X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’

লীনা পারভীন
২৪ মে ২০২২, ১৮:২৫আপডেট : ২৪ মে ২০২২, ২১:০৩

কবি আবদুল হাকিমের ‘বঙ্গবাণী’ কবিতার বিখ্যাত দুটি লাইন ছিল– ‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি, হিংসে বঙ্গবাণী।/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’। এই দুটি লাইনের মাধ্যমে কবি দেশপ্রেমের এক অনবদ্য প্রমাণ রেখে গেছেন আমাদের সামনে। মধ্যযুগের কবি হয়েও তিনি বাংলা ভাষার মাধ্যমে আপন জন্মস্থানের প্রতি প্রেম ও ভালোবাসার কথা বলে গেছেন। সেই সময়ে যারা নিজ জন্মভূমি ও জন্মভাষার প্রতি বিদ্বেষ দেখাতে গিয়ে পরদেশের প্রতি বা পরভাষার প্রতি প্রেম পোষণ করতো মূলত কবি তাদের জন্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।

গত কিছুদিন ধরে বিশেষ করে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অবস্থা ধসে পড়ার পর আমাদের দেশের একদল মানুষের আস্ফালন ও উল্লম্ফন দেখে কেবলই আবদুল হাকিমের কবিতাটির কথা মনে পড়ছে। আসলেই তো। এরা কাদের জন্ম? কোথায় বাস করছে এরা? বাংলাদেশের মাটিতে বসে, বাংলার আলো বাতাসে বড় হয়ে এরা এই বাংলারই সর্বনাশের চিত্রের অঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে যাচ্ছে নিয়ত।

শ্রীলঙ্কার আজকের এই দেউলিয়া অবস্থায় মানুষ হিসেবে আমরা প্রত্যেকে অত্যন্ত মর্মাহত। সে দেশের সাধারণ মানুষের যে ভোগান্তি তা কল্পনা করতেও যেখানে গা শিউরে ওঠে সেখানে কিছু মানুষ নিরলসভাবে বলে চলেছে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার পথে হাঁটছে। এবং এই আশঙ্কার মাঝে কোনও বিপদের ভয় নেই বরং তারা আনন্দের সাথে বগল বাজাতে বাজাতে মোটামুটি ব্যান্ডপার্টি রেডি করে অপেক্ষা করছে যেন বাংলাদেশের সর্বনাশে তারা নিজেদের স্বার্থকতা দেখতে পাচ্ছে।

এরা কারা? কাদের ঘরে জন্ম এদের? কেন এরা বাংলাদেশের সর্বনাশ কল্পনা করে সুখ পেতে চাইছে? পরিসংখ্যান বলে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার চেয়ে অনেক দিকে এগিয়ে আছে। অন্তত রিজার্ভ ফুরিয়ে ফকির হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা এখনও পর্যন্ত দেশি-বিদেশি অর্থনীতিবিদেরা কেউই দেখছেন না। এই লেখাটি যখন লিখছি তখনও নিউজে পড়লাম বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি যা গতমাসে কিছুটা কমে গিয়েছিলো। এই কমার কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে কিছু বৈদেশিক পাওনা পরিশোধের কারণে কমেছে। অর্থনৈতিক হিসাব বলছে এপ্রিল মাসে বিদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণও বেড়েছে আগের চেয়ে। করোনার কারণে যেখানে গোটা বিশ্বে রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাচ্ছে, বিভিন্ন দেশে প্রবাসীরা কাজ হারানো বা সেইসব দেশেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মুখোমুখি সেইসব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও আমাদের প্রবাসীদের পাঠানো টাকার পরিমাণ কমেনি।

আমি অর্থনীতিবিদ নই বা বিশ্লেষকও নই। কিন্তু সাধারণ হিসাবে যা বুঝি সেটি হচ্ছে একটি দেশের আয়ের কিছু নিশ্চিত খাত থাকে যেগুলো কোনোভাবেই ১০০% পরনির্ভরশীল নয় বা কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সেই খাতগুলো একেবারে বন্ধ হয়ে যায় না। বাংলাদেশের তেমনি কয়েকটি খাত আছে একদম নিশ্চিত। আর এইসব কারণেই করোনায় শ্রীলঙ্কার প্রধান আয়ের উৎসগুলো একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। একটু বুদ্ধিমান আর মগজওয়ালা হলেই কিন্তু বোঝা সম্ভব। করোনায় বাংলাদেশের আয়ের কোনও খাতেই তেমন ব্যতিক্রম ঘটেনি। পোশাক খাতে বরং অর্ডারের সংখ্যা বেড়েছে কারণ এখানে মার্কেট বন্ধ হয়ে যায়নি। আমাদের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু ছিল। বাজার অচল হয়নি। প্রবাসীদের আয় নিশ্চিতভাবেই দেশে পাঠাতে পেরেছে।

আমি অঙ্ক বা পরিসংখ্যানের হিসাবে যাচ্ছি না কারণ আমার লেখার উদ্দেশ্য সেটি নয়। তবে হ্যাঁ, একদম নির্ভয় হবার কোনও কারণ অবশ্যই নেই। সেই আশঙ্কা কেবল বাংলাদেশ কেন, গোটা বিশ্বের জন্যই তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যেই ভারত, পাকিস্তান, নেপালসহ আরও কয়েকটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা আমরা জানি। পাকিস্তান ও নেপালের রিজার্ভ শঙ্কায় পড়েছে। রিজার্ভ মানে হচ্ছে দেশের সঞ্চয় যেখান থেকে আপনি খরচ করতে পারবেন বা বিপদে চলার ব্যবস্থাটি থাকবে। বৈশ্বিক বিষয়ের ওপর হাত কারোই থাকে না। আমাদের দেশে দুর্নীতি আছে, অর্থ পাচার আছে, কালো টাকা আছে, চুরি আছে। সবই আছে কিন্তু দেখতে হবে সেই জায়গায় কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের কোনও প্রচেষ্টা আছে কিনা।

আমরা জানি শ্রীলঙ্কায় সরকার প্রধান থেকে শুরু করে গোটা প্রশাসন দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল। আমাদের সেখানে কী অবস্থা? আমাদের সরকারের ভেতরেও যে একদম কোনও সমস্যা নেই তা নয়। আছে এবং সেগুলোও প্রকাশিতও হচ্ছে। আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কোনোটাই রিটার্নের পরিকল্পনাবিহীন নয়। প্রতিটির একটা রোডম্যাপ করা আছে। কত দিনে, কীভাবে এই ব্যয় মেটানো হবে এবং কীভাবে ঋণ পরিশোধ করা হবে।

অথচ এসবের কোনও আলোচনা নেই ‘ব্যান্ডপার্টির মালিক’দের মধ্যে। তারা কেবল গায়ের জোরে তালি মেরে যাচ্ছে যে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার পথে হাঁটছে। এরমধ্যেই বিভিন্ন মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে প্রচার করেছে বাংলাদেশের রিজার্ভ দিয়ে আর মাত্র দুই মাস চলতে পারবে। অথচ এই তথ্যের কোনও সোর্স কেউই দিতে পারেনি। এমন প্রচারণায় বিদেশি মাধ্যম যুক্ত হতেই পারে কিন্তু তাই বলে আমাদের দেশের লোকজন কেন যুক্ত হচ্ছে?

সরকারের অনেক সমালোচনা আছে, থাকবেই। আগেই বলেছি যে দুর্নীতি, চুরি, অর্থপাচার সবই বাস্তব। আওয়ামী লীগ সরকার অনেক ক্ষেত্রেই অনেককিছু সামলাতে পারছে না সময় মতো। কিন্তু কেবল একটি দলকে অপছন্দের কারণে বা সরকারকে পছন্দ হচ্ছে না বলে কি কেউ নিজের দেশের এহেন সর্বনাশ কামনা করতে পারে? কীভাবে সম্ভব?

অথচ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এমনকি কিছু কিছু টিভি চ্যানেলেও টকশোর মাধ্যমে আমরা এমন আলোচনা দেখে চলেছি। নিজের দেশের খেয়ে-পরে এমন ব্যঙ্গাত্মক অবস্থান কেবল বাংলাদেশের চরম শত্রুদের পক্ষেই সম্ভব। 

 

লেখক: কলামিস্ট

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ