X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

বন্যায় ভেসে যাক সব অমানবিকতা

প্রভাষ আমিন
১৭ আগস্ট ২০১৭, ১৫:৪৬আপডেট : ২২ আগস্ট ২০১৭, ১৫:৪০

প্রভাষ আমিন ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বন্যা বাংলাদেশের প্রতি বছরের ঘটনা। বন্যার সাথেই আমাদের ফি বছরের বসবাস। তবে প্রতি বছরের বন্যাই দুর্যোগ নয়। কখনও কখনও বন্যা আশীর্বাদও। বরং প্রতি বছরের রুটিন বন্যাই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। এই যে আমরা বলি সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশে। এর মূল কৃতিত্ব বন্যার। রুটিন বন্যার বয়ে আনা পলিমাটি আমাদের জমির উর্বরা শক্তি বাড়ায়। আর বাড়ায় বলেই এইটুকু ছোট্ট ব-দ্বীপে ঠাসাঠাসি করে আমরা ১৬ কোটি মানুষ এখনও খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি। তবে মাঝে মাঝে সেই বন্যা প্রলয়ঙ্করী হয়ে ভাসিয়ে নেয় সবকিছু- জীবন, ফসল, সম্পদ, ঘরবাড়ি, গবাদি পশু; সবকিছু।
আমার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দি এলাকায়। এটি বন‌্যাপ্রবণ এলাকা। প্রতিবছরই বন‌্যার পানি আমাদের বাড়ি ছোঁয়। কখনও কখনও তা ভাসিয়ে নেয়। আমার ছেলেবেলার বন্যার স্মৃতি সম্ভবত ৭৪ সালের। সেটা ছিল আমাদের ছোটদের জন্য উৎসবের। বাড়ির উঠানে থৈথৈ পানি। বড়দের টেনশন আমাদের ছোঁয়নি। ঘরের দাওয়ায় বসে পানি ছোঁয়া যায়, চাইলে বড়দের চোখ ফাঁকি দিয়ে টুকটাক নেমেও পড়া যায়, এটাই আমাদের উৎসব। উঠান থেকে মাছ ধরার স্মৃতিও এখন আনন্দ দেয়। তবে ৮৮ সালের মহাপ্রলয় আমাদের ভুগিয়েছে অনেক। তখন দেখেছি মানুষের দুর্ভোগ। আমার স্মৃতিতে ৮৮ সালের বন্যাই সবচেয়ে বড় ও দীর্ঘস্থায়ী। আমাদের পাশের বাড়ির লোকজন তখন তাদের ঘর ভেঙে নতুন ঘর বানাচ্ছিল। সে কারণে তারা সেদিন উঠানে পাটি আর কাথা বিছিয়ে শুয়েছিল। হঠাৎ মাঝরাতে পানি এসে ভাসিয়ে নেয় তাদের। সেই যে মধ্যরাতে পানি এলো, তারপর আর নামার নাম নেই। মাসের বেশি স্থায়ী হয়েছিল সেবারের বন‌্যা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক পানিতে ডুবেছিল দিনের পর দিন। আমাদের এলাকায় অল্প একটু মাটি ছিল, তা এই মহাসড়কের একটি সেতু এবং তার দুই পাশের অল্প একটু রাস্তা। এলাকার সব পুরুষ ঘুম থেকে ওঠে সেই রাস্তায় চলে যেতাম আর ফিরতাম সূর্য ডোবার পর। যাওয়া-আসার কৌশলটাও ছিল খুব সহজ, অথচ এখন ভাবলে মনে হয় অসম্ভব। লুঙ্গি পড়ে আমরা রওনা দিতাম। আস্তে আস্তে পানি বাড়তো, লুঙ্গি ওপরে উঠতো, একসময় লুঙ্গি এক হাতে নিয়ে সাঁতরে পেরিয়ে যেতাম। আবার আস্তে আস্তে পানি কমতো, লুঙ্গি নামতো। এভাবে সেই রাস্তায় রাজ্যের মানুষ গিজগিজ করতো। শুধু মানুষ নয়, এলাকায় সব গবাদিপশুর ঠাঁইও সেই এক চিলতে রাস্তায়। আমরা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতাম দল বেঁধে নৌকায় দূরে কোথাও গিয়ে। এখন হাস্যকর শোনালেও, এসবই বন্যার সময়কার বাস্তবতা। আমরা তবু এভাবে সামাল দিতাম। কিন্তু বাড়ির নারীরা কিভাবে রান্না করতেন বা অন্যান্য দৈনন্দিন কাজ সারতেন তখন খোঁজ নেইনি। এখনও ভাবলে অবাক লাগে, প্রশ্নের উত্তর পাই না। ৮৮ সালের বন্যার পর ঢাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু তাতে থামানো যায়নি ৯৮ সালের বন্যার ভয়াবহতা। বন্যার একটা সাইকেল আছে। সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে বড় বন্যা হয়েছে, ৮৮ সালে হয়েছে, ৯৮ সালে হয়েছে, ২০০৮ সালে বড় বন্যা না হলেও এবার আবার বড় বন্যার আশঙ্কা করছেন সবাই। 

ঝড় বা সাইক্লোনের মতো বন্যার আঘাত তাৎক্ষণিক নয়। দীর্ঘস্থায়ী বন্যা নানামুখী দুর্যোগ ডেকে আনে। সে দুর্যোগের প্রভাব থাকেও দীর্ঘদিন। বন্যার সময় খাবার অভাব, পানির অভাব তো আছেই; আছে নিজেদের এবং গবাদি পশুর থাকার সমস্যা। বন্যা কেটে গেলেও দুর্ভোগ কাটে না। বরং তখনই শুরু হয় আসল সমস্যা। পানি নেমে যাওয়ার পর শুরু হয় পানিবাহিত রোগের প্রকোপ। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফসল। তাতে প্রান্তিক মানুষের ঘরে খাবারের অভাব দেখা দেয়। তাই বন্যার সময় তো বটেই, বন্যার পরও দুর্গত মানুষের পাশে থাকা জরুরি। বন্যা দারুণ এক সাম্যবাদী দুর্যোগ। ধনী-গরিব সবাইকে সমান ভোগান্তিতে ফেলে।

অবস্থানগত কারণে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস-বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়তে হয় আমাদের। কিন্তু বন্যা নিছক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কিন্তু কখনও কখনও মানুষও তাতে ভূমিকা রাখে। যেমন আমরা সারা বছর তিস্তার পানির জন্য হাহাকার করি। কিন্তু ভারত বন্যার সময় এলেই গাজলডোবার সব গেট খুলে দেয় আর আমরা ভেসে যাই। ভারত-নেপালের পানি বাংলাদেশ হয়ে বঙ্গোপসাগরে যাবে, এটাই পানির স্বাভাবিক চলাচলের ধর্ম। কিন্তু প্রতিবেশী দেশগুলো আরেকটু মানবিক হলে আমাদের এমন আচমকা ভেসে যেতে হয় না।

এবারের বন্যা শুরু হয়েছে হাওরের ফসল ডুবে যাওয়া থেকে। তারপর দফায় দফায় বন্যা হয়েছে। এখনও আশঙ্কা শেষ হয়নি, মৌসুম ফুরায়নি। ৮৮ ও ৯৮ সালের বন্যার চূড়ান্ত বিপর্যয় ঘটেছিল সেপ্টেম্বরে। কারো কারো আশঙ্কা এবারের বন্যা ৮৮ সালের বন্যাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। প্রার্থনা করি, ৮৮ সালের মতো বন্যা যেন আর কখনোই না হয়। তবু আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। ইতিমধ্যে দেশের অন্তত ৩০ জেলার কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। দেশের উত্তরাঞ্চলের উচু জেলা দিনাজপুর, রংপুর, কুড়িগ্রামে সাধারণত বন্যা হয় না। তাই বন্যা মোকাবিলায় তাদের প্রস্তুতি ও সক্ষমতা কম। উত্তরাঞ্চলের পানি কমতে শুরু করেছে। এখন শঙ্কা মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে।

বন্যার্তদের তাৎক্ষণিক ত্রাণ যেমন দরকার, তেমনি দরকার দীর্ঘমেয়াদী সহায়তা। তাৎক্ষণিক সহায়তার মধ্যে আছে খাদ্য, পানি, চিকিৎসা, ওষুধ, কাপড়। দীর্ঘমেয়াদী সহায়তায় লাগবে ঘর বানানোর উপকরণ, সার-বীজ- পুরনো ঋণের কিস্তি মওকুফ, প্রয়োজনে নতুন ঋণ। তাই সরকার এবং পাশপাশি সব বেসরকারি সংগঠনকে সর্বস্ব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে এখনই।

দুর্যোগে যেমন আমরা সবার চেয়ে এগিয়ে, দুর্যোগ মোকাবিলায়ও আমরা বিশ্বসেরা। বরং সারা বছর আমরা বিভক্ত থাকলেও, দুর্যোগ আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে। আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দুর্যোগ মোকাবিলা করি। দুর্যোগ আমাদের ভেতরের মানুষটাকে বের করে আনে। দুর্যোগের সময় দুর্গত এলাকায় অপরাধ কমে যায়। খুন-ধর্ষণ-চুরি-ডাকাতি সব বন্ধ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, মানুষ পুরনো শত্রুতা ভুলে একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়ায়। ৮৮ সালের বন্যার সময় আমাদের বাড়ির পাশের এক চিলতে শুকনো জায়গার কথা বলেছিলাম। সেই জায়গায় সত্যিকার অর্থে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যেন। ধর্ম-বর্ণ-বয়স নির্বিশেষে সবাই এক কাতারে নেমে আসতো। ৮৮ ও ৯৮ এর বন্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ত্রাণ শিবির খুলে রুটি বানানোর স্মৃতিও অনেকে ভুলে যাননি নিশ্চয়ই। আবার সময় এসেছে আমাদের জেগে ওঠার। ভেতরের মানুষটাকে জাগিয়ে তোলার। সব অমানবিতা, পাশবিকতাকে বানের জলে ভাসিয়ে দেওয়ার। 

এবার পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল না। এখন ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্যা দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর নানা উদ্যোগ সক্রিয় হচ্ছে। সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকেও সক্রিয় হতে হবে। আমাদের সবার পক্ষে তো আর বন্যাদুর্গত এলাকায় গিয়ে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই আমাদের ব্যক্তি উদ্যোগগুলোকে কোনও সাংগঠনিক উদ্যোগের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে হবে। সম্ভব হলে ছোট ছোট উদ্যোগগুলোকে সমন্বিত কোনও বড় উদ্যোগের অধীনে আনতে হবে। তারপর কোথায় কতটুকু দরকার তা মূল্যায়ন করে ত্রাণ বিতরণ করতে হবে। তবে দুর্যোগের সময় মানবিকতার ফসল যেমন ফলে, তাতে কিছু আগাছাও জোটে। তাই নিশ্চিত হয়ে নিন, আপনার অর্থ বা ত্রাণ ঠিক লোকের হাতে যাচ্ছে কিনা।

সাধারণত এ ধরনের  দুর্যোগে যা হয়, কাছাকাছি এলাকার মানুষ বারবার ত্রাণ পান। আর যারা একদম প্রান্তে থাকেন, তাদের কাছে কেউ যান না, অত কষ্ট কেউ করতে চান না। তাই চেষ্টা করতে হবে সবার কাছে সমানভাবে ত্রাণ পৌঁছানোর। যার যেটা দরকার তাকে সেটাই দিতে হবে। শুধু ত্রাণ বিতরণ করলাম, এই আত্মতুষ্টিতে যেন না ভুগি আমরা।

এবার আমাদের সামনে আরেকটা বড় সুযোগ আছে। সামনেই পবিত্র ঈদুল আযহা। প্রতিবার ঈদুল আযহায় আমাদের দেশে একটা 'দেখনদারির' প্রতিযোগিতা হয়- কার গরু কত বড়, কোনটার দাম বেশি ইত্যাদি ইত্যাদি। আর সামনে যেহেতু নির্বাচন। তাই এবার এই 'দেখনদারি'টা আরও বেশি হওয়ার কথা। আমরা যদি জরুরি কোরবানিটা ছাড়া 'দেখনদারি'টা একটু কমাতে পারি, বেঁচে যাওয়া অর্থটা যদি ব্যয় করি বন্যার্তদের সাহায্যে, তাহলে বেঁচে যাবে অনেক মানুষ। সম্ভব হলে জরুরি কোরবানিটা যদি কোনও বন্যাদুর্গত এলাকায় করে মাংসটা দুর্গত মানুষের মাঝে বিলি করা যায়, তাহলে আরও ভালো হয়। আরেকটা বিষয় মাথায় রাখা দরকার, দেশের অনেক কৃষক সারাবছর গরু পালে কোরবানির সময় ভালো দামে বিক্রির আশায়। কিন্তু এখন খাবারের অভাবে হয়তো প্রিয় পশুটিকে পানির দরে বেঁচে দিতে হবে। প্লিজ সম্ভব হলে আপনি আপনার কোরবানির পশুটি কিনুন দুর্গত এলাকার মানুষের কাছ থেকে, তবে ন্যায্য দামে। বন্যার সুযোগে যেন আমরা তাদের না ঠকাই। সমাজে অসংখ্য ভালো মানুষ যেমন আছে, তেমনি আছে কিছু সুযোগসন্ধানীও, যারা বন্যার পদধ্বনি শুনতে পেলেই জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়, স্টক করে। তেমন সুযোগসন্ধানির দেখা পেলে তাকে প্রতিরোধ করুন।

প্রতিবার বন্যা বা এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা শুরু হয় এবং সমন্বয়হীনতার কারণে তার অপচয়ও হয়। এই দিকে নজর রাখার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি। পানি নেমে যাওয়া মানেই কিন্তু বন্যার দুর্ভোগ শেষ হওয়া নয়। আসল দুর্ভোগ শুরু হয় তখনই। তাই তাদের পাশে সবাইকে থাকতে হবে শেষ পর্যন্ত।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

[email protected]

 

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ম্যারাডোনার সংস্পর্শ পাওয়া বাংলাদেশ দলের জুয়েল কেন ‘উধাও’
ম্যারাডোনার সংস্পর্শ পাওয়া বাংলাদেশ দলের জুয়েল কেন ‘উধাও’
আ.লীগের হীরকজয়ন্তী অনুষ্ঠানে দাওয়াত পাবে বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
আ.লীগের হীরকজয়ন্তী অনুষ্ঠানে দাওয়াত পাবে বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
খুলনায় বজ্রসহ বৃষ্টি
খুলনায় বজ্রসহ বৃষ্টি
কালবৈশাখী বয়ে যেতে পারে সারা দেশে
কালবৈশাখী বয়ে যেতে পারে সারা দেশে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ