X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবারও কেন ভয়ের মিছিল!

রেজানুর রহমান
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৭:২৭আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৭:২৭

আমাদের সোবহান সাহেব যারপর নাই বিব্রত। দ্রব্যের মূল্য হু হু করে বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে ঠকবাজি, প্রতারণা আর সাধারণ মানুষকে বিপদে ফেলার নানা কলাকৌশল। আরও বাড়ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। অন্যদিকে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে দেশের পার্বত্য অঞ্চলে মানবিক বিবেচনায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা। মিয়ানমার থেকে হাড্ডিসার শরীর নিয়ে মানুষগুলো এই দেশে এসেছিল। এখন শরীর স্বাস্থ্য সুন্দর। হৃষ্ট-পুষ্ট শরীর। কথায় আছে সুখে থাকতে ভূতে কিলায়। আশ্রয় শিবিরে রোহিঙ্গাদের অনেক দল, উপদলের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত। বাংলাদেশের মোবাইল সিম তাদের পাওয়ার কথা নয়। অথচ রোহিঙ্গাদের হাতে মোবাইল ফোনের ছড়াছড়ি। অতি চালাক যারা তারা নানা কৌশলে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র বাগিয়ে নিচ্ছে। কী সর্বনাশ!

বাংলাদেশের বৈধ নাগরিক নয়, অথচ বাগিয়ে নিচ্ছে জাতীয় পরিচয়পত্র! এই দেশে টাকা দিলে নাকি বাঘের চোখও পাওয়া যায়। এটা ছিল কথার কথা। এখন সেই কথাই সত্য হয়েছে।

বাঘের চোখ হয়তো পাওয়া যায় না। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র তো চাট্টিখানি কথা নয়। রাষ্ট্রের স্বীকৃতি। বৈধ নাগরিকদেরই এটা পাওয়ার কথা। অথচ উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয় নিয়ে বিদেশেও যাচ্ছে। কী ভয়ংকর তথ্য। সোবহান সাহেব এসব ভেবেই অস্থির। নানা জনে নানা কথা বলে। সবকিছুই ভয়ের কথা।

আড্ডা আলোচনায় এমন কথাই ভাসছে এখন, বলেছিলাম না, এই রোহিঙ্গারা একদিন বাংলাদেশে অনেক আতঙ্ক ও সংকট সৃষ্টি করবে। কাঙালের কথা বাসি হলেই ফলে। ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা মারামারি করে। অন্যদিকে মিয়ানমার বাংলাদেশের সীমান্তে গোলা ফেলছে। একবার নয় কয়েকবার মিয়ানমারের গোলা এসে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় পড়েছে।

ইতোমধ্যে গোলার আঘাতে একজনের মৃত্যু ও কয়েকজন আহত হয়েছে। মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে। এসএসসি পরীক্ষার একটি কেন্দ্র সরিয়ে নিতে হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ অযৌক্তিকভাবে কেন এই যন্ত্রণাগুলো সহ্য করবে? বাংলাদেশ কি কোনও দোষ করেছে? তাহলে মিয়ানমার কেন কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করছে?

সোবহান সাহেবের মনেও এই প্রশ্নগুলো গভীর রেখাপাত করেছে। আমি তো দোষী নই। অথচ আমার বাড়িতে ইটপাটকেল ছোড়া হচ্ছে। তার মানে প্রতিবেশী কি পায়ে পাড়া দিয়ে আমার সাথে যুদ্ধ করতে চায়? কী সাংঘাতিক।

সোবহান সাহেব সমস্যায় পড়েছেন চাল নিয়ে। চিকন চালের ভাত খাবেন বলে বাজার থেকে চিকন চাল নিয়ে এসেছেন। চালের কেজি ৭৬ টাকা। দোকানদার প্রসঙ্গ ছাড়াই সততার দিব্যি দিয়ে বললো, স্যার আপনি এই চালটাই নেন। ভাত অনেক চিকন হবে। খেয়ে আরাম পাবেন। কথায় আছে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। সেজন্য তর্কে না গিয়ে বিশ্বাসই করলেন সোবহান সাহেব। টুপি পরা কোনও মানুষ কি আর মিথ্যা বলবে?

কিন্তু চিকন চালের ভাত চিকন হলো না। মোটা মোটা ভাত। রাবারের মতো শক্ত। সোবহান সাহেবের ছেলের বউ বললো, আব্বা দোকানদার আপনাকে ঠকিয়েছে। আজকাল মোটা চালকে মেশিনে কেটে চিকন করা হয়। আপনি সেই চাল কিনে এনেছেন। যার যে চরিত্র সেটা তো প্রকাশ পাবেই। মোটা চাল যতই কাটেন ভাত তো চিকন হবে না। মোটাই হবে। দোকানদার আপনার সাথে প্রতারণা করেছে। আপনি বুঝতে পারেননি। আপনি সৎ মানুষ। সৎ শিক্ষক। প্রতারণা বুঝবেন কী করে?

ছেলের বউয়ের কথা শুনে সোবহান সাহেব একটু ভাবলেন। কয়েক দিন ধরে একজন প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রশ্নপত্র চুরির দুর্নাম সারা দেশে তোলপাড় তুলেছে। এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র চুরির ঘটনায় ওই প্রধান শিক্ষককে দায়ী করা হচ্ছে। কী সাংঘাতিক ঘটনা। রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকা!

প্রধান শিক্ষক হলেন একটি কেন্দ্রের সচিব। অর্থাৎ নির্ধারিত একটি পরীক্ষা কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান ব্যক্তি। তিনিই মূলত অন্যায়, দুর্নীতি ও চুরি ঠেকাবেন। অথচ তিনিই অবতীর্ণ হলেন চোরের ভূমিকায়। কেন তিনি এই অন্যায় কাজটা করলেন। শিক্ষকতা মহান পেশা এই কথাটি কি একবারও ভাবলেন না? একজন শিক্ষকের চারিত্রিক অন্ধকারের দায় দেশের সব শিক্ষকের ওপর দেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু একথা তো সত্য, এক বালতি দুধের জন্য এক ফোঁটা লেবুর রস মহা আতঙ্কের। এই কথা কাকে বোঝাবেন সোবহান সাহেব। মাথায় যে প্রশ্নগুলো কিলবিল করছে কে তার জবাব দেবে।

অনেক দিন ধরে দেশে তেমন কোনও রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল না। ভয়ের মিছিল দেখা যায়নি। ‘হরতাল’, ‘অবরোধ’ ভয়ংকর এই শব্দ দুটো সাধারণ মানুষের স্মৃতিতে মুছেই গেছে বলা যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আবার যেন রাজনীতির বাতাস উত্তপ্ত হতে যাচ্ছে। সেদিন বাজার থেকে বেরিয়ে রিকশায় ছেলের বাসার দিকে যাচ্ছিলেন সোবহান সাহেব। রংপুর থেকে ঢাকায় এসেছেন ছেলেমেয়েদের দেখতে। ঢাকায় সোবহান সাহেবের দুই ছেলে এক মেয়ে থাকেন। বড় ছেলে ফোরকান সরকারি চাকরি করেন। মেজো মেয়ে পিয়ারীর স্বামী ব্যবসায়ী। রাজনীতি করে। ছোট ছেলে গোফরান একটি পত্রিকার রিপোর্টার। গল্প, কবিতা, টিভি নাটক লেখে। তবে অন্য দুই ছেলেমেয়ের মতো সচ্ছল নয়। ঢাকায় বেড়াতে এলে সাধারণত ফোরকানের বাসায়ই ওঠেন সোবহান সাহেব। ফোরকানের বউ সেজুতি খুব লক্ষ্মী মেয়ে। মূলত তার টানেই হঠাৎ করেই ঢাকায় আসেন সোবহান সাহেব। এবার এসেছেন প্রায় তিন মাস পর। এই তিন মাসেই ঢাকার জীবনযাত্রা অনেক বদলে গেছে। বাড়ি ভাড়া বেড়েছে। রিকশায় যেতে যেতে এই কথাগুলোই আলোচনা করছিলেন রিকশাওয়ালার সাথে। রিকশা চালক বয়স্ক। রিকশা টানতে কষ্ট হচ্ছে। সোবহান সাহেব ভাবলেন রিকশা থেকে নেমে হেঁটেই যাবেন, কিন্তু রিকশাচালক তার সাথে আলাপ জুড়ে দিলো। বললো, স্যার দেশের পরিস্থিতি কেমন বুঝতেছেন? সোবহান সাহেব রিকশাচালককেই পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন– তোমার কী মনে হয়? দেশ তো ভালোই চলছে, নাকি?

রিকশাচালক উত্তরে বললো, আপনার কথা সত্য। দেশ ভালোই চলতেছে। তবে জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়তেছে তাতে ভবিষ্যতের তো কোনও দিশা পাইতেছি না। রাজনীতির হাওয়াও তো স্যার ভালো না। আবার তো দেখি ভয় দেখানো মিছিল মিটিং শুরু হইছে। আবারও কি এই দেশে হরতাল অবরোধ হবে? দেশের জন্য এসব কর্মসূচি মোটেই ভালো না। আপনি কী বলেন স্যার?

সোবহান সাহেব কোনও মন্তব্য করলেন না। উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় দেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে একটা সুশাসন প্রয়োজন। অন্যায়, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলবাজি উৎসাহিত হলে উন্নয়ন অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে। কিন্তু কে শুনবে এসব কথা?

রিকশাচালক আবার প্রশ্ন করলেন– স্যার আপনার সাথে একটা ব্যাপারে আলাপ করতে চাই। যদি পারমিশন দেন...

সোবহান সাহেব মাথা নেড়ে বললেন– পারমিশন দিলাম।

রিকশাচালক রিকশা চালাতে চালাতে বললেন, ছাত্র-রাজনীতির ব্যাপারে আপনার ধারণা কী স্যার? ইডেন কলেজের ঘটনাটা দেখছেন। আমরা সেখানে মেয়েদের পাঠাইছি লেখাপড়া করতে। অথচ তারা সেখানে গভীর রাইতে মারামারি করে। এক পক্ষ নাকি অন্য পক্ষের গোপন ভিডিও তুলেছে। এসব কি স্যার শিক্ষার্থীর কাজ? আমার মেয়েটা এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। আমার ইচ্ছা তাকে ইডেন কলেজে পড়াবো। কিন্তু ইডেনের যে অবস্থা তাতে তো...।

রিকশাচালকের কথা শুনে সোবহান সাহেব অবাক হলেন। এই লোককে তো স্যালুট করা দরকার। রিকশা চালিয়ে মেয়েকে লেখাপড়া করাচ্ছে। রিকশা থেকে নামতে যাচ্ছিলেন সোবহান। রিকশাচালক বললো, স্যার কি ঠিকানা মতো আইস্যা পড়ছেন?

না। ভাবছি বাকি পথ হেঁটে যাবো।

রিকশাচালক বললো, হাঁটবেন কেন? চলেন জায়গা মতো আপনাকে পৌঁছায়া দেই। সত্যি কথা বলতে কি স্যার, সুখ দুঃখের কথা সহজেই কাউরে বলি না। বললে বিরক্ত হয়। আপনাকে দেখে মনে হইলো কথাগুলো বলা যায়। আমার বয়স হইছে বইল্যা কি আপনি আমার রিকশায় উঠতে চাইতেছেন না? তাইলে স্যার আমি যাত্রী পাবো কোথায়? আমাকে তো চলতে হবে...।

রিকশাচালক কথা শেষ করতে পারলো না। হঠাৎ সামনের দিক থেকে একটা মিছিল আসতে দেখা গেলো। সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছে। সাথে সাথে বিপরীত থেকে সরকার পক্ষের আরেকটি মিছিলকে আসতে দেখা গেলো। দুই দিকেই ভয়ের মিছিল। মিছিল কেন এত ভয়ের হবে? সোবহান সাহেব এই প্রশ্নটা কাকে করবেন ভাবতে  থাকলেন...।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক: আনন্দ আলো।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ