X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্লেয়িং ফিল্ড কতটা লেভেল?

প্রভাষ আমিন
০৩ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৮:২১আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৮:৫২

প্রভাষ আমিন প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে সম্প্রতি বেশ আলোচনা হচ্ছে। যতটা খেলার মাঠে, তারচেয়ে বেশি রাজনীতির ময়দানে। খেলার মাঠ সমতল হওয়াটা খুব জরুরি। নানাভাবেই এটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়। ফুটবলে তো টসের পরেও দুই অর্ধে প্রান্তবদল করে খেলতে হয়। ক্রিকেটে অবশ্য টসটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ম্যাচে টস জেতাই হয়ে যায় ম্যাচের নির্ধারক। ক্রিকেটে টস ছাড়াও আরেকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর রয়েছে। সেটি পিচ। যথোপযুক্ত পিচ ছাড়া ক্রিকেট খেলাটাই সম্ভব নয়। খেলায় ‘হোম অ্যাডভান্টেজ’ বলেও একটা কথা আছে। নিজেদের মাঠে খেললে বাড়তি সুবিধা পায় সব দলই। মাঠে উপস্থিত দর্শক সমর্থন তো আছে, আছে হোম অ্যাডভান্টেজ কাজে লাগিয়ে নিজেদের মতো মাঠ বা পিচ বানানো। এই যেমন গত জুলাইয়ে বাংলাদেশ গিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে। দুই টেস্টেই হেরেছিল বাংলাদেশ। এক ইনিংসে তো অলআউট হয়েছিল ৪৩ রানে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেস অ্যাটাক শক্তিশালী। তাই তারা ফাস্ট পিচ বানিয়ে বাংলাদেশকে কাবু করেছিল। পাঁচ মাসের মধ্যে বাংলাদেশ সফরে এসে উল্টো চিত্র দেখলো ক্যারিবিয়রা। সিরিজের দুটি টেস্টই শেষ হয়েছে আড়াই দিনে। বাংলাদেশের ঘূর্ণিজালের ফাঁদ কাটার উপায় জানা ছিল না ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানদের। ওয়েস্ট ইন্ডিজ যেমন তাদের মাটিতে ফাস্ট পিচ বানিয়ে বাড়তি সুবিধা পেয়েছিল, বাংলাদেশও স্পিন পিচ বানিয়ে সুবিধা নিয়েছে। ক্রিকেটে এই হোম অ্যাডভান্টেজ স্বীকৃত, মোটেই অন্যায় নয়।

রাজনীতিতেও যেমন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড খুব গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এখানেও আছে ‘হোম অ্যাডভান্টেজ’-এর ধারণাও। কিন্তু সবকিছু হতে হবে নিয়ম মেনে। রেফারি বা অ্যাম্পায়ারকে হতে হবে নিরপেক্ষ। ফাউলও খেলার অংশ। ফাউলের ধরন দেখে রেফারি খেলোয়াড়ের শাস্তি নির্ধারণ করেন। এমনকি চাইলে লালকার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বেরও করে দিতে পারেন। আবার খেলায় বেনিফিট অব ডাউট বলেও কথা আছে। রেফারি বা অ্যাম্পায়াররাও মানুষ। তারাও মানবিক ভুল করতে পারেন। রেফারির চোখ এড়িয়ে ম্যারাডোনা বিশ্বকাপে হাত দিয়ে গোল দিয়েও পার পেয়ে গিয়েছিলেন। রেফারি বা অ্যাম্পায়াররা ভুল করতে পারেন, তারা অদক্ষ হতে পারেন। তবে তারা জেনেশুনে কোনও দলের পক্ষ নেবেন না, এটাই প্রত্যাশা। তবু কখনো কখনো অ্যাম্পায়ারদের বিরুদ্ধেও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ওঠে, বিশেষ করে বড় দলের পক্ষে তাদের অবস্থান নিয়ে কথা ওঠে। বেনিফিট অব ডাউট প্রায়শই দুর্বল দলের বিপক্ষে যায়।

নির্বাচনের মাঠে রেফারি হলো নির্বাচন কমিশন। প্রধান রেফারি হলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। খেলার মতো নির্বাচনেও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকাটা জরুরি। নির্বাচনে অংশ নেওয়া সব দল যেন সমান সুযোগ পায়, এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। এখানেই বিপত্তি। নির্বাচন কমিশনের কিছু কিছু আচরণ এখনও দৃষ্টিকটু, নির্বাচনের মাঠকে এখনও যথেষ্ট সমতল মনে হচ্ছে না। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপের সময় প্রধানমন্ত্রী ধরপাকড় না করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ধরপাকড় না করার কথা। সিইসিও বলেছেন, পুলিশ নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে। তাদের অনুমতি ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। কিন্তু বিরোধী দল এখনও অভিযোগ করছে, ধরপাকড় চলছে। তাহলে কি সিইসির নির্দেশেই ধরপাকড় চলছে?

বিএনপি পুলিশ ও প্রশাসনের ৯২ জনের তালিকা দিয়েছিল নির্বাচন কমিশনে। সরকার সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সে অভিযোগ কানে তোলেনি। একটি দল ১০ বছর ক্ষমতায় থাকলে পুলিশে, প্রশাসনে তাদের সমর্থক অনেক লোক থাকবে, এটা অস্বাভাবিক নয়। বিএনপির তালিকা যদি সত্যি হয়, মাত্র ৯২ জন সরকারি দলের সমর্থক হয়ে থাকেন; তাহলে মানতে হবে আওয়ামী লীগ অনেক কম দলীয়করণ করেছে। নির্বাচনের আগে পুলিশ ও প্রশাসনে রদবদলও স্বাভাবিক ঘটনা। বিএনপির দাবি করতে হবে কেন, নির্বাচন কমিশনের নিজেদের তাগিদেই নিজেদের মতো করে রদবদল করা উচিত ছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের সাজানো প্রশাসনে হাত দেয়নি। বিএনপির অভিযোগ পুরোপুরি আমলে না নিলেও নারায়ণগঞ্জের এসপি আনিসুর রহমানকে বদলি করা হয়েছে। শুনে ভাবতে পারেন, নির্বাচন কমিশন খুব নিরপেক্ষ হয়ে গেছে। কিন্তু তার বদলে সেখানে এসপির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বহুল আলোচিত হারুন উর রশিদকে। এ যে জলে কুমির, ডাঙ্গায় বাঘ অবস্থা। বিএনপি কাকে রেখে কাকে নেবে?

২ ডিসেম্বর ছিল মনোনয়নপত্র যাচাই বাছাই। এবার মোট ৩ হাজার ৬৫ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। এরমধ্যে ৭৮৬ জনের মনোনয়ন বাতিল হয়েছে। দণ্ডিত, ঋণখেলাপি, বিলখেলাপি হলে প্রার্থিতা বাতিল হতে পারে। ঠিকমতো মনোনয়নপত্র পূরণ না করলে, হলফনামা না দিলে, স্বতন্ত্র হলে ১ শতাংশ ভোটারের সই না থাকলে, তথ্য গোপন করলেও মনোনয়নপত্র বাতিল হতে পারে। কিন্তু দেখা গেছে, মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়া বেশিরভাগই বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্টের।

আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী অনেকের মনোনয়নপত্র বাতিল হলেও আওয়ামী লীগের কারোই হয়নি। তার মানে, আওয়ামী লীগের সব প্রার্থী ‘সাধু’ এবং তারা নিখুঁতভাবে মনোনয়নপত্র পূরণ করেছেন। কিন্তু আমার ধারণা এক্ষেত্রে রিটার্নিং অফিসাররা পুরোপুরি অনুরাগ-বিরাগের ঊর্ধ্বে উঠে আচরণ করতে পারেননি। শুরুতে নির্বাচন কমিশন সচিব বলেছিলেন, ছোটখাটো ভুলে মনোনয়নপত্র বাতিল করা হবে না। কিন্তু তার নির্দেশনা ফলো করেননি রিটার্নিং অফিসাররা। সই না থাকা, ভোটারের সই না থাকায় অনেকের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে গেছে। কয়েক জায়গায় মির্জা ফখরুলের সই জাল সন্দেহে বিএনপি প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বাতিল করে দিয়েছেন। মির্জা ফখরুল দাবি করছেন, সই তার। কিন্তু রিটার্নিং অফিসাররা তাও মানছেন না। কী আশ্বর্য! আসলে খলের কখনও ছলের অভাব হয় না। মনে হচ্ছে, রিটার্নিং অফিসাররা বিএনপি প্রার্থীদের খুঁত ধরার জন্য বসেছিলেন। এ অবস্থার জন্য বিএনপিও তৈরি ছিল। তাই তো ৩০০ আসনে তারা ৮০০ জনকে মনোনয়ন দিয়েছিল। তারপরও অন্তত ছয়টি আসনে বিএনপি প্রার্থীশূন্য হয়ে গেছে। তাদের বিকল্প প্রার্থীর মনোনয়নও বাতিল হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে খেলার মাঠ পুরোপুরি সমতল মনে হচ্ছে না। রেফারিদেরও পুরোপুরি নিরপেক্ষ মনে হচ্ছে না। তবে সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি। রেফারিরা নিজেদের মানবিক সীমাবদ্ধতা ঝেড়ে ফেলে অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সবার প্রতি সমান আচরণের শপথটি মনে রেখে সামনের দিনে আচরণ করলে সবার জন্যই মঙ্গল।

তবে নিশ্চয়ই সরকারি দল হোম অ্যাডভান্টেজ নিতে চাইবে। সরকারি দল নিশ্চয়ই তাদের সুবিধামতোই পিচ বানাবে। তবে সেটাও যেন নিয়মের বাইরে না হয়।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমএনএইচ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বালুবাহী বলগেট থেকে নদীতে পড়ে শ্রমিক নিখোঁজ
বালুবাহী বলগেট থেকে নদীতে পড়ে শ্রমিক নিখোঁজ
পিনাকীসহ দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র, মুশফিককে অব্যাহতি
পিনাকীসহ দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র, মুশফিককে অব্যাহতি
৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘটে বান্দরবানে দূরপাল্লার যান চলাচল বন্ধ
৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘটে বান্দরবানে দূরপাল্লার যান চলাচল বন্ধ
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধির পূর্বাভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধির পূর্বাভাস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ