X
মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫
১৭ আষাঢ় ১৪৩২

বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা কেন বাড়ছে?

লীনা পারভীন
০৯ জানুয়ারি ২০২১, ১৪:৫৭আপডেট : ০৯ জানুয়ারি ২০২১, ১৪:৫৭

লীনা পারভীন বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে। এমন একটি সংবাদ ঘুরে বেড়াচ্ছে সংবাদ মাধ্যমে। এই সংবাদটি কি আসলেই নতুন? নাকি নতুন করে আবারও আলোচনায় এসেছে? আসলে বিষয়টি নতুন না হলেও করোনায় এই সংখ্যাটি বেড়ে যাওয়ার হার আগের চেয়ে অনেক বেশি। তবে এটিও সর্বোচ্চ বিচ্ছেদের সংখ্যা। জানা যায়, ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে ৩৯ টি তালাক হয়। কেবল কি ঢাকায়? আসলে একই চিত্র দেশের সব জায়গাতেই। পরিসংখ্যান বলছে তালাক দেওয়ার তালিকায় নারীদের সংখ্যাই বেশি। শহুরে বা মফস্বল, শিক্ষিত বা অশিক্ষিত, ধনী বা শ্রমজীবী যেকোনও হিসাবেই নারীরা আগের চেয়ে অনেক বেশি হারে তালাক দিচ্ছে।

জরিপে কারণ হিসাবে অনেক কিছু বলা থাকলেও আমার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ বলে মূল কারণটা হচ্ছে একসাথে থাকা দুটি মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক বা রুচিবোধের পার্থক্য। ‘বিবাহ’ একটি সামাজিক প্রক্রিয়া। আদিম সমাজ থেকে যখনই মানুষ পারিবারিক প্রথায় প্রবেশ করেছে সেই প্রথার অন্যতম একটি শর্ত ছিল নারী-পুরুষের সম্পর্কের একটি স্থায়ী সমাধান আনা। প্রচলিত সামাজিক রীতিতে নারী-পুরুষের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ককে ‘অবৈধ’ বলে পরিচয় করা হয়। কিন্তু আসলেই কি দু’জন সচেতন ও সজ্ঞান মানুষের মধ্যকার কোন সম্পর্ককে  ‘বৈধ’ বা ‘অবৈধ’ বলে ট্যাগ দেওয়া যায়? জানি, এ নিয়ে অনেকেই তর্কে আসবেন কিন্তু একবার ভেবে দেখলেই আমরা বুঝতে পারবো আসলে ‘বিবাহ’ নামক একটি অলিখিত আইনের মাধ্যমে দু’জন মানুষকে একসাথে থাকতে বাধ্য করা হয়। কেউ চাক বা না চাক একবার একটি নীল কাগজে সই করেছে মানেই আজীবন তাদেরকে এক ছাদের নিচে থাকতেই হবে। এই নিয়ম এখনও প্রচলিত আছে। যুগের পরিবর্তন হয়েছে। মানুষের মধ্যে নিজস্ব পছন্দ অপছন্দের  বিষয়ে সচেতনতা বেড়েছে। বিশেষ করে নারীদের মাঝে। আগে যেখানে নারীদের মত প্রকাশ করা মানেই ছিল “অবাধ্যতা” সেখানে এখন নারীরা অনেক বেশি স্বাধীন ও সচেতন। এই সমাজে নারীরাও কথা বলার অধিকার রাখে এবং নিজের অবস্থানকে তুলে ধরার সাহস রাখে। নিজের পছন্দকে প্রাধান্য দিতে শিখেছে নারীরা। পারিবারিক বন্ধনকে অস্বীকার না করেও একজন নারী তার স্বাচ্ছন্দের জীবন বেছে নিতে পারে।

এই যে পরিবর্তন। এখানেই যত বিপত্তি। কর্মজীবী নারী সে শ্রমিক বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যাই হোক না কেন, যখনই নিজের মতো করে বাঁচতে চাইবে তখনই সমাজ সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দুজন ব্যক্তি স্বামী বা স্ত্রী নামক সম্পর্কে জড়িত হওয়া মানেই একজন আরেকজনকে কিনে নেওয়া নয়। ব্যক্তির স্বতন্ত্রতাকে অস্বীকার করার অধিকার নারী বা পুরুষ কারোই নেই। প্রতিটা মানুষের নিজের বলে একটি জগত থাকে আর এই জগতকে সহজে মেনে নেওয়ার নামই ‘সম্পর্ক’। আসলে বিবাহ বলতে যদি বুঝায় ‘শৃঙ্খল’ তাহলে সেখানে শেকল ভাঙার গানের সুর রচনা হবেই। বিবাহিত জীবনে দু’জন মানুষের মধ্যে যদি রুচির পার্থক্য থাকে আকাশ আর পাতাল তাহলে মতের দ্বৈধতা আসবেই। সংসার মানে দু’জনের সমান অংশগ্রহণ। কেউ কাউকে অধিগ্রহণ করবে না বা ডমিনেট করবে না। সংসার মানে এই নয় যে একজন চলবে ১০০ মাইল গতিতে আর আরেকজন পড়ে থাকবে ৪০ মাইল গতিতে। গতি সমান না হোক অন্তত কাছাকাছিও যদি না আসে তাহলে কেউ এগিয়ে যাবে আর কেউ পিছিয়ে যাবে। এই এগিয়ে যাওয়া আর পিছিয়ে থাকাতেই থেমে যায় সংসারের গতি। দু’টি ভিন্ন মেরুর মানুষও এক সাথে থাকতে পারে যদি দু’জন দু’জনকে সহজভাবে এবং স্বতন্ত্রতার সাথেই গ্রহণ করে। এই জগতে কেউ কারও মতো নয়।

এই যে ভিন্নতা, এখানেই মানুষের সৌন্দর্য। কেউ কাউকে যেমন পাল্টাতে পারে না আবার অশ্রদ্ধাবোধ নিয়ে সৌহার্দ্যের সম্পর্কের বুননটি হয় না। সমঝোতা কেবল একজনই করবে তা হয় না। প্রয়োজনের তাগিদটি দু’জনের মাঝে সমানভাবে বিরাজ করতে হয়। আলাদা সম্পর্কের দুটি মানুষ যখন একটি সম্পর্কে এসে ধরা দেয় তখন নিজেদেরকে একে অপরের কাছে গ্রহণযোগ্য করার দায়িত্বটি কিন্তু দু’জনকেই নিতে হয়। কিন্তু আমাদের সমাজে দেখা যায় এই দায়িত্বটি কেউ নিতে চায় না। মনের মতো হওয়া নয় বরং গ্রহণযোগ্য একটি জায়গায় দু’জনের আসাই সেই সম্পর্ককে একটি শক্ত সুতোয় বুনে দেয়। বিশ্বাস বা ভালোবাসার জায়গাটুকু যদি না গড়ে উঠে তাহলে সেই সম্পর্কের চেয়ে বড় শাস্তি আর কিছু নেই। আমাদের সমাজে বাস্তবিক কারণে নারীরা পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে থাকে। আর সেই পিছিয়ে থাকার কারণ কোনোভাবেই সামর্থ নয় বরং সুযোগের অভাব। নিজেকে প্রকাশ করার অবাধ সুযোগের অভাবে অনেক নারী পিছিয়ে থাকে। আবার নিজের একটি রুচিবোধ গড়ার মতো সচেতনতাও থাকে না। একটি সম্পর্কের মানে বুঝে ওঠার আগেই জড়িয়ে পড়ছে সেই সম্পর্কে।

কিন্তু দিনে দিনে এই চিত্র পাল্টাতে শুরু করেছে। নারীরা এখন অনেক বেশি সচেতন, নিজেকে চিনতে শিখছে। রুচির বিষয়টি বুঝতে শিখছে। বিয়ের পরেও একজন নারী বা পুরুষের রুচির পরিবর্তন হতেই পারে। বয়স ও অভিজ্ঞতা একজন মানুষকে শিক্ষিত করে, সচেতন করে তোলে যার ফলে তাদের জীবনবোধ জেগে ওঠে। এই জায়গাটি অনেক বেশি গুরুত্বের সাথে দেখাটা জরুরি। রুচির পার্থক্য মানেই গ্রহণযোগ্যতার পার্থক্য। আইনে একজন নারী বা পুরুষ কবে বিয়ে করার উপযুক্ত হয় সেটি নির্দিষ্ট করা আছে। কিন্তু সেই মানদণ্ড কে কীভাবে নির্ধারণ করলো? ১৮ বছর বয়সে বা ২১ বছর বয়সে একজন নারী বা পুরুষের জীবন সম্পর্কে কতটাই বা জ্ঞান হয়? আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে। ক্যারিয়ার সচেতন নারীরা এখন বিয়ের চেয়ে নিজের কর্মজীবনে সফলতার দিকে সচেতন বেশি।

আমার কাছে মনে হয় এই জায়গাটিই গড়ে দিচ্ছে সকল পার্থক্য। বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানকে যদি টিকিয়ে রাখতে হয় তাহলে প্রচলিত সকল ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। তালাক বাড়ছে বলে আহাজারি করার কিছু নেই। বিবাহ বিচ্ছেদ একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং এর সংখ্যা সামনে আরও বাড়বে। এমনও একদিন হয়তো আসবে যেদিন কাগুজে সম্পর্কের চাইতেও বড় হবে দু’জন স্বাধীন মানুষের মধ্যে কবে কখন কেমন সম্পর্ক হবে সেটি নির্ধারণ করার মালিক কেবল সেই ব্যক্তিরাই। সুরে সুরে না মিললে যেমন একটি সুরেলা গান হয় না ঠিক তেমনি রুচিতে বা পথ চলার অর্থ ও গতি যদি সমান না হয় তাহলে সংসার করাও কঠিন হয়ে যায়।

লেখক: কলামিস্ট

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্রে নকল সরবরাহের অভিযোগে ছাত্রদল নেতা আটক
এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্রে নকল সরবরাহের অভিযোগে ছাত্রদল নেতা আটক
৩১ জুলাইয়ের মধ্যে জুলাই সনদ ঘোষণার আল্টিমেটাম ইনকিলাব মঞ্চের
৩১ জুলাইয়ের মধ্যে জুলাই সনদ ঘোষণার আল্টিমেটাম ইনকিলাব মঞ্চের
জুলাই বিভাজন নয়, ঐক্যের প্রতীক: নুর
জুলাই বিভাজন নয়, ঐক্যের প্রতীক: নুর
জুলাই বিপ্লবের শহীদেরা দেশ ও জাতিকে মুক্তির পথ দেখিয়েছে: ধর্ম উপদেষ্টা
জুলাই বিপ্লবের শহীদেরা দেশ ও জাতিকে মুক্তির পথ দেখিয়েছে: ধর্ম উপদেষ্টা
সর্বশেষসর্বাধিক