X
শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫
২৬ বৈশাখ ১৪৩২

পাঁচ বিধবার ছবিটি কী জানান দেয়?

জোবাইদা নাসরীন
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৮:৩৭আপডেট : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৮:৩৭

জোবাইদা নাসরীন ছবিটি গতকাল থেকেই ফেসবুকে ঘুরছিল। এর আগে কয়েকটি জাতীয় দৈনিকেও ছাপা হয়েছে। ছবিটি খুবই করুণ। পাঁচ জন অল্প বয়সী বিধবা নারী সাদা শাড়িতে এবং আরও তিন জন আবুঝ সন্তান ছোট্ট ছোট্ট সাদা ধুতিতে ধর্মীয় আচার পালনের কিছু উপকরণ হাতে দাঁড়িয়ে। ছবিটি অনেককেই স্তম্ভিত করেছে, বেদনার্ত করেছে। প্রকাশিত এই ছবিটির সঙ্গে আরেকটি ছবির অনেক মিল। তবে সেই ছবিতে বিধবাদের সংখ্যা বেশি। আর দুই ছবির প্রেক্ষাপটও ভিন্ন। একটি স্বাধীনতা যুদ্ধের লোমহর্ষকতার, আরেকটি স্বাধীন দেশে হত্যার ছবি।

সাম্প্রতিক ছবিটি মনে করিয়ে দেয় বাংলাদেশের বিধবাদের গ্রামের কথা। সেই গ্রামটি কখনও বিধবাদের গ্রাম ছিল না। জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসির অপরাধের একটি হলো একাত্তরের সোহাগপুর গণহত্যা। এতে একদিনে ৫৭ জন নারী বিধবা হন শেরপুরের নালিতাবাড়ির অদূরে এই গ্রামটিতে। আর সেই থেকেই গ্রামটির নাম হয় ‘বিধবা পল্লি।’ ওয়েটিং উইডো’ শিরোনামে একটি ক্যাম্পেইন সেই বিধবাদের সামনে এনে সেই গণহত্যার ঘটনায় দায়ী ব্যক্তির বিচারের দাবিকে আরও বেগবান করেছিল।

পাঁচ জন নারীর একসঙ্গে বিধবা হওয়ার ঘটনা আমরা ইতোমধ্যে জেনে গেছি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, গত ৩০ জানুয়ারি মারা যান কক্সবাজারের চকরিয়ার সুরেশ চন্দ্র সুশীল। গত ৮ ফেব্রুয়ারি তাঁর শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। সেই শ্রাদ্ধের জন্য ধর্মীয় আচার শেষে স্থানীয় একটি মন্দির থেকে বাড়ি ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন সুরেশ চন্দ্রের পাঁচ ছেলে। শুধু পাঁচ ভাই-ই নিহত নয়, দুই ভাই এবং এক বোনও মারাত্মক আহত। এদের মধ্যে গুরুতর আহত অবস্থায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে আরেক ভাই রক্তিম সুশীল। আরেক ভাই প্লাবন সুশীল চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ও বোন হীরা সুশীল চকরিয়ার মালুমঘাট খ্রিষ্টান মেমোরিয়াল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ইতোমধ্যে হীরার একটি পা কেটে ফেলতে হয়েছে বলে জানা গেছে। নিহত হওয়া পাঁচ ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীরা যখন আচার পালন করছেন, তখন তাদের মা অশ্রুসিক্ত চোখে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছিলেন হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করা তার আরেক ছেলে রক্তিমের জন্য। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, মা মনু রানি বলছিলেন,  ‘ভগবান আমার ছেলেকে বাঁচাও। দয়া করে তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। তুমি আর কতবার আমার পরীক্ষা নেবে।’

তবে এটি যে নিছক কোনও দুর্ঘটনা নয়, তা নিয়েই অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। প্রথম সন্দেহ এসেছে স্বয়ং পরিবার থেকেই। নিহত হওয়া পাঁচ ভাইয়ের বোন মুন্নীর বয়ান থেকে জানা যায়,  তারা দুই বোন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু তার ভাইয়েরা ছিল রাস্তা থেকে দুই হাত দূরে। কিন্তু সেখানে গিয়ে পিকআপটি তাদের ভাইদের পিষে ফেলে।

তিনি আরও বলেন, গত ২৯ জানুয়ারি ৪০-৫০ জন তাদের বাড়িতে হামলা করেছিল এবং তার বাবাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিল। এই হুমকির কারণেই পরের দিন ৩০ জানুয়ারি তাদের বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান বলে তার ধারণা। তিনি আরও জানান, ১০ বছর ধরে তারা এই এলাকায় পারিবারিকভাবে দুর্গাপূজা করে আসছিলেন।

জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে তাদের দ্বিতীয় ভাই  হাসিনাপাড়া এলাকায় পারিবারিকভাবে একটি ছোট মন্দির করার জন্য প্রায় ৪ হাজার ইট এবং ১৫০ ফুট কংকর এনেছিলেন। সেগুলোর সঙ্গে এই হত্যা পরিকল্পনার যোগ থাকতে পারে। এই সন্দেহ আরও জোরদার হয় এই কারণেই যে গাড়িটি যখন প্রথমবার চাপা দেয় তখন পরিবারের একজন সদস্য নিহত হয়েছিলেন। কিন্তু চালক গাড়িটি দ্বিতীয়বার আহতদের ওপর চালিয়ে গেলে আরও তিন জন ঘটনাস্থলে নিহত হয় এবং পরে আরেকজন হাসপাতালে মারা যান। তাই ধারণা করা হচ্ছে, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড এবং পরিবারের ছেলে সদস্যদের হত্যার উদ্দেশ্যেই এটি করা হয়েছে।  

যাহোক, পিকআপ ভ্যান উদ্ধার হলেও ঘটনার তিন দিন পর পরিবারের নয় জন সদস্যকে আঘাত করা পিকআপটির চালককে আটক করার কথা জানিয়েছে র‌্যাব। তবে এখনও এই হত্যাকাণ্ডের মোটিভ জানা যায়নি।

পরিবারটি যে অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিকভাবে এলাকায় প্রভাবশালী ছিল এমনও নয়। কারণ, তারা সরকারিভাবে পরিত্যক্ত ভবনেই বসবাস করতেন। তাদের জমিজমা নিয়ে বিরোধ ছিল না। নিহত পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে এক ভাই শুধু প্রবাসী ছিলেন। বাকিরা এলাকাতেই টুকটাক কাজ করতেন। তাই বিরোধের জের এটাও বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে পড়ছে। হিন্দুবিদ্বেষী অবস্থান থেকে এটি হয়েছে কিনা সেটিও দেখার বিষয়। কারণ, মন্দির তৈরি নিয়েই হামলা হয়েছিল। সেদিন দুই ভাই খাটের নিচে লুকিয়ে ছিল। ভয়ে তারা এই বিষয়ে কাউকে জানায়নি।

তবে যে কারণেই ঘটুক না কেন, এই হত্যার বিচার খুবই জরুরি। পরিবারের মানুষজন খুবই অসহায় অবস্থায় আছে। এমন করুণ পরিস্থিতি এলাকার মানুষ আগে কখনও দেখেনি।

এই ছবি নিয়ে হাহাকার করাই আসলে আমাদের শেষ কথা নয়। এই ঘটনার ন্যায়বিচারের পাশাপাশি আটটি পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্বও সরকারকে নিতে হবে।

শুধু ২৫ হাজার করে টাকা দেওয়াই শেষ কথা নয়। এই মৃত্যুর পেছনে আগের যে হামলা এবং ভয় দেখানো জারি ছিল, সেই সূত্র ধরেই এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে কিনা সেটিও দেখা দরকার। এই পরিবারে এখন একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি নেই। কীভাবে চলবে এই পরিবারের দিনযাপন? পাঁচ ভাইয়ের বাচ্চারাও খুব ছোট। তাই ঘটনা তদন্ত এবং বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি সরকারিভাবে তাদের দায়িত্ব নেওয়া জরুরি। এটির বিচার না হলেও বাংলাদেশে বসবাসরত সংখ্যালঘুরা আরও অনিরাপত্তার মধ্যে পড়বে।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


ইমেইল: [email protected]

 
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দক্ষিণ আফ্রিকার তিন ফরম্যাটের কোচ কনরাড
দক্ষিণ আফ্রিকার তিন ফরম্যাটের কোচ কনরাড
শাহবাগ অবরোধ করেছেন আন্দোলনকারীরা 
শাহবাগ অবরোধ করেছেন আন্দোলনকারীরা 
মা দিবস উপলক্ষে কোথায় কী আয়োজন জেনে নিন
মা দিবস উপলক্ষে কোথায় কী আয়োজন জেনে নিন
আবদুল হামিদের দেশত্যাগ ও আ.লীগ নিষিদ্ধের ইস্যুতে যা বললেন আইন উপদেষ্টা
আবদুল হামিদের দেশত্যাগ ও আ.লীগ নিষিদ্ধের ইস্যুতে যা বললেন আইন উপদেষ্টা
সর্বশেষসর্বাধিক