X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

মৌলবাদের টার্গেট নারী ও সংস্কৃতি: সাবধান হবো কবে?

শারমিন শামস্
১৩ এপ্রিল ২০২২, ১৯:৫৫আপডেট : ১৩ এপ্রিল ২০২২, ১৯:৫৫

শারমিন শামস্ মৌলবাদীদের চোখে খুব গুরুত্বপূর্ণ দুটো টার্গেট হলো নারী ও সংস্কৃতি। এই দুটিকে ঘায়েল করতে তাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হলো অল্প বয়সী তরুণরা। এই অল্প বয়সীদের বাগে আনতে নানা উপায় অবলম্বন করা হয়। এরমধ্যে একটি হলো শিক্ষা কার্যক্রমে প্রভাব বিস্তার করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঢুকে পড়া। বছর কয়েক আগে জঙ্গি উগ্রবাদের বিস্তার, একের পর এক সন্ত্রাসী হামলা, ব্লগার-লেখক খুন ইত্যাদি ঘটনার প্রেক্ষাপটে আমরা দেখেছি, কীভাবে এসব উগ্রবাদী দলে তরুণ অল্প বয়সীদের ভিড়ানো হয়েছে।

এসব সন্ত্রাস, হত্যাকাণ্ডের তীব্র ধাক্কা কেটে যাবার পর আমরা অনেকেই ভেবেছি সবকিছু বোধহয় সমাধান হয়েছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে বিষবৃক্ষ ফণা তুলে বেড়ে উঠেছে আমাদের চোখের সামনে, তাকে আমরা দেখেও না দেখার ভান করে গেছি।

সমাজকে মৌলবাদী মনোভাবসম্পন্ন বানাতে কী না করেছে তারা! পাড়ায় পাড়ায় ওয়াজ করেছে, যেসব  ওয়াজে অনেক বক্তাদের বক্তব্য ছিল তীব্র নারীবিদ্বেষী। নারীকে শায়েস্তা করার নানা উপায় বাতলে দিয়েছে অনেক বক্তারা। নারীর মর্যাদাকে প্রতিনিয়ত ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে হাজার লাখ লোকের সামনে। সবার মগজ ধোলাইয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এরপর অনেক বিদ্বেষপূর্ণ ওয়াজ পৌঁছে গেছে ইউটিউবে, ফেসবুকে, সর্বত্র। ঘরে, পরিবারের ভেতরে এই মৌলবাদী চিন্তা ও কথাবার্তার প্রভাব এক একটি পরিবারের মনোকাঠামো তৈরি করেছে, বদলে দিয়েছে। আর তার চূড়ান্ত প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে তরুণ ছেলেটি বা মেয়েটির ওপর।

যে অভিভাবক অসৎ উপার্জনকে হালাল করতে ধর্মের বেশ ধারণ করেছে, সেই বকধার্মিক পিতামাতার সন্তানটি ধর্মান্ধতা আর ভণ্ডামির সবচেয়ে বড় বলির পাঁঠা হয়েছে। এরা শিখেছে ‘নারী মানুষ নয়, নারী পুরুষের পায়ের নিচে থাকা দাসী’। এরা জেনেছে, বাংলাদেশের সংস্কৃতি মুসলমানের সংস্কৃতি নয়। তারা এই বিশ্বাস নিয়ে বড় হয়েছে যে ধর্ম বাঁচাতে ধর্মান্ধতাকে অবলম্বন করতে হবে। যতই তাদের ঘরে অসৎ উপার্জন, অনৈতিক জীবনাচরণ থাকুক না কেন। ধর্মের লেবাস তাদের দিয়েছে সমাজে মানসম্মান ও ক্ষমতা অর্জনের ছাড়পত্র।

মৌলবাদের চোখে বাংলার সংস্কৃতি হারাম। তাই তারা পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফালগুনের বিরোধী। তারা রবীন্দ্রনাথকে ঘৃণা করে। নাচ গান নাটক শিল্পকলার চর্চা তাদের কাছে নিষিদ্ধ। জগতের সব সৌন্দর্যকে তারা হারাম ঘোষণা করে। কারণ, তাতে তাদের রাজনৈতিক ইসলামি উগ্রবাদ সুবিধা করতে পারবে না। তারা জানে শিল্পকলা সংস্কৃতির চর্চা করা সুশিক্ষিত মানুষেরাই গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল সমাজের শক্তি। তাই এই মানুষগুলোকে পঙ্গু করে দেওয়া তাদের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যপূরণে একশ্রেণির তরুণকে শিল্পীদের পেছনে, শিল্প ও সংস্কৃতির পেছনে, বিজ্ঞান শিক্ষার পেছনে প্রতিপক্ষ হিসেবে ঠেলে দেওয়ার কাজটি তারা দারুণভাবে সমাধা করেছে।

আজ দেশের নতুন প্রজন্মের একটা বিরাট অংশ হয়েছে উঠেছে বিজ্ঞানবিরোধী, ধর্মান্ধ, দেশীয় সংস্কৃতিবিরোধী, শিল্পকলার শত্রু।

বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের ঘটনা আমাদের আতঙ্কিত করেছে। একের পর এক বিজ্ঞান শিক্ষক, হিন্দু শিক্ষককে হয়রানির ঘটনা আমাদের অশনি সংকেত দেখিয়েছে। যে হত্যাকাণ্ডগুলো একসময় উগ্রবাদীরা ঘটিয়েছে, সরকারের দমন নীতির চাপে সেই হত্যা সন্ত্রাস বন্ধ হয়েছে বটে, কিন্তু জাতির নতুন প্রজন্মের মনন ও চেতনার, বিবেকের, শিক্ষার যে হত্যাকাণ্ড তারা ঘটিয়েছে সবার অগোচরে, কিংবা গোচরে, তার ভয়াবহতা এখন আমরা উপলব্ধি করতে পারছি। অদূর ভবিষ্যতে আরও পারবো।

টিপ দেওয়া নিয়ে একজন পুলিশ সদস্যের একজন নারীকে হেনস্তা করা সহজ কোনও ঘটনা নয়। এটাকে ছোট করে দেখার কোনও সুযোগ নেই। এটি খুব মারাত্মক। কারণ, পথেঘাটে মেয়েরাই জানে, তারা কতটা হয়রানির শিকার হয় এসব উগ্রবাদী দ্বারা। নারী অধিকার ও মর্যাদার প্রশ্নে শুধু অর্থনৈতিক পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করলেই নারীর উন্নয়ন ঘটে না। দরকার হয় সমাজের সর্বত্র নারীর প্রকৃত সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিকে সরেজমিন প্রত্যক্ষ করা, জানা। প্রতিটি গ্রামে, মফস্বলে, শহরে মেয়েরা গণহারে হিজাব পরে ঘুরছে। এর পেছনের প্রকৃত কারণটি উদঘাটন জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকারের উচিত আর জেগে জেগে না ঘুমিয়ে এবার চোখ খুলে দেখা। উন্নয়ন মানে জিডিপি নয়। উন্নয়ন মানে মানুষের উন্নয়ন। আর মানুষের উন্নয়ন শুধু ভাতের থালায় থাকলেই দেশ এগিয়ে যায় না। একই সঙ্গে মানুষের মন ও চেতনার উন্নতি ঘটাতে পারলেই সেই উন্নয়ন টেকসই হয়। আর তা না হলে সামাজিক সাংস্কৃতিক ধস নামে। সব ভেসে যায়। তখন আর আহাজারি করে কোনও লাভ হয় না।

নারী শিক্ষার জন্য সরকার বৃত্তি উপবৃত্তি চালু করেছে। কিন্তু বৃত্তি পাওয়া মেয়ে হঠাৎ কেন বোরকায় সর্বাঙ্গ ঢাকছে, এর পেছনের কারণটা জানা জরুরি। কেন বাড়ছে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, কেন নারীদের পথেঘাটে নানা রকম টিপ্পনি কাটা হচ্ছে-এসব নিয়ে কথা বলা, জরিপ ও অনুসন্ধান দরকার। অনেক ওয়াজে বিকৃত বক্তব্য দেওয়া কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না– এও এক রহস্য বটে। ধর্ম মানুষের অন্তরের আলোক না হয়ে মুখোশ হয়ে উঠলো কেন, এর পেছনে কোন সে সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কাঠামো তৎপর- সেটি আমাদের জানতে হবে। সরকারের উচিত এসব নিয়ে কাজ করা এবং জনগণকে সেই তথ্য জানানো। কারণ, মৌলবাদের এই বিষবৃক্ষ উৎখাতের কাজটা সরকার একা করতে পারবে না। জনগণকে সঙ্গে নিয়েই তা করতে হবে সরকারকে। শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী, শিক্ষক, লেখক, বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শ নিতে হবে। তবে অবশ্যই বুঝে-শুনে। ধান্দাবাজ, মুখোশধারী প্রগতিশীলকে চিনে নিতে না পারলে আরেক বিপদ ঘাড়ে এসে পড়বে। আর এ তো হবারই কথা। কারণ, পচে যায়নি এমন একটি জায়গাও তো অবশিষ্ট নেই। তাই খুব সাবধানে খুব সতর্কতার সঙ্গেই লড়াই জারি রাখতে হবে। মৌলবাদকে তোষণ করে ক্ষমতা উপভোগের সুযোগ হয়তো কারোরই খুব বেশি দিন আর থাকবে না। তাই সময় থাকতে সাধু সাবধান!  

লেখক: সম্পাদক, ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
২৬ বছরের বন্ধুত্বের স্মৃতিচারণ করলেন মামুনুল
২৬ বছরের বন্ধুত্বের স্মৃতিচারণ করলেন মামুনুল
ভ্যাটেই মিলবে রাজস্ব, অথচ ভ্যাট বাড়াতে অনীহা
ভ্যাটেই মিলবে রাজস্ব, অথচ ভ্যাট বাড়াতে অনীহা
বাংলাদেশে দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগের ফল দৃশ্যমান হচ্ছে
গ্লোবাল স্কিলস ফোরামে বক্তারাবাংলাদেশে দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগের ফল দৃশ্যমান হচ্ছে
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে দ্বিতীয় দফার ভোট কাল
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে দ্বিতীয় দফার ভোট কাল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ