X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘রক্ত সিঁড়ির’ তর্কবাগীশ

সালেক উদ্দিন
২৭ জানুয়ারি ২০২২, ১৪:১৫আপডেট : ২৭ জানুয়ারি ২০২২, ১৪:১৮

সালেক উদ্দিন বাংলাদেশের রাজনীতিতে আপসহীন নেতাদের কথা লিখতে গেলে প্রথমেই যাদের নাম আসে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরমধ্যে জানুয়ারি মাস এলেই যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস সামনে এসে দাঁড়ায়, তেমনি মনে পড়ে  মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের কথা। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, বাংলাদেশের স্থপতি।  বাংলাদেশ শব্দটি উচ্চারিত হলেই বঙ্গবন্ধুর নাম আসবে এটাই স্বাভাবিক। তবে তর্কবাগীশের বিষয়টি একটু ভিন্ন। সেটাও স্বাধীনতার সঙ্গে জড়িত।

ব্রিটিশ অধীন থেকেই আমাদের পূর্বপুরুষরা ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িত। উপমহাদেশের মাটি থেকে ব্রিটিশদের তাড়ানোর তাগিদে এ দেশের মানুষ দল-মত নির্বিশেষে সেই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা ইতিহাসের পাতায় মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে ২৭ জানুয়ারির সলঙ্গা দিবসের ঘটনার সঙ্গে, সলঙ্গা গণহত্যার ইতিহাসের সঙ্গে।

সলঙ্গা দিবস এ দেশের সংগ্রামী মানুষের ঐতিহাসিক অবদান। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের রক্ত সিঁড়ি হিসেবে চিহ্নিত সলঙ্গা দিবস এ দেশের মানুষের অহংকার।

উপমহাদেশের মাটি থেকে ব্রিটিশদের তাড়ানোর জন্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসনের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল অসহযোগ আন্দোলন। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত এ দেশের জনতা দল-মত নির্বিশেষে সেই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ২২ বছর বয়সী মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ এই অঞ্চলে সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনামলে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রত্যক্ষ বিচরণ ছিল মাওলানা তর্কবাগীশের। তার নেতৃত্বে  সলঙ্গা আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল ১৯২২ সালের  ২৭ জানুয়ারি।

বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার ব্যবসায়িক জনপদ সলঙ্গায় সপ্তাহে দুই দিন হাট বসতো। শুক্রবার ছিল বড় হাটের দিন। সে বছর ২৭ জানুয়ারি ছিল বড় হাটবার। মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ছিলেন তরতাজা যুবক। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে তরুণ এই জননেতার নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মীরা সেদিন  হাটে নেমেছিলেন। ‘সলঙ্গার হাটে বিলেতি পণ্য বেচাকেনা চলবে না। এই হাট হবে কেবল স্বদেশি পণ্যের হাট’ স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠেছিল সলঙ্গা হাটের আকাশ-বাতাস। একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন  হাটের ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই।

এই স্বদেশি আন্দোলনের কর্মীদের দমন করতে সে সময়ের পাবনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপার ও সিরাজগঞ্জ মহকুমা প্রশাসক ৪০ জন লাল পাগড়িওয়ালা সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে ছুটে আসে সেই হাটে। সলঙ্গার গোহাটিতে বিপ্লবী স্বদেশি কর্মীদের কংগ্রেস কার্যালয় ঘেরাও করে তারা মাওলানা তর্কবাগীশকে গ্রেফতার করে। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে তাকে মুক্ত করতে জনতার বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। সেই মিছিলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। সংগ্রামী জনতার তাজা রক্ত আর নিথর লাশের স্তূপ জমে যায় সেখানে। ইতিহাস বলে, ওইদিন প্রায় ১২০০ প্রতিবাদী মানুষ ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারায়। আহত হয় ৪০০০-এরও বেশি। নিহতদের লাশের সঙ্গে সংজ্ঞাহীন আহতদের উঠিয়ে নিয়ে ব্রিটিশ পুলিশ সিরাজগঞ্জের রহমতগঞ্জে গণকবর দিয়েছিল সেদিন। সংঘটিত হয়েছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নৃশংস পাশবিক গণহত্যা। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে  স্বাধীনতা সংগ্রামের এই গণহত্যাকে ‘রক্ত সিঁড়ি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বে সলঙ্গা বিদ্রোহে সংঘটিত এই ‘রক্ত সিঁড়ি’ পার হয়েই উঠেছিল ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সূর্য।

সলঙ্গা দিবস, সলঙ্গা বিদ্রোহ, স্বাধীনতা সংগ্রামের রক্ত সিঁড়ি যাই বলি না কেন, সেই অধ্যায়ের নেতা ছিলেন  মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। তিনি ১৯০০ সালের ২৭ নভেম্বর সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার  তারুটিয়া গ্রামে এক পীর বংশে জন্মগ্রহণ করেন। অসামান্য নেতৃত্বদানের ক্ষমতা ছিল তার। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে অসহায় দুধ বিক্রেতাদের সংগঠিত করে দুধের ন্যায্যমূল্য প্রদানে বাধ্য করেন। ১৯১৯ সালে তিনি খেলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেন। সলঙ্গা আন্দোলনে মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ নেতৃত্ব দেন মাত্র ২২ বছর বয়সে। এ কারণে তাকে কারাভোগ করতে হয় এবং তার পক্ষে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয় না। পরবর্তীকালে শিক্ষা গ্রহণের জন্য তিনি যুক্ত প্রদেশের বেরিলি  ইসতুল উলুম মাদ্রাসা, দেওবন্দ মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন মাদ্রাসা  ও লাহোরের এশাতুল ইসলাম কলেজে অধ্যয়ন করেন। তর্কশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করে তর্কবাগীশ উপাধিতে ভূষিত হন। তিনি ১৯৩৩ সালে ঋণ সালিশি বোর্ড আইন প্রণয়নের প্রস্তাব রাখেন। ১৯৩৭ সালে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে নাটোরে কৃষক সম্মেলন আহ্বান করেন। ১৯৩৮ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে  বাংলা, আসামসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে সাংগঠনিক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং পতিতাবৃত্তি নিরোধ, বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা ও বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। ৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলনেও তিনি নেতৃত্বদান এবং কারাভোগ করেন। মাওলানা তর্কবাগীশ ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। তার পরবর্তী সভাপতি  বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি নির্মাণে যেসব মনীষী  অবদান রেখেছেন, মাওলানা তর্কবাগীশ ছিলেন তাদের মধ্যে একজন।

এই বর্ণাঢ্য চরিত্রের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মাওলানা তর্কবাগীশের আন্দোলনের ফসলই সলঙ্গা দিবস। সলঙ্গা দিবস মানেই  ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী মুক্তিকামী উল্লাপাড়ার সহস্ত্র মানুষের জীবন বিলানোর তেজস্বী সংগ্রামের আখ্যান-সলঙ্গা আন্দোলন। সলঙ্গা দিবস মানেই উপমহাদেশের মাটি থেকে ব্রিটিশদের তাড়ানোর তাগিদে  মাওলানা তর্কবাগীশের ডাকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত এ দেশের জনতার দল-মত নির্বিশেষে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া। সলঙ্গা দিবস মানেই সলঙ্গার হাটে ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে হাজার জনতার বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে  উপমহাদেশের স্বাধীনতার রক্ত সিঁড়ি নির্মাণ।

প্রতিবছর সলঙ্গা দিবস আমাদের পূর্বপুরুষদের গৌরবোজ্জ্বল রাজনৈতিক চরিত্রের কথা মনে করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয় স্বাধীনতাকামী বাংলার সংগ্রামী জনতার কথা। মনে করিয়ে দেয় মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের কথা।

আমাদের এই প্রজন্মের রাজনীতি আমাদের পূর্বপুরুষ তর্কবাগীশদের মতো মানুষের স্বাধীনতার ও কল্যাণের রাজনীতি হোক। বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত হোক,অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার রাজনীতি হোক- সেটাই কাম্য।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
তিন লাল কার্ডের ম্যাচ নিয়ে কে কী বললেন!
তিন লাল কার্ডের ম্যাচ নিয়ে কে কী বললেন!
প্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
লোকসভা নির্বাচনপ্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
ইসরায়েলি বিমান কীভাবে এলো বাংলাদেশে, প্রশ্ন নুরের
ইসরায়েলি বিমান কীভাবে এলো বাংলাদেশে, প্রশ্ন নুরের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ