে সব মতে কারও ক্ষতি হয় না সেসব মতকে গ্রহণ করাই গণতন্ত্রের শর্ত। যারা জাতীয় সংগীত বাজার সময় উঠে দাঁড়াতো না, তাদের কেউ তিরস্কার করছে, এমন দেখিনি। সে আমার ছোটবেলাকার কথা, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পর সবার দেশপ্রেম টনটনে ছিল, সিনেমা হলে জাতীয় সংগীত বাজাবার নিয়ম ছিল। এই  নিয়মটি একসময় উঠে যায়।  

ভারতবর্ষেও এই নিয়মটি কখনও ছিল, কখনও আবার  ছিল না। এই দেশটি স্বাধীন হয়েছে সত্তর বছর আগে। এত কাল পর দেশপ্রেম কার আছে, কার নেই এসব পরখ করে দেখাটাও বড় ছেলেমানুষি বলে মনে হয়। দেশের সর্বোচ্চ আদালত যখন প্রেক্ষাগৃহে জাতীয় সংগীত বাজাবার এবং প্রেক্ষাগৃহের দরজা বন্ধ রাখার এবং দর্শকদের সকলকে উঠে দাঁড়িয়ে বাধ্যতামূলক ভাবে জাতীয় সঙ্গীতকে সম্মান জানাবার আদেশ দেন, তখন অবাক হই।

জোর করে কাউকে দেশপ্রেমিক বানানো যায় কি? দেশপ্রেমিক নয় এমন মানুষেরও তো অধিকার আছে ছবিঘরে ছবি দেখতে যাওয়ার, এবং জাতীয় পতাকা দেখে উঠে না দাঁড়ানোর, জাতীয় সংগীতকে আর সবার মতো করে সম্মান না করার। আর তা ছাড়া জাতীয় সংগীত গাইলেই বা জাতীয় সংগীত শুনে উঠে দাঁড়ালেই মানুষ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে, আর তা না হলে করে না তাও তো ঠিক নয়।  

সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি মানুষের অগাধ আস্থা। এই আস্থা নষ্ট করলে চলবে কেন! পরস্পর বিরোধী কথা বলা আর যাকেই মানাক, সর্বোচ্চ আদালতকে মানায় না। মনে পড়ে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া নিয়ে একটি মামলা উঠেছিল ১৯৮৬ সালের আগস্ট মাসে, যেখানে কেরালার একটি স্কুলে বেশ কিছু খ্রিস্টান ছাত্র জাতীয়সংগীত না গাওয়ার অপরাধে অভিযুক্ত হয়। সর্বোচ্চ আদালতের  রায় ছিল, ‘জাতীয় সংগীত সম্মানের বিষয়, কিন্তু কাউকে জোর করে তা গাওয়াবার মধ্যে কোনও সম্মান নেই। কে গাইবে কে গাইবে না, তা  নিতান্ত ব্যক্তি-অধিকার’। সুপ্রিম কোর্টের নতুন আইনটি কিন্তু এই ব্যক্তি অধিকারকেই অস্বীকার করছে। ব্যক্তির মত প্রকাশের অধিকারকেও প্রকারান্তরে হেয় করেছে। এ তো গণতন্ত্রকেই হেয় করা।

জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে এর আগে কঠোর কোনো আইন ছিল না ভারতবর্ষে। যা ছিল তা প্রশাসনিক নির্দেশ। গত বছরই একটি পাস হয়েছিল। নির্দেশটা এরকম, ‘অনিচ্ছায় জাতীয় সংগীত গাইলে তার অবমাননা হয়, সুতরাং গাওয়া-না গাওয়ার বিষয়টি মানুষের ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত, চলচ্চিত্র বা প্রদর্শনীতে দর্শকরা নানা কারণেই জাতীয় সংগীতকে যতটা সম্মান দেখানো উচিত, ততটা দেখাতে পারে না, সুতরাং ওসব জায়গায় জাতীয় সংগীতের ব্যবহার না করাই উচিত’। এই নির্দেশটিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট সম্পূর্ণ বিপরীত একটি নির্দেশ জারি দিচ্ছেন মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে তোয়াক্কা না করেই, এটি কি সুপ্রিম কোর্ট ভালো কোনও কাজ করলেন?

চলুন মধ্যপ্রদেশের অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার নাটের গুরু শ্যাম নারায়ণ চৌকসির কাণ্ডকারখানা দেখি। ২০০১ সালের ডিসেম্বরে করন জোহরের ‘কভি খুশি কভি গম’ ছবিটি ভোপালের জ্যোতি টকিতে দেখতে গিয়েছিলেন তিনি। ওই ছবিতে এক ভারতীয় বালক তার ইংল্যান্ডের স্কুলের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে ভারতের জাতীয় সংগীত গাইতেই, প্রথমে শুধু বালকটির পরিবার একমাত্র ভারতীয় হিসেবে উঠে দাঁড়ালেও, ধীরে ধীরে ভারতের জাতীয় সংগীতের সম্মানে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত সমস্ত দর্শক। কিন্তু জ্যোতি টকিতে বসে থাকা দর্শকরা কেউ উঠে দাঁড়াননি। শুধু শ্যাম নারায়ণ চৌকসি দাঁড়িয়েছিলেন একা। দাঁড়িয়েছিলেন বলে তাঁর পেছনের আসনের দর্শকরা তাঁকে ধমকে বসতে বলেছিলেন। কারণ তার দাঁড়ানোর কারণে পেছনের দর্শকদের ছবি দেখতে অসুবিধে হচ্ছিল। শ্যাম নারায়ণ চৌকসি সেদিন অপমানিত বোধ করেন। এরপর তিনি সিনেমা হলের বাইরে দলবল নিয়ে বিক্ষোভ দেখিয়ে ক্ষান্ত হননি, মধ্য প্রদেশের উচ্চ আদালতে মামলা ঠুকে দিয়েছেন। উচ্চ আদালত কভি খুশি কভি গমের প্রদর্শন বন্ধ করে দেন যতক্ষণ পর্যন্ত না ওটি থেকে জাতীয় সংগীতের দৃশ্যটি কেটে দেওয়া হয়। হাই কোর্টের এই রায়টিকে উড়িয়ে দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট তখন বলে দিয়েছিলেন, ‘ফিল্মের ভেতরে জাতীয় সংগীত গাওয়া হলে প্রেক্ষাগৃহের দর্শকদের উঠে দাঁড়াতে হবে না। যদি কেউ উঠে দাঁড়ায় তাহলে দর্শকদের অসুবিধেই বাড়বে, জাতীয় সংগীতের প্রতি কোনও সম্মান বাড়বে না’।  

শ্যাম নারায়ণ চৌকসি তারপরও দমে যাননি। তিনি লেগেই ছিলেন এর পেছনে। জাতীয় সংগীতের অবমাননার নানা রকম প্রমাণ সংগ্রহ করতে শুরু করেন। প্রমাণের মধ্যে একটি হলো, পত্রিকার কাগজের ঠোঙায় মধ্যপ্রদেশের এক লোক খাবার খেয়ে ঠোঙাটা ডাস্টবিনে ফেলে দেয়, যে কাগজ দিয়ে ঠোঙাটা বানানো হয়েছিল, সেটিতে ভারতের জাতীয় সংগীত এবং জাতীয় পতাকার ছবি ছাপানো ছিল। চৌকসির জাতীয়তাবাদী অনুভূতি এতে আঘাত পেয়েছে। সে কারণে তিনি সুপ্রিম কোর্টে যান। তাঁর দাবি, ভারতীয় সংবিধানের ৫১ নম্বর ধারা অনুযায়ী দেশের প্রতিটি নাগরিককে জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সংগীতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। তাঁর আরও দাবি, সিনেমা হলগুলোয় সিনেমা দেখানোর আগে জাতীয় সংগীত প্রচার করতে হবে, দর্শকদের অন্তত ৫২ সেকেন্ডের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, জাতীয় সংগীত নিয়ে সিনেমা থিয়েটারের বাণিজ্য করা যাবে না, হাবিজাবি জায়গায় জাতীয় সংগীত ছাপাও যাবে না।

চৌকসির আবেদনের ফলে সুপ্রিম কোর্ট তার আগের রায় বাতিল করে নতুন রায় দিলেন, যেটি আগের রায়ের বিপরীত রায় এবং যে রায় মানবাধিকার লঙ্ঘন করে।

চরম ডানপন্থীদের আস্ফালন দেশ জুড়ে। তুমি এই রায় না মানলে তুমি দেশপ্রেমিক তো নওই, তুমি দেশদ্রোহী, এমন কথা চারদিকে শুনছি। দেশপ্রেম যে দেশের পতাকা দেখে বা জাতীয় সংগীত শুনে উঠে দাঁড়ালে যত প্রকাশ পায় তার চেয়ে বেশি প্রকাশ পায় দেশের দারিদ্র্য, নারী পুরুষের বৈষম্য, দুর্নীতি, দূষণ ইত্যাদি দূর করার চেষ্টা করলে--  তা কাউকে বোঝাতে পারিনি। বরং বলতে গিয়ে অনেকের গালি শুনেছি।

আমরা যত ক্ষুদ্র তুচ্ছ ব্যাপারকে দেশপ্রেম বলে আখ্যা দেব, এবং এ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবো, তত সহজ হবে শাসকের আমাদের সন্তুষ্ট করা আর বড় সমস্যা থেকে আমাদের দৃষ্টি সরিয়ে রাখা। রাজনৈতিক দলগুলো এমন হীন উদ্দেশ্য নিয়ে চলতে পারে, চলেও, কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের তো ভালো ছাড়া মন্দ কোনও উদ্দেশ্য নেই। সুপ্রিম কোর্ট মানুষের গণতান্ত্রিক  অধিকার লংঘন করার  সব রকমের প্রক্রিয়া সাধারণত বাতিল করে দেয়, সেখানে নিজেই সেই অধিকারের বিরুদ্ধে কী করে যায়! আশঙ্কার বিষয় বটে।   

লেখক: কলামিস্ট

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আনারসের পাতা থেকে তৈরি হবে সিল্ক জামদানি শাড়ি
আনারসের পাতা থেকে তৈরি হবে সিল্ক জামদানি শাড়ি
সিনেমার মহরত অনুষ্ঠানে স্পিকার
সিনেমার মহরত অনুষ্ঠানে স্পিকার
আদালতের আদেশ লঙ্ঘনের দায়ে ট্রাম্পকে ৯ হাজার ডলার জরিমানা
আদালতের আদেশ লঙ্ঘনের দায়ে ট্রাম্পকে ৯ হাজার ডলার জরিমানা
দালাল চক্রে দুই হাসপাতালের সাবেক-বর্তমান স্টাফরা
দালাল চক্রে দুই হাসপাতালের সাবেক-বর্তমান স্টাফরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ