X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও বাংলাদেশের সতর্কতা

রাজন ভট্টাচার্য
০৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২১:৪০আপডেট : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২২:০৪

করোনার পরিস্থিতির ধাক্কা সামলে ওঠার মধ্যেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ গোটা বিশ্বের জন্য আরেক মহাদুর্যোগ হয়ে সামনে এসেছে। সংকট বেড়েছে দেশে দেশে। অর্থনৈতিক মহামন্দা পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশকে ১১ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলা আরও বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। সময় গেলেও বৈশ্বিক রাজনীতি অনুকূলে না আসায় নির্যাতিত এসব মানুষকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। মিয়ানমার সরকার তাদের নাগরিকদের আন্তরিকভাবে প্রত্যাবাসন চায়, এমন সম্ভাবনাও ক্ষীণ। 

বৈশ্বিক রাজনীতি ও বাস্তবতা, কারও অনুরোধ রাখা কিংবা মানবিকতা যেকোনও কারণেই হোক না কেন–অসহায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার পর পুরো বিষয়টি এখন দেশের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ইস্যুতে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বরাবরই বলছেন, চীন কিংবা ভারত উদ্যোগী হলেই এই সংকট নিরসন সম্ভব। কমবেশি এই দুই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো। উভয় দেশই বাংলাদেশে মিত্র হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিত। তবে কেন সমস্যার সমাধান মিলছে না?

তাহলে কি চীন বা ভারতের কাছে সমস্যা সমাধানের যে চাবি থাকার কথা বলা হচ্ছে, তা শতভাগ সঠিক নয়। এর নেপথ্যে সমাধানের জাদুর কাঠিটি অন্য কারও হাতে লুকানো থাকতে পারে! সেখান থেকে ইশারা দিলেই চীন বা ভারত সামনে থেকে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে। রাজনীতির মারপ্যাঁচে এটা যে খুবই অমূলক ধারণা, তা বলা যাবে না। 

প্রশ্ন হলো, সমস্যার সমাধান তাহলে কোথায়? রোহিঙ্গা ইস্যুর পাঁচ বছর পূর্তিতে আবারও আলোচনায় তা সামনে এসেছে। এতে কয়েকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। একটি হলো বিএনপি মহাসচিব রোহিঙ্গা সংকট সমাধান না করতে পারায় সরকারের পররাষ্ট্রনীতির দুর্বলতাকেই দোষারোপ করেছেন। অন্যদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের আবারও আগ্রহ প্রকাশের কথা।

আর ঢাকা সফররত জাতিসংঘের মহাসচিবের মিয়ানমার-বিষয়ক বিশেষ দূত নোয়েলিন হেইজার ও যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের আঞ্চলিক শরণার্থী সমন্বয়কারী ম্যাক্যানজি রোওর ভাষ্য, ‘রাখাইন পরিস্থিতি পাঁচ বছর পরে আগের চেয়ে আরও খারাপ হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে, স্বেচ্ছায়, মর্যাদার সঙ্গে কিংবা টেকসইভাবে প্রত্যাবর্তন সম্ভব নয়’।

চলমান এই সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘মিয়ানমার ও বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করে ত্রিপক্ষীয় একটি উদ্যোগ নিতে পারে চীন। ভারত, জাপানের মতো দেশও এমন ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ নিতে পারে।’

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার পাশাপাশি তৃতীয় দেশে তাদের স্থানান্তরের পরামর্শও অনেকের। অর্থাৎ শরণার্থীদের চাপ আন্তর্জাতিকভাবে ভাগাভাগি করারও প্রস্তাব এসেছে কূটনৈতিক মহল থেকে। তবে তৃতীয় দেশে শরণার্থীদের স্থানান্তর একটি স্থায়ী সমাধান বটেই!

যত প্রস্তাব আসুক না কেন, বৈশ্বিক সংকটের মুখে ১১ লাখ মানুষকে ভাগাভাগি করে নেওয়ার বিষয়ে কারা উদ্যোগ নেবে? যাদের কথায় সব দেশ সম্মত হয়ে বিশাল এই জনগোষ্ঠীর জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করবে? কোনও দেশ স্বেচ্ছায় কি এই বোঝা মাথায় তুলতে এগিয়ে আসবে?

রোহিঙ্গা সমস্যার কারণে গোটা অঞ্চল অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে এমন একটি স্পর্শকাতর কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন শুরু করতে বাংলাদেশ বন্ধু রাষ্ট্রকেও যুক্ত করেছে, কিন্তু তারা মিয়ানমারের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। আসিয়ান চাইলে ভূমিকা রাখতে পারে।’

এসব আলোচনার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন এক বিবৃতিতে মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে কবে থেকে কত সংখ্যক রোহিঙ্গাকে যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়া হবে, সে বিষয়ে কিছু বলেননি তিনি! 

রোহিঙ্গাদের নিতে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ প্রকাশের পরদিন ২৬ আগস্ট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘...শুনলাম, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, তারা রোহিঙ্গাদের কিছু লোককে পুনর্বাসিত করবেন। এভাবে বাংলাদেশে নিযুক্ত ১৪টি দেশের রাষ্ট্রদূতরা আশ্বাস দিয়েছেন, তারাও এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেবেন।’

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের কথার সারমর্ম হলো, রোহিঙ্গাদের নিতে অনেক দেশ থেকে আশ্বাস এলেও মূলত কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সেদিক বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি কতটুকু বাস্তবায়ন হবে তা সময়েই বলবে।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গত ২৫ আগস্ট বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুটি একটি বৈশ্বিক সংকট, বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সে বিষয়ে যথাযথভাবে উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে পাঠাতে সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।’

কথা হলো এই সংকট কি বিএনপির সংকট নয়? তাছাড়া সমস্যা সমাধানে সরকারকে যখন ব্যর্থ মনে করছে বিএনপি তখন কি সরকারকে সহযোগিতার জন্য কোনও প্রস্তাব দিয়েছে। নাকি বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বিএনপির পররাষ্ট্র বিষয়ক উইং থেকে এ ব্যাপারে কোনও দূতিয়ালি করেছে। যা সরকারের জন্য চমক হিসেবে তারা দেখাতে পারে? বিশ্বে কি এমন কোনও নজির নেই, সরকার ও বিরোধী দল দেশের স্বার্থে একযোগে কাজ করে না?

আমরা এক হয়ে দেশের স্বার্থে কাজ করতে পারি না, এটা নিজেদের দৈন্যতা। সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে রাজনৈতিক চর্চা প্রসারিত হয়নি, যা আবারও প্রমাণিত। অথচ সমালোচনায় মুখর থাকা যায় সহজেই। বিএনপির উচিত ছিল অন্তত রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকারকে সহযোগিতা করা। কারণ রোহিঙ্গাদের নিয়ে দেশকে এখন অনেক বেশি বেগ পেতে হচ্ছে। তাই রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি এ বিষয়ে দায় এড়াতে পারে না। কাজের কাজ না করে ‘কিল মাড়ার গোসাই’ হয়ে লাভ কী?   

২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে প্রায় ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারে প্রবেশ করে। সব মিলিয়ে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার ভার বহন করছে বাংলাদেশ। ভারত, চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের দেশগুলোসহ আন্তর্জাতিক মহল আরও কার্যকর ও ফলপ্রসূ চাপ না দিলে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে পাঠানো সম্ভব নয় বলে বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় বেরিয়ে এসেছে। তাই সরকারকে এ পথের হাল ছাড়লে চলবে না। 

অন্য পথের মধ্যে রয়েছে, জাতিসংঘ বা প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে রোহিঙ্গাদের ভাগ করে নেওয়া! রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনকে শুধু কাগুজে চুক্তিতে বন্দি না রেখে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় চুক্তির কার্যকর প্রয়োগের পথেও সরকারকে এগোতে হবে। সেই সঙ্গে জাতিসংঘ, আঞ্চলিক সংস্থা, বিশ্ব পরাশক্তিগুলোর নিজ নিজ ভূমিকা সুনিশ্চিত করতে হবে।

কার্যকর কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে জাতিসংঘসহ আঞ্চলিক মহলকে বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতার কথা উপলব্ধি করাতে হবে। এতসব আলোচনার মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে নিজ দেশে প্রত্যাবাসন। তাই বৈশ্বিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে, তাদের ফিরিয়ে নিতে সামরিক সরকার যেন আন্তরিকতার সঙ্গে বাধ্য হয়। তার আগে আন্তর্জাতিক মহলের মাধ্যমেও লিখিত চুক্তি প্রয়োজন হবে।

আবার মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বোঝাতে তড়িঘড়ি করে কিছু মানুষকে ফেরত নেওয়ার উদ্যোগ নিতে পারে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সতর্ক থাকা উচিত। মিয়ানমারের পাতানো ফাঁদে পা দিলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনার সব দরজা বন্ধ হলে তা আবারও খুলতে বাংলাদেশকে অনেক বেশি বেগ পেতে হবে। 

 

 লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ