X
বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫
১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

‘৫০ বিলিয়ন ডলার্স ক্লাব’

প্রভাষ আমিন
৩০ জুন ২০২২, ১৭:৩৩আপডেট : ৩০ জুন ২০২২, ১৭:৩৩

পদ্মা সেতুর উদ্বোধন বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে অসাধারণ এক আবেগের জোয়ার এনেছে। এই জনআবেগের জোয়ারে কিছু আদিখ্যেতা, কিছু বিশৃঙ্খলা, কিছু নাশকতার চেষ্টাও হয়েছে। সেই আবেগ কিছুটা থিতিয়ে আসতেই বাংলাদেশ পেয়েছে উদযাপনের আরও এক বড় উপলক্ষ্য। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশে ছুঁয়েছে অর্থনীতির বড় এক মাইলফলক। আজ যে অর্থবছর শেষ হচ্ছে, সে অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো রফতানিতে ৫০ বিলিয়ন ডলার মানে ৫ হাজার কোটি ডলারের মাইলফলক ছাড়িয়েছে। অর্জনটা যত বড়, আওয়াজটা তত বড় নয়। এটাকে বলে অর্জনের ক্লান্তি। একসময় বাংলাদেশ ক্রিকেটে কেনিয়াকে হারালেও মধ্যরাতে আমরা মিছিল বের করতাম। এখন অস্ট্রেলিয়াকে হারালেও ফেসবুকে অভিনন্দন জানিয়ে ঘুমিয়ে যাই।

গত এক দশকে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে এমন সব বিস্ময়কর অর্জন এসেছে, বড় বড় অর্জনও আমাদের আর বিস্মিত করে না। নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া, উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার গৌরব অর্জন করা, মাথাপিছু আয়, গড় আয়ুতে এমন চমৎকার সব অর্জন, একসময় যা অসম্ভব মনে হতো। অর্থনীতির প্রায় সব সূচকে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যাওয়া, অনেক সূচকে ভারতের সঙ্গে টেক্কা দেওয়াও এখন আমাদের কাছে ডালভাত মনে হয়। নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু বানানোর মতো অসম্ভবকে সম্ভব করলেও অনেকে বলেন, সরকারে থাকলেও উন্নয়ন হবে, এটা তো স্বাভাবিক ঘটনা। বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেলেও অনেকে হাই তোলেন, এ আর এমন কি? কিন্তু তারা ভাবেন না, এই স্বাভাবিক ঘটনাগুলো আগে কেন ঘটেনি। শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ, তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করাকেও স্বাভাবিক ঘটনা বানিয়ে ফেলেছেন।

বাংলাদেশ যে এখন রফতানিতে ‘৫০ বিলিয়ন ডলার ক্লাবে’র গর্বিত সদস্য, সেটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ, জ্বালানি তেল রফতানির হিসাবে বাদ দিলে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষ ৫০ রফতানিকারক দেশের একটি। এশিয়ায় এ অবস্থান শীর্ষ ২০-এর মধ্যে। আর দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। এই অর্জনকে আমি তারচেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ মানি কারণ করোনার দুই বছরের ধাক্কা সামলাতে এখনও হিমশিম খাচ্ছে বিশ্বের বাঘা বাঘা অর্থনীতির দেশগুলোও। করোনার ধাক্কা সামলে ওঠার লড়াইয়ে থাকতে থাকতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে অর্থনীতি আবার বেপথ হওয়ার ঝুঁকি। সেই দুঃসময়ে রফতানিতে ৫০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছোঁয়া অবশ্যই বড় অর্জন, বিশাল স্বস্তি। এখন তারচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এই অর্জন ধরে রাখার।  

ছেলেবেলায় আমরা বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের তালিকা মুখস্ত করেছি- পাট, চা, চামড়া। এই পণ্যগুলো এখনও তালিকায় আছে বটে, তবে টাকার অঙ্কে অনেক পেছনে। বাংলাদেশের অর্থনীতি, রফতানি সবকিছু এখন তৈরি পোশাক খাতের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এই যে বাংলাদেশ ৫০ বিলিয়ন ডলার রফতানির মাইলফলক ছাড়িয়ে গেলো, তার ৮২ ভাগই তৈরি পোশাক খাতের অবদান। আর তৈরি পোশাক খাতকে বাংলাদেশের ব্র্যান্ড করে তোলার কৃতিত্ব অবশ্যই আমাদের সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের। মূলত সস্তা শ্রমকে পুঁজি করেই বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতের বিকাশ। এখন গুনে-মানে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে পারে। বিশাল ধন্যবাদ পাবেন, তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারাও। তাদের নিরলস পরিশ্রমই বাংলাদেশকে অন্যরকম উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। তবে তৈরি পোশাক খাত তার সামর্থ্যের চূড়া ছুঁয়ে ফেলেছে এমনটি মনে করার কোনও কারণ নেই। এই খাতকে আরও বড় করার, আরও বেশি বাজার দখল করার সুযোগ এখনও রয়ে গেছে।

রফতানিতে একটি খাতের অবদানই ৮২ ভাগ, এটা একদিনে যেমন উদযাপনের, অন্যদিকে কিছুটা শঙ্কারও। কোনও কারণে তৈরি পোশাক খাতে কিছু হলে তার বড় প্রভাব পড়বে রফতানিতে। তাই তৈরি পোশাক খাতকে ঠিক রেখে সময় এসেছে রফতানির অন্য খাতগুলোর দিকে নজর দেওয়ার। ছেলেবেলায় যেমনটি পড়েছিলাম; সেই পাট, চা, চামড়া খাতকেও এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তৈরি পোশাক খাত যে নীতি সহায়তা পায়, অন্য খাতগুলোর পাশেও যদি সরকার তেমন মমতা নিয়ে দাঁড়ায় তাহলে ১০০ বিলিয়ন ডলার ক্লাবের মর্যাদাও খুব দূরের মনে হবে না। রপ্তানির মোমেন্টাম ধরে রাখতে হলে পণ্য বহুমুখীকরণ যেমন দরকার, তেমনি দরকার বাজার বহুমুখী করারও। বিশেষ করে লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর দিকে আরও নজর দিতে হবে। বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী, সাইকেল, ওষুধ, কৃষিপণ্য, অপ্রচলিত খাদ্যপণ্য রফতানির নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে।

আমি বাংলাদেশকে ভালোবাসি, মুখে এই কথা বললে হবে না। কাজের মাধ্যমেই দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন, তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা দেখিয়েছেন অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পথ। এই পথ ধরে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে দৃপ্ত পায়ে, মাথা উঁচু মর্যাদার সাথে।

শুরুতে বলছিলাম পদ্মা সেতুর কথা। উদ্বোধনের আবেগ থিতিয়ে এসেছে। পদ্মা সেতুকে পিকনিক স্পট বানিয়ে ফেলা লোকজনও ঘরে ফিরেছে। এখন পদ্মা সেতু নিজেদের অর্থে বানানো আমাদের স্থায়ী সম্পদ। এখন এই সম্পদকে কাজে লাগিয়ে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার কার্যকর পরিকল্পনা নিতে হবে। পদ্মা সেতু আসলে একটি যুগ বদলকারী স্থাপনা। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পদ্মা সেতু নির্মাণের আগে এবং পরে দুটি আলাদা সময় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। গত কয়েকবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি দারুণ গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো অর্থনীতির স্বাভাবিক তৎপরতায় একইরকম গতি বজায় রাখা যায় না। প্রবৃদ্ধিরও একটা সীমা থাকে। তাই এক পর্যায়ে অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা চলে আসে। তখন অর্থনীতিতে গতি আনতে নতুন কিছু লাগে। বাংলাদেশের অর্থনীতির সেই ‘নতুন কিছু’ হতে পারে পদ্মা সেতু, হতে পারে অর্থনীতির গেম চেঞ্জার।

পদ্মা সেতুর সর্বোচ্চ ব্যবহার করে কীভাবে অর্থনীতিকে বদলে দেওয়া যায়, তা নিয়ে এখনই পরিকল্পনা করতে হবে। বলা হচ্ছে, পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলাকে ঢাকার সঙ্গে যুক্ত করবে। খুবই সত্য কথা। তাহলে দেশের বাকি ৪৩ জেলার মানুষ পদ্মা সেতু নিয়ে গর্ব করবে কেন? পদ্মা সেতু দেশের বাকি মানুষদের কী দেবে? পদ্মা সেতু কোনও আঞ্চলিক স্থাপনা নয়, এটি জাতীয় স্থাপনা। তাই আমাদের ভাবনাটাও হতে হবে বৃহত্তর আঙ্গিকেই। জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে পদ্মা সেতুর অবদান হবে ১.২ ভাগ। এটা ঠিক দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় পদ্মা সেতুর অবদানটা হবে প্রত্যক্ষ। কিন্তু এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে পদ্মা সেতু যে চাঞ্চল্য আনবে, তার ঢেউ ছড়িয়ে পড়বে গোটা দেশেই। পদ্মা সেতু চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমিয়ে দেবে অনেকটাই। কারণ পদ্মা সেতুর ফলে মোংলা বন্দর এখন চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে কাছে চলে এসেছে। মংলা বন্দরের সক্ষমতা বাড়ালে তা আমাদের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে দারুণ গতি আনতে পারে। মোদ্দা কথা হলো, পদ্মা সেতুর সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারলে তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে উপকার পাবে দেশের প্রতিটি মানুষ। পার্বত্য চট্টগ্রামের যে মানুষটি হয়তো কোনোদিন পদ্মা সেতু চোখেও দেখতে পাবে না, পদ্মা সেতুর ইতিবাচক প্রভাব পৌছে যেতে পারে তার ঘরেও।

তবে আমরা সবাই যেভাবে পদ্মা সেতু ‘দখিন দুয়ার খুলে দিয়েছে’ বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছি; তাতে কিন্তু হিতে বিপরীত হতে পারে। পদ্মা সেতু বরিশাল-খুলনা-যশোরকে ঢাকার কাছে নিয়ে এসেছে; এভাবে ভাবলে উন্নয়ন আরও কেন্দ্রীভূত হবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ ঢাকায় আরও বেশি ভিড় করবে। বরং আমাদের ভাবনাটা হতে পদ্মা সেতু ঢাকাকে বরিশালের আরও কাছে নিয়ে গেলো।

এখন যদি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলা নতুন নতুন শিল্প –কারখানা গড়ে ওঠে, তাহলে সেটাই হবে সত্যিকারের উন্নয়ন। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যদি রপ্তানিমুখী শিল্প গড়ে ওঠে এবং সেখানে উৎপাদিত পণ্য যদি সরাসরি মংলা বন্দর দিয়ে রপ্তানি হয়ে যায়; তাহলে কী চমৎতার হয় ব্যাপারটা। ঢাকা টেরই পেলোনা, কিন্তু অর্থনীতি এগিয়ে গেল। সেতুর মাধ্যমে সারাদেশকে যুক্ত করে আমরা যদি উন্নয়ন ভাবনাটা সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে পারি, উন্নয়নের বিকেন্দ্রীকরণ করতে পারলেই অর্থনীতি জেগে উঠবে; কমবে আঞ্চলিক বৈষম্যও।

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের এক সপ্তাহের মধ্যে রপ্তানিতে ৫০ বিলিয়ন ডলারের অভিজাত ক্লাবে বাংলাদেশের অন্তর্ভূক্তি আমাদের আনন্দকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন এই দুই অর্জনের মধ্যে একটা মেলবন্ধন ঘটাতে পারলে অর্থনীতি আরো গতি পাবে। বাংলাদেশকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (১৫ মে, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (১৫ মে, ২০২৫)
আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা জবি শিক্ষার্থীদের
আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা জবি শিক্ষার্থীদের
তুরস্কের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করলো দিল্লির জেএনইউ
তুরস্কের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করলো দিল্লির জেএনইউ
উপদেষ্টা মাহফুজের মাথায় বোতল নিক্ষেপ, হাসনাত বললেন ‘প্রত‍্যাশিত নয়’
উপদেষ্টা মাহফুজের মাথায় বোতল নিক্ষেপ, হাসনাত বললেন ‘প্রত‍্যাশিত নয়’
সর্বশেষসর্বাধিক